গুম হওয়া ১৯ পরিবারের কান্না- ‘মা আইসক্রিম কিনে দেয় না, পয়সা নেই’

দুই বছর আগে প্রায় একই সময়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন তারা। দুই বছরেও কারও সন্ধান মিলেনি। তাদের ফিরে আসার আশায় দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে দিন কাটছে পরিবার-পরিজনের। স্বজনহারা পবিারগুলো গতকাল একত্রিত হয়েছিলেন জাতীয় প্রেস ক্লাবে। ওই অনুষ্ঠানে তাদের কান্না আর আকুতিতে ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ। সন্তান হারা মা-বাবা, ভাইহারা বোন আর বাবা হারানো সন্তানের কান্নায় আবেগ আপ্লুত হয়েছেন অনেকে। গুম হওয়া সেলিম রেজা পিন্টুর বোন মুন্নী তার বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তো আমাদের কান্না শুনবেন না। আমরা ভাইকে আর ফেরত চাই না। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, আমাদের মেরে ফেলা হোক। আমরা আর কাঁদতে চাই না। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে।’- ২০১৩ সালের ২৮শে নভেম্বর থেকে ১১ই ডিসেম্বরের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে এই ১৯ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে তারা নিখোঁজ।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে তাদের পক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গুম হওয়া পারভেজ হোসেনের শিশুকন্যা হৃদি হোসেনের কচি হৃদয়ের বুকচাপা বেদনা কান্না হয়ে ঝরে পড়ে। হৃদি এখন রাজধানীর একটি কিন্ডারগার্টেনে নার্সারি শ্রেণীতে পড়ছে। সংবাদ সম্মেলনে মায়ের কোলে বসে মাইকের সামনে যখন হৃদি বাবার স্মৃতিচারণ করছিল তখন তার চোখে ঝরছিল ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু। কচি এই শিশুটির কান্না দেখে উপস্থিত অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। অঝোরে কেঁদে ফেলেন তারা। কান্নাজড়িত কণ্ঠেই হৃদি বলে, ‘আমার বাবাকে ফিরিয়ে দাও। আমি বাবার সঙ্গে স্কুলে যাবো। মা আমাকে আইসক্রিম কিনে দেয় না। মায়ের পয়সা নেই। বাবা আইসক্রিম কিনে দেবে। শিশুপার্কে নিয়ে যাবে। বাবাকে অনেক দিন দেখি না।’ ছোট্ট এই শিশুটি আরও বলে, ‘আমার বাবাকে যে এনে দেবে আমার কাছে অনেক চকোলেট আছে, আমি তাকে চকোলেট দেবো। রাতে আমি বাবার জন্য কান্না করি, মাও কান্না করে, কিন্তু বাবা আসে না।’ একই বছরের ৪ঠা ডিসেম্বর গুম হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা খাতুন মাইকের সামনে কথা বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন । কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের... প্রধানমন্ত্রী পারেন। আমরা এখনও আশায় আছি।’ সাংবাদিকদের উদ্দেশে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, দুই বছর পার করেছি, আর পারছি না। সাংবাদিক ভাইয়েরা আপনারা ভাল করে লিখবেন যেন আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দেয়া হয়।  ওই বছরের ৬ই ডিসেম্বর গুম হওয়া নিজাম উদ্দিন মুন্নার বাবা শামসুদ্দিন বলেন, আমার এখন একটাই পরিচয়- গুম হওয়া সন্তানের পিতা। এই পরিচয় যাতে আর কারও নয় হয়- এই কামনা করি। তিনি বলেন, অনেক কেঁদেছি, আর কাঁদতে চাই না। সরকারের কাছে একটাই চাওয়া- আমার সন্তানের লাশটা যেখানে রাখা হয়েছে, সেই মাটিটা আমাকে  দেখিয়ে দিন। ওই মাটিটা ছুঁয়ে সান্ত্বনা পেতে পারি, জিয়ারত করতে পারি। একই বছরের ২৮শে নভেম্বর গুম হওয়া খালিদ হাসান সোহেলের স্ত্রী শাম্মী সুলতানা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘জেলগেট থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আমরা স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে। এখনও ফিরিয়ে দেয়া হয়নি। আমার দুই বছরের সন্তান পিতা ছাড়া শৈশব পার করেছে। আমার সন্তানের সেই শৈশব ফিরিয়ে দিন। একই বছরের ২রা ডিসেম্বর গুম হওয়া সোহেলের ছেলে জেএসসি পরীক্ষার্থী রাজু বলে, বাবা আমার জন্মদিনের ফুল কিনতে গিয়ে আর ফিরে আসতে পারেননি। বাবা ছাড়া আমাদের ভবিষ্যৎ অচল। বাবাকে ফিরিয়ে দিন। ওই বছরের ৫ই ডিসেম্বর গুম হওয়া আদনান চৌধুরীর পিতা রুহুল আমীন বলেন, রাত ২টার দিকে র‌্যাব-১ পরিচয়ে আমার ছেলেকে তুলে নিয়ে যায়। তারা আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেয়ার শর্তে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজও ছেলেকে ফিরিয়ে দেয়নি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন- প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলে প্রশাসনের লোকেরা আমরা ছেলেকে ফিরিয়ে দেবে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়েন রাজধানীর ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন মারুফা ইসলাম। শাহীনবাগের সাজেদুল ইসলাম সুমন ও এমএ আদনান চোধুরী, বসুন্ধরার জাহিদুল করিম তানভীর, নাখালপাড়ার আবদুল কাদের ভূঁইয়া মাসুম, মাজহারুল ইসলাম রাসেল, কাওসার, কমলাপুরের আসাদুজ্জামান রানা, উত্তর বাড্ডার আল আমিন, সূত্রাপুরের সেলিম রেজা পিন্টু ও সম্রাট  মোল্লা, বাংলাবাজারের খালিদ হাসান, বংশালের হাবিবুর বাশার জহির, পারভেজ হোসেন, মো. সোহেল, মো. সোহেল চঞ্চল, দক্ষিণ খানের নিজাম উদ্দিন মুন্না, তরিকুল ইসলাম ঝন্টু, সবুজবাগের মাহবুব হাসান সুজন ও কাজী ফরহাদ।
সংবাদ সম্মেলনে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান লিটন, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, এনডিপির প্রেসিডিয়াম সদস্য মঞ্জুর হোসেন ঈসা, নাগরিক ঐক্যের আতিকুল ইসলামসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.