কাঁদলেন গুম হওয়া ১৯ জনের স্বজনেরা- আমাদের মেরে যান, আর কাঁদতে চাই না

শীতের রাতে গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বাসায় ঢুকে বিছানা থেকে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। গায়ে কোনো জামাও পরতে দেয়নি। তারা বলেছিল, ডিবি অফিসে জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দেয়া হবে। তার অপেক্ষায় আমাদের পরিবারের সদস্যদের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী তো আমাদের কান্না শুনবেন না। আমরা আমাদের ভাইকে ফেরত চাই না। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, আমাদের পরিবারের সবাইকে মেরে যান। আমরা আর কাঁদতে চাই না। আপনি চাইলেই আমাদের স্বজনদের উদ্ধার সম্ভব।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে কথাগুলো বলছিলেন ২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাতে পল্লবীর বি ব্লকের ৯ নম্বর রোডের ৫ নম্বর বাড়ি থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া সূত্রাপুর থানা ছাত্রদল সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুর বোন রেহেনা বানু মুন্নি।
২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে গুম হওয়া ১৯ জনের পরিবার শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এভাবে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন।
গুম হওয়া ১৯ জনই বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন গুম হওয়া ২৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আইন ও শালিস কেন্দ্রে পরিচালক নূর খান।
সংবাদ সম্মেলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আসাদুজ্জামান রানার বোন মিনারা বেগম বলেন, তাদের বাড়ি রংপুরে। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে রানা ঢাকার উত্তর মুগদায় তার বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করতো। আজ দুই বছর হলো তিনি তার ভাইকে খুঁজছেন। কি ছিলো তাই ভাইয়ের অপরাধ? সে ছাত্রদল করতো এটাই অপরাধ? প্রধানমন্ত্রী চাইলে তার ভাই ফিরে আসতে পারে। আমাদের বিশ্বাস সে ফিরে আসবে।
ছাত্রদল নেতা পারভেজ হোসেনের ছয় বছরের মেয়ে হৃদি হোসেনের কান্না সংবাদ সম্মেলনের স্থানে নিরবতা নেমে আসে। ‘বাবার সাথে স্কুলে যাব। বাবা আইসক্রীম কিনে দিবে। মামনি কিনে দেয় না। মামনির টাকা নেই। বাবার সাথে শিশু পার্কে যাব। প্লিজ, আমার বাবাকে এনে দাও।’ এমন সব কথা বলতে বলতে হৃদি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। তার সে কান্না মায়ের কোলে ফিরে গিয়ে থেমে যায়।
বংশাল এলাকার বিএনপি নেতা সোহেলের ছেলে জেএসসি পরীক্ষার্থী রাজু বলে, ২ ডিসেম্বর তার জন্মদিন। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর তার জন্মদিনে বাবা বাসা থেকে বের হয়েছিল ফুল আনার জন্য। জন্মদিনের কেকও আনা হয়েছিল। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করলেও বাবা আর ফিরে আসেননি। এরপর থেকে তার আর জন্মদিন পালন করা হয় না। নিজের জন্মদিনে যেনো বাবার মৃত্যু দিন না হয়, সেজন্য সে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুতি জানিয়ে বলে, ‘একবারের জন্য হলেও আপনি আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন।’
বিমানবন্দর থানা ছাত্রদল শাখার যুগ্ন সম্পাদক নিজাম উদ্দিন মুন্নার বাবা শামসুদ্দিন বলেন, ২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর রাতে দক্ষিণখানের ১২৫, মোল্লারটেকের বাড়ির সামনে থেকে ডিবি পুলিশ মাইক্রোবাসে করে তার ছেলে ও বন্ধু তরিকুল ইসলাম ঝন্টুকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। চোখের সামনে ছেলেকে যখন জোর করে ডিবি পুলিশ গাড়িতে ওঠাচ্ছিল, তখন তিনি চিৎকার করে বলেছিল, ছেলের লাশ হলেও তোমরা ফেরত দিয়ে যেয়ো। র‌্যাব, পুলিশ, ডিবি-সবার কাছে গিয়েছি। কেউ জানাতে পারেনি। এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ- আমার ছেলেকে যে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে সেটি বলে দিক। আমি ছেলের মাটি নিয়ে শেষ জীবন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চাই।
তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদল শাখার যুগ্ন সম্পাদক তরিকুল ইসলাম ঝন্টুর ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম মিঠুন বলেন, আমার ভাইয়ের অপরাধ কী ছাত্রদল করা? যদি সে কোন অপরাধ করে থাকে, তাহলে আইনে তার বিচার হোক। তার বিরুদ্ধে কোন জিডি বা মামলা নেই। তাহলে কেন তাকে গুম করা হলো?
সবুজবাগ থানা ছাত্রদল শাখার সভাপতি মাহবুব হাসান সুজনের ছোট ভাই শাকিল বলেন, সুজনের দুই সন্তান রয়েছে। তারা এখন বাবার অপেক্ষা করছে। বাবা কোথায় আছে-এ প্রশ্ন করলে আমরা কোন উত্তর দিতে পারি না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই বলে দেন, সুজন এখন কোথায় আছে।
২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে জেল গেট থেকে জামিন মুক্তি পাওয়া বাংলাবাজার এলাকার ছাত্রদল নেতা খালিদ হাসান সোহেল ও সম্রাট মোল্লাকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য পরিচয় দিয়ে ধরে নিয়ে যায়।
খালিদের স্ত্রী সৈয়দা শাম্মী সুলতানা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, খালিদের একটি ছেলে রয়েছে। প্রতিদিন বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু কিছুই বলতে পারি না। আমরা আর কতদিন এভাবে থাকব। প্রধানমন্ত্রী একজন মমতাময়ী মা। তিনি যদি একটু দৃষ্টি দেন তাহলে খালিদের ছেলে তার বাবাকে ফিরে পাবে।
পল্লবী এলাকা থেকে গুম হওয়া ছাত্রদল নেতা সেলিম রেজা পিন্টুর বোন রেহেনা বানু মুন্নী বলেন, তার ভাইকে উদ্ধারের দাবি জানিয়ে চলতি বছরের ২৬ জুলাই সিএমএম কোর্টে একটি মামলা করেন। আদালত পল্লবী থানাকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। ওই মামলার তদন্তের কোনো কুল কিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
সংবাদ সম্মেলনে সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা খাতুন প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই ১৯ জনকে ফিরিয়ে দেয়ার আকুতি জানান।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী যেন এই ১৯ জনকে নিজের সন্তান মনে করে উদ্ধারের ব্যবস্থা নেন। তিনি নির্দেশ দিলেই এই ১৯ জন ফিরে আসা সম্ভব।

No comments

Powered by Blogger.