তিউনিসীয় মায়ের কণ্ঠেও একই গল্প

মায়ের খুব ন্যাওটা ছিলেন বেলজিয়ামের সাবরি বেন আলি। সেই ছেলেই একদিন ঘর ছেড়ে সোজা সিরিয়ায়। আইএসের হয়ে যুদ্ধ করবেন! যেমন হুট করে ঘর ছাড়া, তেমনি হঠাৎ অপরিচিত একজন ফোনে জানায়, সাবরি নিহত হয়েছেন। সময়টা ২০১৩ সালের। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে সাড়ে ১৮ বছরের ছেলের এভাবে চলে যাওয়ার কাহিনি শোনাছিলেন মা সালিহা বেন আলি। ছেলের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে তিউনিসীয় বংশোদ্ভূত এই নারী অবিরাম বলে চলেছেন একই গল্প। উদ্দেশ্য, সাবরির মতো কেউ যেন আর ভুল পথে পা না বাড়ান। সাবরির গল্প শোনাতে গিয়ে সালিহার গলা কেঁপে কেঁপে ওঠে, ‘হায় সাবরি! সে তো আর দশটা ছেলের মতোই ছিল। স্কুলে যেত। গান ভালোবাসত। খেলাধুলা করত। সেই ছেলে হঠাৎ বদলে গেল।...নানা প্রশ্ন মাথায় কিলবিল করত ওর। জবাব পায়নি। ভুল সময়ে ভুল মানুষের খপ্পরে পড়েছিল। ‘সাবরি তখন স্কুল ছেড়ে কাজ খুঁজছিল। পেল না। সেনাবাহিনীতে নিল না, ফায়ার ফাইটার হতে চেয়েছিল।
তারাও পরে যোগাযোগ করতে বলল। সাবির বলছিল, “আমি তিনটি ভাষা জানি, কিন্তু কাজ পাই না। সব সময় নজরদারি। পুলিশ এত চেক করে কেন? বাসে ওঠার সময় তো বটেই, বান্ধবীকে নিয়ে সিনেমা থেকে ফেরার পথেও। কিছু শিক্ষক সাম্প্রদায়িক। আমাকে আমার মতো যারা, তাদের কাছে যেতে হবে।” তখনই সে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে। উত্তর খোঁজে ধর্মীয় নানা বিষয়ের। কিন্তু প্রশ্নের জবাব দেবে কে? মসজিদের ইমাম নামাজ পড়ান। এর বাইরে কথা বলেন না। সাবরি ডাচ ও ফ্রেঞ্চ ভাষা জানত। ইমাম ওই ভাষা দুটি বুঝতেন না। ওই সুযোগটাই কাজে লাগায় একদল সুযোগসন্ধানী।’ সালিহা বলেন, ‘...তারপর ২০১৩ সালের আগস্টের এক সকালে দেখা গেল সাবরির বিছানা শূন্য। সে বাড়ি ছেড়েছে। সেখানে পৌঁছে সাবরি ফেসবুকে তাঁকে খবরটা জানিয়েছিল। তিনি তাঁকে ফিরতে বললেন। তখন সাবরি জানায়, ফিরে আসার কথা বললে সে আর কথা বলারই সুযোগ পাবে না।’ ঠিক কোন অবস্থায় সাবরির মৃত্যু হয়েছিল, ওখানে তাঁর জীবনটা আসলে কেমন ছিল জানতে চান সালিহা। কিন্তু সাবরি তো নেই। আইএস সম্পর্কে সালিহার জানার সুযোগ হয়নি। বাংলাদেশেরও অনেকেরই হতো না, যদিও এখান থেকে বেশ কিছু লোকের সিরিয়ায় আইএসের হয়ে লড়াই করতে যাওয়ার অভিযোগ আছে। এদের একজন গাজী কামরুস সালাম সোহান যদি না ফিরে আসতেন। আইএসের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তাঁর মনে। জানতে পারেন, আইএস চাইছে যতটুকু এলাকা আইএসের দখলে, সেগুলোকে রক্ষা করা এবং এলাকা বাড়ানো। এর জন্য যদি মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধও করতে হয়, তারা পরোয়া করে না। বুঝতে পারেন,
তিনি একটা রাজনৈতিক চালের মধ্যে পড়ে গেছেন। আইএসের যোদ্ধাদের কাছ থেকে শোনেন দাসী কেনাবেচার কথা। দাসীদের ভরণপোষণের জন্য প্রত্যেকে ৫০ ডলার করে পেতেন। নারীদের ওপর এই যৌন নির্যাতন একটা ‘ঘৃণ্য’ কাজ বলে মনে হয় তাঁর কাছে। সালিহা বা কামরুস সালামের এই অভিজ্ঞতা কীভাবে কাজে লাগাবে বাংলাদেশ? বৈষম্যসহ আরও নানা অনুযোগের ব্যাপারে কিশোর-তরুণদেরই বা কী জবাব দেবেন অভিভাবকেরা। এমন প্রশ্নের জবাবে সালিহা বলেন, ‘আমি স্কুল-কলেজে যাই। যেসব পরিবারের ছেলেদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলি। কখনো ধর্মীয় কোনো বিষয়ে কথা বলি না। আমি তাদের কাছে গিয়ে সন্তানহারা মায়ের কষ্টের কথা বলি। মা ও সন্তানের যে সম্পর্ক, তা এতই নিখাদ যে সেখানে আর সবকিছু গৌণ হয়ে যায়।’ গাজী কামরুস সালাম সোহান এখন বাংলাদেশের কারাগারে। বছরখানেক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকার পর ১৭ নভেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এ নিয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ভালো হতো, যদি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা তরুণেরা জানতেন। মোহ থেকে মুক্তি পেতেন তাঁরা।

No comments

Powered by Blogger.