দর্শনার্থী যন্ত্রণায় দগ্ধরা by আল আমিন

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট। সারা দেশ থেকে দগ্ধ রোগীরা উন্নত চিকিৎসার জন্য এখানে আসেন। গত ২০ দিনের অবরোধে ৫২ জন আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ঢামেকের এই বিশেষ ইউনিটে। সঙ্কটাপন্ন অবস্থা থাকায় এখানকার রোগীদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা হয়। দর্শনার্থী প্রবেশেও রয়েছে কড়াকড়ি। কিন্তু অপরাজনীতির আগুনে পোড়া এ মানুষগুলোকে দেখতে প্রায়ই ভিড় জমাচ্ছেন রাজনীতিবিদ, সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিসহ সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা। দিনভর সংবাদ সংগ্রহের জন্য আসছেন সাংবাদিক ও ফটো সাংবাদিকরা। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দর্শনার্থীদের ভিড় ও অসতর্কতার কারণে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। এতে দগ্ধ রোগীদের সংক্রমণের মাত্রা বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর হার। যে কারণে ওই ইউনিটে দর্শনার্থীদের ভিড় না করার জন্য চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন। গতকাল সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ১০০ শয্যার বার্ন ইউনিটে ৬০০ রোগী ভর্তি ছিলেন। ওয়ার্ড, হাই-ডিপেনডেন্সি ইউনিটে অনেক রোগীকে বারান্দা অথবা ওয়ার্ডের মাঝখানে পাটি পেড়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে সাম্প্রতিক ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ ও হরতালের কারণে ইউনিটের দ্বিতীয় তলায় এবং পশ্চম তলায় বিশেষ ইউনিট খোলা রয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত অবরোধের আগুনে দগ্ধ নারীসহ ৫২ রোগী দগ্ধ ছিলেন। তাদের জন্য বিশেষ একটি সেল খোলা হয়েছে। অবরোধে দগ্ধ শুক্রবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রহিমা বেগম নামে এক নারী মারা যান। তার শরীরের ৪৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। শ্বাসনালিতে ক্ষত হয়েছিল। এ ধরনের রোগীদের সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। গতকাল সকালে বার্ন ইউনিটের দ্বিতীয় তলার এইচডিইউ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন নিরঞ্জন কুমার সিংহ। তার শরীরের ৩৫ ভাগ পুড়ে গেছে। তার পিতা বাবু সেনা সিংহ জানান, ২২শে জানুয়ারির অবরোধে সকালবেলায় সিলেটের বাইপাস চণ্ডিপুল এলাকায় ট্রাকের ভেতরে কাজ করার দুর্বৃত্তরা পেট্রল বোমা ছুড়ে মারে। এতে তার ছেলে দগ্ধ হন। পরে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তার ছেলে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করার পর পরিবারের স্বজন ও তার বন্ধুরা এবং স্থানীয় লোকজন দেখতে এসেছিল। অনেকে হাসপাতালের বারান্দায় রাতও কাটিয়েছেন। চিকিৎসাধীন ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তা উসমান গনি ভর্তি আছেন। তার ভাই শ্যালক জাকির হোসেন জানান, শুক্রবার রাতে যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল ইউনিয়নের সামনে যে বাসে পেট্রলবোমা হামলা হয়েছিল, ওই বাসের যাত্রী ছিলেন তার দুলাভাই। তার মুখ ও হাত দগ্ধ হয়। দগ্ধ হওয়ার মাত্রা ১৪ শতাংশ। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়ে তার পরিবারের লোকজন ও স্থানীয় এলাকাবাসী হাসপাতালে দেখতে আসেন। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শঙ্কর পাল বলেন, রাজধানীর কয়েকটি অভিজাত হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে রয়েছে। কিন্তু সেখানে উচ্চবিত্তরা যান না। উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা ঢামেকের বার্ন ইউনিটে আসেন। কিন্তু সম্প্রতি নিয়ম মেনে দর্শনার্থীরা না আসায় রোগীদের সমস্যা হচ্ছে। এজন্য দর্শনার্থীদের বার্ন ইউনিটে গাউন, মাস্ক, জুতা খোলা ও পরিষ্কার জামাকাপড় পরে আসার জন্য অনুরোধ করেন তিনি। গত কয়েক দিনে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে দুর্বৃত্তদের আগুনে দগ্ধ রোগীদের দেখতে এসেছিলেন সরকারি ও বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ লোকজন। তাদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকী, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর ও আওয়ামী লীগ প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যখন বার্ন ইউনিটে ভর্তিরত দগ্ধ রোগীদের দেখতে আসেন, তখন তাদের সঙ্গে থাকা অনেক লোক কোন ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না নিয়েই হুড়োহুড়ি করে ওয়ার্ডে ঢুকে পড়েন। এমন ঘটনা ঘটেছে আইসিইউতেও। তাদের ছবি নেয়ার জন্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কমপক্ষে ৫০ জন আলোকচিত্রি ও ক্যামেরাম্যানও ঢোকেন। এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হয়। গতকাল সকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম ও বিকালে সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে দগ্ধ রোগীদের দেখতে যান। তাদের উপস্থিতিতেও এ অবস্থা বিরাজ করছিল বলে জানা গেছে। দর্শনার্থীদের ভিড়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দর্শনার্থীদের ভিড়ের বিষয়টি কর্তৃপক্ষ অবগত। কি পন্থা অবলম্বন করলে ওই দর্শনার্থীদের ভিড় কমানো যায় তা ভেবে দেখা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.