টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন করা অনুচিত কেন?

‘মামাবাড়ির আবদার’ নামক বাগ্ধারাটির সঙ্গে পাঠক সুপরিচিত। এর মর্মকথাও অনেকেরই জানা। ঠিক এ ধরনেরই কিছু দাবি করে থাকে আমাদের দেশের কোনো কোনো সংগঠন। ক্ষেত্রবিশেষে তারা জোর তদবিরও করে। সরকারের ওপরের পর্যায়ে কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তিও সময়ে সময়ে এসব বিষয়ে সমর্থন দেন। কখনো বা সফল হয়ে যান। ঠিক এ ধরনের একটি দাবি নিয়ে চাপাচাপি করছে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। তাদের দাবি অনেক।
এর মধ্যে একটি জোরালো দাবি, ফ্ল্যাট ক্রেতাদের কাছে তাঁদের আয়ের উৎস জানতে চাওয়া যাবে না। এখানে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার জন্যও তারা প্রস্তাব রাখছে। রিয়েল এস্টেট ও হাউজিং খাতে বড় ধরনের মন্দা চলছে বলে এর কারণ খতিয়ে দেখা ও সমস্যা উতরাতে সম্ভাব্য সহায়তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। এটি একটি শ্রমঘন শিল্প। বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহৃত হয় এ খাতে। সেগুলো থেকে পাওয়া যায় শুল্ক ও ভ্যাট। উদ্যোক্তারা নিজস্ব অর্থের সঙ্গে ঋণ করা টাকাও জোগান দেন মূলধন হিসেবে। সময়ে সময়ে ক্রেতাদের অগ্রিমও ব্যয় হয়। এত কিছুর পরও যথেষ্টসংখ্যক ক্রেতার অভাবে অবিক্রীত থাকছে অনেক ফ্ল্যাট। এ শিল্পে স্থবিরতার নেতিবাচক প্রভাব দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে পড়ার কথা। তাই সমস্যাটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। তাই বলে কি ফ্ল্যাট ক্রেতার আয়ের উৎস দেখা যাবে না? কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে এ খাতে? নিকট অতীতে লম্বা সময় কালোটাকাকে নামমাত্র কর দিয়ে আইনানুগ করার সুযোগ ছিল সব ক্ষেত্রেই। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এটা দুর্নীতির প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে। আমরা সবাই দেশ থেকে দুর্নীতির মূল উত্পাটনের কথা বলি। এটাও জানি যে দুর্নীতি আমাদের শতকরা প্রবৃদ্ধি দেড় থেকে ২ শতাংশ কমিয়ে দিচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ চলে যায়।
তবে আয়ের বৈধ উৎস দেখাতে পারলে জরিমানা ও আয়কর দিয়ে আগে আয়কর না দেওয়া টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, আবার কালোটাকার বিশাল অংশ ঘুষ, চাঁদাসহ বিভিন্ন অবৈধ উৎস থেকে আসা। এর ভোগের ক্ষেত্র সীমিত করা দুর্নীতি প্রতিরোধমূলক একটি কাজ। আর কালোটাকার একটি অংশই যায় প্লট, ফ্ল্যাট, বাড়ি, বাগানবাড়ি, গাড়ি ইত্যাদিতে। বলা হয় কালোটাকাকে আইনানুগ করতে না দিলে বিদেশে চলে যাবে। চলে যাচ্ছেও। যখন এ ধরনের সুযোগ অবারিত ছিল, তখনো গেছে। এটা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি দুর্বলতা। তার জন্য এ ধরনের সুযোগ দিতে হবে—এমন দাবি যৌক্তিক নয়। বিদেশে যাতে টাকা পাচার হতে না পারে, তার কার্যক্রম জোরদার করা গুরুত্বপূর্ণ। ফ্ল্যাট ক্রয়ের টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন না করার দাবি যাঁরা করছেন, তাঁদের মতে গৃহনির্মাণে রড, সিমেন্ট, টাইলস, কমোড, গ্লাস, ডোরসহ ২৫০ ধরনের উপকরণ ব্যবহার করা হয়। এগুলোতে ট্যাক্স ও ভ্যাট রয়েছে। তারপরও ফ্ল্যাট হস্তান্তরে ১৪ শতাংশ রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হয়। বলা হচ্ছে, এরপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ফ্ল্যাট ক্রেতাদের টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন করা উচিত নয়। কথাটি শুধু রিহ্যাবই বলছে না। বলছেন সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। নির্মাণসামগ্রীর কোনোটির ওপর যদি ট্যাক্স, ভ্যাটের পরিমাণ অযৌক্তিক বেশি থাকে, তা কমানোর দাবি করা যায়। রেজিস্ট্রেশন ফি কমানোর দাবি করাও অন্যায্য হবে না। তবে ফ্ল্যাট ক্রেতাদের আয়ের উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা কেন উচিত নয়, তা বোধগম্য নয়। ফ্ল্যাট ক্রেতারা টাকা দিয়ে নির্মাণশিল্পকে চাঙা রাখছেন, এটা সত্য।
এ রকম তো অন্য সব খাতের ভোক্তারাও করছেন। তাঁদের আয়ের উৎস দেখা গেলে ফ্ল্যাট ক্রেতাদেরও দেখা যাবে। এটা নৈতিক দিক বিবেচনায়ও যৌক্তিক। ফ্ল্যাট কেনায় অনেক ক্রেতা এমনিতেই কিছু টাকা গোপন করার সুযোগ পান। সরকারের ভুল নীতির কারণে প্রকৃত মূল্য দলিলে খুব কম ক্ষেত্রেই দেখানো হয়। সাধারণত অর্ধেক বা ক্ষেত্রবিশেষে কিছু কম-বেশি থাকে দলিলমূল্য। এতে সরকার ন্যায্য রেজিস্ট্রেশন ফি, স্ট্যাম্প ডিউটি ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হয়। সে ক্ষেত্রে ফ্ল্যাটটির শুধু দলিলে দেখানো দামটির তথ্যই চাইতে পারে এনবিআর বা দুদক। আর এতেও আপত্তি! রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় মন্দাটা বিগত বেশ কয় বছরের। আর অনেকেই বিবেচনা করেন এ খাতে মন্দার জন্য অংশত দায়ী নির্মাতাদের একটি অংশ। রিয়েল এস্টেট খাতের উদ্যোক্তাদের দেশের আবাসন-সংকট নিরসনে, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এবং সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইতিবাচক ভূমিকার জন্য আমরা প্রশংসা করি। তবে ক্রেতাদের সামর্থ্য ও প্রকৃত বাজারচাহিদা বিবেচনা না করে দলে দলে লোক নেমে পড়েন এ ব্যবসায়। জমির মালিকদের অবাস্তব অংশীদারত্ব ও নগদ টাকা দেওয়ায় ইউনিটপ্রতি ফ্ল্যাট নির্মাণে ব্যয় বৃদ্ধি পায় অনেক। শুধু রাজধানী বা চট্টগ্রামের মতো বড় শহর নয়, জেলা-উপজেলায়ও নির্মাতারা এ ধরনের ফ্ল্যাট নির্মাণ করতে শুরু করেন। কতৃপক্ষও নির্বিচারে অনুমোদন দেয় বহুতল ভবনের।
দুটো রিকশা পাশাপাশি চলে না, এমন রাস্তার পাশেও ছয়তলা ভবন হয়। এভাবে যাঁদের জমি নেওয়া হলো, তাঁরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে হন গৃহহীন। ফ্ল্যাট নির্মাণ শুরুই করতে পারেননি বা কিছুটা এগিয়ে সরে পড়েছেন—এ রকম নির্মাতার সংখ্যাও একেবারে কম নয়। জমির মালিককে প্রতিশ্রুত বাড়িভাড়া দিচ্ছেন না। এমন ঘটনা আছে অনেক। নির্মিত ফ্ল্যাটগুলোর জন্যও ক্রেতা জুটছে না। এ দুর্দশা শুধু অলিগলি বা মফস্বল শহরেই সীমাবদ্ধ নেই। রাজধানী ঢাকার পরিকল্পিত এলাকাগুলোতেও এখন ‘ফর সেল’ লেখা নতুন ফ্ল্যাটের ছড়াছড়ি। রিয়েল এস্টেট খাতের মন্দা কাটাতে কোনো কোনো নির্মাণসামগ্রীর কর-ভ্যাট কিছুটা হ্রাস করলে একটু সহায়ক হবে, এর তালিকা করে রিহ্যাব সরকারের কাছে দাবি জানাতে পারে। ফ্ল্যাট ক্রেতাদের কম সুদে ব্যাংকঋণ–প্রাপ্তির দাবিও অযৌক্তিক হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাপ দিলে ‘কস্ট অব ফান্ড’-এর ওপর কিছু মার্জিন রেখে এ খাতে ঋণ দেওয়া যায়। এমনকি সরকারের একটি তহবিল খুব কম সুদে ব্যাংকগুলোকে দিলে তারা এক অঙ্কের ঘরেই এ ঋণসুবিধা দিতে পারে। তবে মূল সমস্যাটি জমির দামে। জমির দাম অত্যন্ত বেশি ধরা হয়। এটা ফ্ল্যাটের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। চুক্তিবদ্ধ প্লটগুলো নিয়ে কী করা হবে, তা আমাদের অজানা। তবে নতুন চুক্তিতে বাস্তববাদী না হলে সমস্যাটি শুধু চলমানই থাকবে না, বরং ঘনীভূত হবে। জমির মালিক ও নির্মাতার অনুপাত এবং অগ্রিম কোন অঞ্চলে কত হবে, তা বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার।
প্রতিযোগিতা করে জমি নেওয়ার প্রবণতা থেকে দূরে সরে আসার সময় এখনই। আমরা সমাজ থেকে দুর্নীতি ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনতে চাই। এতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা হয়েছে। এর মাঝে এনবিআর আর দুদকের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এককালে তো দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের নামের তালিকায় আমরা তলানিতে ছিলাম। বেশ কয়েক বছর বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে কিছুটা ওপরে উঠতে পেরেছি। তবে আমরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে কপট আচরণ করি। দুদক যখন অন্যকে ধরে, তখন বাহবা দিই। আর নিজের ঘরের দিকে আসতে থাকলে হইচই করি। নেমে পড়ি বিরোধিতায়। দুদক ও এনবিআরও জনভোগান্তির কারণ যেন না হয়, এটাও দেখা দরকার। তাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্যক্রমের প্রতিও প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি জোরদার করতে হবে। আমাদেরও এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি বাড়াতে হবে সমর্থনের মাত্রা। দেশের স্বার্থে এদের শক্তিশালী অবস্থান দরকার। এ কারণেই রিয়েল এস্টেট ব্যবসার বর্তমান সমস্যা মেটাতে প্রতিষ্ঠান দুটোকে তাদের আইনি অধিকার ও কর্তব্য ছেড়ে দিয়ে বসে থাকার ‘আবদার’ যথাযথ নয়, বরং আপত্তিকর।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.