ঈদ: সীমা আর অসীমের দ্বন্দ্ব by মোহীত উল আলম

ধর্মের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্কটা পুরোনো গল্প। তার চেয়েও পুরোনো হচ্ছে ধর্মের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্কটা। ধর্ম আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তু, মানুষের আত্মার সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক নিয়ে ধর্ম আলোকপাত করে। কিন্তু ইহজগতে এর বাস্তবায়ন করতে হয় বিষয়গতভাবে। শুধু প্রতিষ্ঠিত বড় ধর্মগুলোর ব্যাপারে এ কথাটা প্রযোজ্য নয়, প্রাচীনকাল থেকে আদিবাসী ও নৃতাত্ত্বিকভাবে চিহ্নিত গোত্র ও গোষ্ঠী বা যূথবদ্ধ সমাজ ধর্ম পালন করেছে বৈষয়িক ব্যবস্থার মাধ্যমে। তাদের পালিত ধর্ম, ধর্মের আচার-উপচার, সংস্কৃতি ও প্রকাশ হয়েছে প্রথমে বৈষয়িক স্থাপনা, প্রতিষ্ঠানাদি ইত্যাদি তৈরি করে এবং তারপর সেগুলো দেখভালের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত অভিভাবকদের মাধ্যমে। এসব বৈষয়িক ব্যবস্থার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা, সেটা চালু রাখার জন্য ধর্মযাজক নিয়োগ, সেটা যে আছে তার প্রচারের ব্যবস্থা করা এবং যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেটার রূপের পরিবর্তন সাধন করা। ধর্ম পালন এবং উপাসনালয়ের মধ্যে সম্পর্কটা অনেকটা আত্মা ও শরীরের সম্পর্কের মতো। শরীরের মন্দিরে আত্মা বিরাজিত। মানুষের মৃত্যু হলে শরীর পড়ে থাকে, আত্মা বের হয়ে যায়। লালনের ভাষায়, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।’ বলা বাহুল্য, খাঁচাটা শরীর আর অচিন পাখিটি আত্মা। আত্মার জন্য পার্থিব কোনো খরচ পড়ে না, কিন্তু শরীর পার্থিব, তার রক্ষায় খরচ আছে। সে রকম, উপাসনালয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রার্থনা জানাতে বৈষয়িক কোনো খরচ পড়ে না, কিন্তু ওই উপাসনালয় নির্মাণ ও তার রক্ষণাবেক্ষণ খরচের ব্যাপার।
পবিত্র ঈদুল ফিতর উদ্যাপনের সময় ধর্ম পালনের সঙ্গে বিষয়চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা মনে আসা স্বাভাবিক। ঈদুল ফিতর আরবি শব্দগুচ্ছ। ঈদ অর্থ হচ্ছে আনন্দ বা উর‌্যাসব আর ফিতর অর্থ হচ্ছে মৌলিক শুদ্ধাচার বা অন্তর থেকে আমূল পরিচ্ছন্নতা। অর্থার‌্যা পরিচ্ছন্নচিত্তে আনন্দ লাভ করার উদ্দেশ্যে ঈদুল ফিতর উর‌্যাসবের আয়োজন। সাধারণত ঈদ তিন দিনের উর‌্যাসব হলেও রমজান মাসের শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিনেই ঈদ জাঁকজমকভাবে পালন করার রীতি। ওই যে জাঁকজমক বললাম, ওখানেই সৃষ্টি হয়েছে ঈদ পালনের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক, যেটা এ প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়। পবিত্র রমজান মাসে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস থেকে মুমিন মুসলমানেরা ঈদ উদ্যাপনের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু ঈদ উদ্যাপনের এ প্রস্তুতি শুধু আর ফিতরের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না, এটি চলে যেতে থাকে জাঁকজমকের দিকে। ঈদ উদ্যাপনকারীদের ফিতরের শুদ্ধাচারনির্দিষ্ট শৃঙ্খলার বাইরে আসার জন্যই অর্থনৈতিক সূত্রগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে, আর তখন লাভ-লোকসানের অর্থকরী বিষয়টি ঈদ উদ্যাপনরীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে যায়। অথবা, অর্থনৈতিক সূত্রগুলো ঈদের প্রাক্কালে সক্রিয় হয়ে ওঠে বিধায় ঈদ উদ্যাপনকারীদের পক্ষে আয়-ব্যয়ের প্যাটার্নটি ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। ঈদের সময়কার এই অর্থনৈতিক চাপটি নির্ধারণ করে দেয় ঈদ পালনের চেহারাটি কী রকম হবে। অর্থার‌্যা, তখন বড়লোকের এক রকম ঈদ, মধ্যবিত্তের আরেক রকম এবং দরিদ্র লোকের আরও এক রকমের ঈদ চোখে পড়ে।
এই অর্থনৈতিক চাপটি ঈদপর্ব উদ্যাপনের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায় বলে তখন অনেক ক্ষেত্রে একটি প্যারাডক্সের বা ঈদের মেজাজের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যেমন সাধারণভাবে সমাজের মধ্যে ধনী-দরিদ্রের যে বৈষম্য, সেটি প্রকট হলেও দৈনন্দিন কর্মপ্রবাহের তলায় টের পাওয়া যায় না, কিন্তু ঈদের প্রাক্কালে ওই বৈষম্যটিই নিদারুণভাবে ফুটে ওঠে। ঈদের যে ধর্মীয় গণতান্ত্রিকতা, সে চেতনাটিই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এবং আমাদের পরজীবী-আচ্ছন্ন অর্থনৈতিক কাঠামোয় এ বৈষম্যটি সাধারণভাবে মানসিক স্থৈর্যের যে ভাসমান জাহাজটি আছে, সেটিকে টালমাটাল করে তোলে।
একজন সমাজসচেতন বিবেকসম্পন্ন মানুষকে ঈদের প্রাক্কালে এ বৈষম্যটি স্পর্শ করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর পরও ঈদ উদ্যাপনের এ পাগলপারা পরিস্থিতি থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই। কারণ, আনন্দের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে সীমা ছাড়াবেই। আর এ সীমা ছাড়ার প্রণোদনা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সদা ব্যস্ত রয়েছে সক্রিয় অর্থনৈতিক সূত্রগুলো। এককথায় বাজার: হরেক রকমের ঈদের বাজার। বাজার করে কী, সীমার মধ্যে তারা একটা অসীমের সন্ধান দেয়। যেমন, মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদের নিয়ে প্রসঙ্গটা পরিষ্কার করি। একজন মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী যে বাজেট নিয়েই বাজারে ঢুকুক না কেন, বাজারের চাকচিক্য এমন থাকবে যে তিনি সেই বাজেট অতিক্রান্ত হতে প্রলুব্ধ হবেনই। যদি তিনি ক্রেডিট কার্ডধারী হন, তা হলে দোকানির পোয়াবারো। কারণ দোকানি জানেন, ক্রেতাও জানেন, ক্রেডিট কার্ড হচ্ছে অসীমের সুর শোনানোর বাঁশি, যদিও তা পুরোপুরি ছলনা। খুব কম চাকরিজীবী আছেন, যাঁরা বাজেটের অনুশাসনটি মেনে চলতে পারেন, কিংবা ছলনার ফাঁদে পা দেন না। কারণ, প্রিয় খোকা বা খুকির মুখের হাসি ফোটানোই যখন লক্ষ্য, তখন কয়েকটা ক্রেডিট কার্ডের ছলনাও কোনো ব্যাপার নয়। তাই একান্ত বাজারি বা সামাজিক অর্থে রোজার সঙ্গে ঈদের একটি অক্সিমোরনিক বা বৈপরীত্যমূলক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। রোজা সংযমের মাস আর ঈদ যেন সংযম না মানার দিন। (অবশ্য রকমারি ইফতারির কারণে বর্তমানে রোজাও কতটা সংযমের, কতটা অসংযমের সে প্রশ্নও উঠে আসছে।)
যা হোক, ঈদ উদ্যাপনের ব্যাপারটি একজন দরিদ্র শ্রমজীবীর ক্ষেত্রে সীমার মধ্যে অসীমের সুর আরও করুণ হয়ে বাজে। তিনি অনেক কষ্ট করলেও সীমা ছাড়াতে পারেন না। তাঁর তো ক্রেডিট কার্ড নেই, তাঁকে কেউ ধারও দেবেন না। পুরোনো কাপড় দিয়ে বাচ্চাদের ঈদ সামাল দিতে হয়, এমন পরিবারের সংখ্যাও এই দেশে অসংখ্য। এ দিক থেকে ঈদ সামাজিক বৈষম্যের বিষয়টিকেও আমাদের সামনে তুলে ধরে। বড়লোকদের সঙ্গে ঈদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ। ঈদ বছরে দুটো না হয়ে বরং আরও বেশি হলে এ শ্রেণীর জন্য ভালো হতো। এরাই বাজার সৃষ্টি করে, এরাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, আবার এরাই বাজার ভোগ করে। বাজারের একটি নিয়ম হলো নিত্যনতুন (কিছুটা অপ্রয়োজনীয়) চাহিদা তৈরি করা এবং এরা শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাই-ই করেন।
চাহিদা কীভাবে সৃষ্টি করা হয়, তার দুটি তরল উদাহরণ দিচ্ছি। চুল কাটাচ্ছেন আমার এক বন্ধু। চুল কাটা শেষে কেশবিন্যাসকারী জিজ্ঞেস করলেন, স্যার, ফেসিয়াল করবেন। বন্ধু মনে করলেন, বুঝি সামান্য কোনো ব্যাপার। তার পরও সম্মতি দিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, খরচ কত। তিনি বললেন, ৭০০ টাকা। বন্ধুর আঁতকে ওঠা লক্ষ্য করে কেশবিন্যাসকারী বললেন, স্যার, অন্যান্য জায়গায় দুই হাজার টাকা নেয়। বন্ধু বললেন, দরকার নেই, আল্লাহ্্ আমাকে যে বদনখানি দিয়েছেন, তা-ই সই। দ্বিতীয় উদাহরণটি আমার এক ছাত্রী বিভাগীয় ইফতার পার্টিতে বলল সেদিন। পোশাক কিনতে গেছে তার বান্ধবী। দোকানি যে পোশাকই দেখান, তার জবাব এ রকম: এটা তো গত বছরের স্টাইল, ওইটা তো পুরোনো দিনের খালাম্মাদের পোশাক, এটা তো কেইট মিডলটনের ধরনের মশারি নেট নয় ইত্যাদি, ইত্যাদি।
বলা বাহুল্য, ঈদের প্রস্তুতিপর্বে পুরো জাতি এক কৃত্রিম চাহিদার ঘেরাটোপে পড়ে।
এর পরও অবশ্য ঈদের আবেদন সর্বজনীন এবং সর্বকালে একই রকম। যেমন—আমার পিতামহ ঈদের দিন সকালে একধরনের অনির্বচনীয় আনন্দ অনুভব করতেন, আমার পিতাও করতেন। এখন আমিও সেই অনির্বচনীয় আনন্দ অনুভব করি।
ড. মোহীত উল আলম: বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.