ভাগ্যিস, বাংলাদেশটা ফেনী নয়! by সোহরাব হাসান

ফেনীর তিন পৌরসভার নির্বাচনে মনোনয়নপত্র পেশের খবরটি বের হওয়ার পর বুঝতে পারলাম সেখানে বহুল আলোচিত জয়নাল হাজারী না থাকলেও তাঁর যোগ্য উত্তরসূরিরা আছেন। জয়নাল হাজারী সাংসদ থাকতে সেখানে নাকি তাঁর হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ত না। আজ সেই জয়নাল হাজারী আওয়ামী লীগে নেই, এমনকি ফেনীতেও নেই। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিএনপির শাসনামলে যিনি সাংসদ হয়ে এসেছিলেন, তিনিও তাঁর মতো ফেনী শাসন করার চেষ্টা করেছেন। এখন যিনি আছেন, তিনিও। ফেনী বরাবরই সন্ত্রাসকবলিত।
দেশের অনেক পৌরসভায় যখন বড় দুই দল থেকে একাধিক প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন, যখন দলীয় মনোনয়ন লাভের জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জোর তদবির চালিয়েছেন, তখন ফেনীর তিন পৌরসভার দুটিতেই মেয়র পদে একজন করে প্রার্থী হওয়া এবং ৪৮ টি কাউন্সিলর পদের মধ্যে ৪৪টিতেই একক প্রার্থী থাকার বিষয়টি কেবল অস্বাভাবিক নয়, রহস্যজনকও বটে। আর এই রহস্যের পেছনে আছে ফেনীর সন্ত্রাসকবলিত রাজনীতি। সেখানে নব্য জমিদারের ভয়ে কেউ প্রার্থী হতেই সাহস পাচ্ছেন না। ভোটের চেয়ে নিশ্চয়ই প্রাণের মায়া অনেক বেশি। বছর দুই আগে ফেনীতে যে উপজেলা চেয়ারম্যানকে গাড়ির ভেতর আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো, সেই মামলার ৫৬ জন আসামির মধ্যে একজন ছাড়া সবাই স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।
ফেনীর নির্বাচনের খবর পড়ে একজন সহকর্মী সখেদে বললেন, ভাগ্যিস বাংলাদেশটা ফেনী হয়ে যায়নি। বাংলাদেশটা ফেনী হলে কোথাও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো প্রার্থী পাওয়া যেত না। এক পদ এক প্রার্থী। সে ক্ষেত্রে সব পৌরসভায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র ও কাউন্সিলররা নির্বাচিত হতেন।
ফেনীতে যাই হোক না কেন, নির্বাচন সামনে রেখে সারা দেশে এখন ভোটের উৎসব। প্রার্থীরা ভোটারদের বাড়িতে বাড়িতে যাচ্ছেন, নিজেদের কর্মসূচি তুলে ধরছেন। এতে ভোটাররাও প্রার্থীর গুণাগুণ যাচাই করার সুযোগ পাচ্ছেন।
তবে এবারের পৌর নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সাত বছর পর নৌকা ও ধানের শীষের মুখোমুখি হওয়া। এই দুই প্রতীকের মধ্যে সর্বশেষ নির্বাচনী যুদ্ধ হয় ২০০৮ সালে। এরপর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দফায় দফায় সিটি করপোরেশন, উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও দলীয় প্রতীক নিয়ে হাজির হয়নি। সেই সুযোগও ছিল না। এই প্রথমবারের মতো সরকার নির্দল স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনকে দলীয় মোড়কে এনে প্রতিদ্বন্দ্বীকে চালে হারিয়ে দিলেও তার নিজের জন্যও চ্যালেঞ্জটি কম নয়। তবে পুরোপুরি দলীয় হয়নি, কাউন্সিলররা থেকে যাচ্ছেন নির্দলই। আগে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো বেনামে অংশ নিত। তাই দুই দলই হার-জিতকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করত। বিরোধী দল জিতলে ক্ষমতাসীনেরা বলতেন, এটা তো জাতীয় নির্বাচন নয়। দুই ভোটের হিসাব এক নয়। আর বিরোধী দল হারলে বলত, জনগণ বিরোধী দলকে প্রত্যাখ্যান এবং সরকারের ভালো কাজের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
পৌর নির্বাচন নিয়ে মাঠের লড়াইয়ের চেয়ে এবার দুই প্রধান দলের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইটা এখনতক বেশি বলে মনে হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞার কারণে মন্ত্রী ও সাংসদেরা নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে না পারলেও ঢাকায় বসে হুংকার ছুড়ছেন। আর বিরোধী দলের নেতারাও দেয়ালঘেরা ঘরে বসে সেই হুংকারের জবাবে ব্যাঘ্র গর্জন করে চলেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ ধরনের বাদানুবাদ সব সময়ই ছিল, থাকবে। আমরা আশা করব, নেতানেত্রীদের এই হুংকার হুমকি বাগ্‌যুদ্ধের মধ্যেই সীমিত থাকবে। মাঠে বন্দুক-বোমা-লাঠালাঠি-কিরিচ-চাপাতির মহড়ায় রূপ নেবে না।
পৌর নির্বাচন নিয়ে প্রত্যাশার পাশাপাশি সংশয়ও কম নয়। যদি নির্বাচনটি মোটামুটি সুষ্ঠু হয়, ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন, দেশের রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরে আসার ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে। অন্তত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বসার মতো একটি পরিবেশ তৈরি হবে। কিন্তু নির্বাচনটি যদি সুষ্ঠু না হয়, তাহলে কী হবে কেউ বলতে পারে না। ইতিমধ্যে যেসব আলামত দেখা যাচ্ছে, তা ভালো মনে করছেন না অনেকেই। কোথাও কোথাও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় শুরু হয়েছে। হলফনামার তথ্য অনুযায়ী উভয় দলের অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা আছে। কিন্তু গ্রেপ্তার হচ্ছেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরাই।
নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, তারা গায়ে আর কালি লাগাতে চায় না। বরং পৌর নির্বাচনে কিছু একটা করে দেখাতে চায়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল, সরকারি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া সেটি একেবারেই অসম্ভব। সরকারের একাধিক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বলেছেন, তাঁরা পৌর নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন না। কোনো কারণে এর ব্যতিক্রম হলে, তাতে আগামী জাতীয় নির্বাচনের একটি খারাপ সংকেত যাবে। আমরা কেন সেটি করতে যাব? মন্ত্রীরা যদি কথা রাখতে পারেন তাহলে সব দলের অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় নির্বাচনের একটি ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। আমরা এও জানি যে শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন দেশে সুশাসন ও গণতন্ত্র দিতে পারে না। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন সুশাসন ও গণতন্ত্রের অপরিহার্য পূর্বশর্ত।
অনেকের অভিযোগ, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি ভুল করেছে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে প্রায় ছিটকে পড়েছে। তাদের এ অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েও যে প্রশ্নটি করতে হয়, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন করে কি আওয়ামী লীগ স্বস্তিতে আছে? সম্ভবত নয়। উত্তরণের পথ সবাইকে মিলেই খুঁজতে হবে।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনটি মোটামুটি সুষ্ঠু ও সুস্থ হলে নির্বাচন তথা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি যেমন মানুষের আস্থা বাড়বে, তেমনি দুই দলের মধ্যকার বৈরিতা ও অবিশ্বাস কিছুটা হলেও কমবে।
দমনপীড়ন কিংবা জ্বালাও-পোড়াও নয়, ভোটারদের প্রতি আস্থা রাখুন।

No comments

Powered by Blogger.