হাসপাতালে তিন দিন by অরুণ বসু

শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো, দেশের বড় বড় সরকারি হাসপাতালে​ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি সত্ত্বেও বিশাল কর্মযজ্ঞ চালু রয়েছে বলেই কিছু চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। সুতরাং, নিন্দামন্দ এ লেখার লক্ষ্য নয়। তিন দিন হাসপাতালে থাকাকালে কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথাই বলছি।
২৪ তারিখ শুক্রবার রাত থেকে রাম-কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে লাগল। ১, ২, ৩, ৪, ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। টেলিফোনে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাপোজিটরি দিয়ে জ্বর নামানো হলো। পরদিন আমি নেতিয়ে পড়ি। ফলে, আমাকে বাংলাদেশ মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার তোড়জোড় চলতে থাকে। দুপুর থেকে রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত চলল এভাবেই।
এমন সময় হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ ডাক্তার এলেন আমার কেবিনে। বললেন, আপনার প্রেশার ৯০/৪০। আপনি সিএবিজির (বাইপাস) রোগী। সুতরাং, আমরা আপনাকে এখানে রাখতে পারব না। আপনি হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে (এনআইসিভিডি) চলে যান অথবা আমাদের সিসিইউতে ভর্তি হোন। আমরা সঙ্গে সঙ্গে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে যাওয়ার জন্য তৈরি হই। সব ঠিকঠাক, কিন্তু দেখা গেল আমরা হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে যে ওষুধগুলো কিনেছি, তার পেস্লিপ হারিয়ে ফেলেছি। এখন তারা ওষুধগুলো ফেরত নেবে না। তো আমাদের দরজার সামনে একজন তরুণ ডাক্তার দাঁড়িয়ে ছিলেন। সম্ভবত আমাদের বিদায় দেওয়ার জন্যই। তাঁকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে অনুরোধ করি। চশমা পরা, স্কুলের ভালো ছাত্রের মতো নিপাট চেহারার এই ডাক্তার ভদ্রলোক একটি জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে বললেন, আমি কর্তৃপক্ষকে বলব। আমি বলি, আপনি এখন বলেন। তিনি বললেন, আপনাদের জন্য আমি কিছু করতে পারব না। তবে ভবিষ্যতে যাতে কেউ আর এমন ভোগান্তিতে না পড়েন, সে চেষ্টা করব। তাঁকে বললাম, তাহলে আপনি দরজা ছেড়ে দাঁড়ান, আমরা চলে যাই।
রাত ১২টার পর আমরা হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে পৌঁছাই। আমাদের প্রধান বার্তা সম্পাদক হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালককে আগেই বলে রেখেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সিসিইউতে চলে যাই। কোনো কোনো ডাক্তার আছেন, তাঁদের আচরণে রোগ হয়তো সারে না, কিন্তু মন ভালো হয়ে যায়। সিসিইউর ওই ডাক্তার সাহেব ঠিক এ রকমের মানুষ। খুব যত্ন করে দেখলেন। বললেন, আপনার কোনো হার্টের সমস্যা মনে হচ্ছে না। সুতরাং, সিসিইউর সংকটাপন্ন রোগীর স্বজনদের কান্নাকাটির মধ্যে রাতে ঘুমাতে পারবেন না। বরং আপনি একটি পেয়িং বেডে ভর্তি হয়ে রাতে ঘুমান। সকালে ডাক্তার দেখবেন। তাঁর পরামর্শমতো, গভীর রাতে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ১৪ নম্বর বেডে ভর্তি হলাম।
পরদিন সকালে আমি সিস্টারকে আমার প্রেশার মাপতে অনুরোধ করি। সিস্টার জানালেন, তাঁদের প্রেশার মাপার যন্ত্র নেই। আমি বলি, প্রেশারের সমস্যার কারণেই আমি এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। অন্য ওয়ার্ড থেকে একটি মেশিন এনে আমার প্রেশারটা মেপে দিন। তিনি পাত্তা দিলেন না। বললেন, আপনার প্রেসার মাপবেন ডাক্তার। ইতিমধ্যে একজন তরুণ ডাক্তার এই ওয়ার্ডে এলেন অন্য রোগী দেখতে। আমার এক স্বজন তাঁকে আমার প্রেশার মেপে দিতে অনুরোধ করে। তিনি বললেন, আমি পারব না। পায়ে পায়ে আমি সিস্টারদের ডেস্কের দিকে এগিয়ে যাই। সবিনয়ে ওই ডাক্তারকে বলি, আমি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। তিনি বললেন, আমি বলব না। আমি আবারও বলি, ডাক্তার সাহেব আমি একজন রোগী। আমার একটি কথা দয়া করে শুনুন। তিনি দাঁত খিঁচিয়ে জবাব দিলেন, আমি শুনব না। আপনার ডাক্তার আপনাকে দেখবে। আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না, তুমুল উত্তেজিত হই। এতেও তাঁর কোনো ভাবান্তর হলো না। লোকটা চলে যান, ফিরেও তাকান না। তবে কি মানুষের কিছুতেই কিছু আসে-যায় না? আমার ছেলে আমাকে জড়িয়ে ধরে বেডে এনে শুইয়ে দেয়। আমি হাঁপাতে থাকি।
আমি যে অধ্যাপকের অধীনে ভর্তি হয়েছি, তাঁর সহকারী এসে আমাকে এক্স-রে করার নির্দেশ দিয়ে যান। একটি ট্রলিতে করে আমাকে এক্স-রে বিভাগে নেওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে। ট্রলিটা যেতে যেতে দু-এক গজ পর পর বিগড়ে যায়। ঝাঁকুনিতে আমার পুরো শরীর-কোমর ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। ৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে এক্স-রে বিভাগের দূরত্ব যাঁরা জানেন, তাঁরা এ জ্বালা কিছুটা বুঝবেন। এক্স-রে বিভাগে যাই, সেখানকার কর্ণধার সেলিম মোল্লা সর্বকাজের কাজি। তিনি যত্ন করে তাঁর ঘরে বসান। কিন্তু বিধি বাম, অর্থাৎ এক্স-রে মেশিন গরম। আধঘণ্টা বসে থেকে ওই অচল ট্রলিতেই ক্লান্ত হয়ে বিছানায় ফিরে আসি। কিছুক্ষণ পর আমার এক্স-রে বিভাগে যাওয়ার খবর আসে। আবার সেই নড়বড়ে ট্রলি। সেই ট্রলিতে যেতে যেতে দেখি মাঝবয়সী এক মহিলা (হাসপাতালের স্টাফ নন) একটা ঝকমকে ট্রলি নিয়ে তাঁর রোগীকে আনতে হুটহাট চলে যাচ্ছেন। ভদ্রমহিলাকে অনুরোধ করি, আপনার ট্রলিতে আমাকে একটু পৌঁছে দিন। আমরা তো একই দিকে যাচ্ছি। তিনি পারব না বলে মুখ ঝামটা দিয়ে আরও দ্রুত চলে গেলেন।
এক্স-রে করে ফেরত আসি। অচল ট্রলিতে যে ছেলেটি দু-দুবার আমাকে ঠেলেঠুলে আনা-নেওয়া করেছে, তার নাম মনে না থাকার জন্য খুবই অনুতাপ হচ্ছে। ট্রলির ওই বিষম চলনের মধ্যে ছেলেটি মাঝেমধ্যেই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। ট্রলি থেমে গেলে জামার কলার ঠিক করে, গলায় হাত দিয়ে মমতা জানান দিচ্ছিল। আমি একটু জোরে কথা বললেই, আমার কানে কানে বলছিল, স্যার, জোরে কথা কইয়েন না, বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। ছেলেটির বয়স হবে বড়জোর ২৫। কবির ভাষা ধার করে বলতে ইচ্ছে করে, ‘এই হলো এক রকমের মানুষ। মানুষ, মানুষ যে রকম হবার কথা ছিল। তা না হয়ে আমরা এ রকম হলাম কেন?’
বেডে এসে শুনি, আমার অধ্যাপক সাহেব ফিরে গেছেন। তিনি আজ আর আসবেন না। কী করি? ঠিক করলাম, যেহেতু হার্টের সমস্যা নেই। সুতরাং, নিজ দায়িত্বে বাড়ি ফিরে যাব। সেভাবেই কাগজপত্র লিখে নার্সের কাছে জমা দিলাম। হাসপাতালের পরিচালক সাহেব এ খবর জেনে আমাকে ১৫ মিনিট দেরি করতে অনুরোধ পাঠালেন। কিছুক্ষণ পরেই একজন ডাক্তার এসে বললেন, আপনার হার্ট আবার ব্লক হয়েছে। আপনার যাওয়া চলবে না।
রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। আমি বাইপাস রোগী, তার ওপর আবার ব্লক! আমার স্ত্রী-পুত্র, স্বজন-পরিজন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তাঁদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। রাতে ঘুম হলো না আমার। সকালবেলা আমার ডাক্তার অমর চৌধুরী এলেন। বললেন, আপনার হার্টের কোনো সমস্যা নেই। আপনার লাংয়ে পানি জমেছে। সিভিয়ার নিউমোনিয়া। এখনই কোনো বক্ষব্যাধির বড় ডাক্তারের
কাছে চলে যান।
আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমি আমার ডাক্তারের কাছে বক্ষব্যাধির কাকে দেখাব, সেই পরামর্শ চাই। তিনি দুজন বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের নাম বললেন। তারপর আমার ঠাঁই হলো একটি বেসরকারি হাসপাতালে।

অরুণ বসু: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.