ক্রিকেট বোর্ডে ক্রিকেটার থাকবে না!

আইসিসিকে অনুসরণ করতে সম্ভবত অনিচ্ছুক বিসিবির গঠনতন্ত্র সংশোধনী কমিটি। আইসিসি যখন ক্রিকেটকে রাজনীতিমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে, গঠনতন্ত্র সংশোধনী কমিটি তখন কিনা উল্টো সুপারিশ করছে ক্রিকেট বোর্ডকে ক্রিকেটারমুক্ত করার! সংশোধনীতে বিভাগীয় ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্রতিনিধিদের সাধারণ পরিষদে আসার পথ সহজ করা হলেও বিলুপ্তির সুপারিশ করা হয়েছে ক্রিকেটারদের সরাসরি কাউন্সিলর হওয়ার দুটি পথই।
ক্লাব বা জেলার কাউন্সিলর হয়েও বিসিবির সাধারণ পরিষদে ক্রিকেটারদের আসার সুযোগ হয়তো আছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই সুযোগটি যায় সংগঠকদের হাতে। বিসিবির সাধারণ পরিষদে ক্রিকেটারদের আসতে হয় গঠনতন্ত্রের ৯.৩.৮ ও ৯.৩.৯ উপানুচ্ছেদের প্রদর্শিত পথে। এতে দেখা যায়, বোর্ড সভাপতির মনোনয়ন নিয়ে ১৫ জন সাবেক ক্রিকেটার ও বোর্ড-স্বীকৃত ক্রিকেটারদের সংস্থা থেকে ১ জন প্রতিনিধি বিসিবির কাউন্সিলর হতে পারেন। বর্তমান বোর্ড পরিচালক গাজী আশরাফ হোসেন যেমন বিসিবির কাউন্সিলর হয়েছেন উপানুচ্ছেদ ৯.৩.৮ অনুযায়ী। কিন্তু প্রস্তাবিত সংশোধনীতে সিইওর পরিবর্তে সিওও নিয়োগসহ আরও অনেক বিতর্কিত প্রস্তাবের সঙ্গে গঠনতন্ত্রের উপানুচ্ছেদ ৯.৩.৮ ও ৯.৩.৯ বিলুপ্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি গঠনতন্ত্র সংশোধনী কমিটির প্রধান ও বিসিবির পরিচালক দেওয়ান শফিউল আরেফিনকে। কমিটির সদস্য আমিনুল হক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে আরেক সদস্য আবদুল্লাহ আল ফুয়াদ রেদওয়ান উপানুচ্ছেদ দুটি বিলুপ্তির পক্ষে তুলে ধরলেন যুক্তি, ‘ওই দুটি উপানুচ্ছেদ অনুযায়ী কাউন্সিলররা আসেন ব্যক্তি হিসেবে। কিন্তু বিসিবিতে কোনো ব্যক্তি কাউন্সিলর হতে পারেন না। কাউন্সিলর আসবে সংগঠন থেকে।’ যখন মনে করিয়ে দেওয়া হলো, উপানুচ্ছেদ ৯.৩.৯-এ ‘বোর্ড কর্তৃক অনুমোদনপ্রাপ্ত বা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্রিকেট খেলোয়াড়দের সংস্থা বা সংগঠনের’ কথাই বলা আছে, পাল্টা যুক্তি দিলেন, ‘বাংলাদেশে ক্রিকেটারদের বোর্ড অনুমোদিত কোনো সংগঠন নেই। কোয়াব (ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) বোর্ড-স্বীকৃত নয়।’ সেটাই যদি হবে, বিসিবির বর্তমান সাধারণ পরিষদে কোয়াব প্রতিনিধি হিসেবে কীভাবে কাউন্সিলর হন সাবেক ক্রিকেটার দেবব্রত পাল? রেদোয়ানের আত্মপক্ষ সমর্থন, ‘এ বিষয়গুলো হয়েছিল আসলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। তখন কেউ সাহস করে এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে পারেনি।’
রেদোয়ানের দাবি, খেলোয়াড়দের প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু সেটা কোন পর্যায়ে তা অনুমান করা যায় তাঁর অন্য কথায়, ‘কেউ যদি বলে আমরা ক্রিকেটার না, এটা ভুল ধারণা। আমরা যে কয়টা দলকে প্রডিউস করি, যে কয়টা ছেলেকে প্রডিউস করি, এই প্রডিউস কিন্তু সাবেক খেলোয়াড়েরা করে না। তারা মিডিয়ায় টক শো করে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই তাদের ভূমিকা। এর বাইরে কোনো ভূমিকা নেই।’ শুধু তা-ই নয়, বোর্ড কর্মকর্তারা সাবেক ক্রিকেটারদের প্রতি কেমন ‘উদারতা’ দেখাচ্ছেন, দিলেন তারও একটা ফিরিস্তি, ‘বোর্ড এভরিথিং পারে। আমরা তা করছি না। আমরা ইচ্ছা করলে আইন বদলে সিলেক্টরও হতে পারি। সিলেকশন প্যানেল রাখতে হবে এটা কিন্তু বাধ্যতামূলক না। বোর্ড বোর্ডের থেকেও কমিটি করতে পারে।’
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান আলোচিত সংশোধনী প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, ‘তারা অন্য দেশের উদাহরণ টানে। আমি জানতে চাই, বিশ্বের কোথাও কি এ রকম ২৫-২৬ সদস্যবিশিষ্ট ক্রিকেট বোর্ড আছে যেখানে অধিকাংশ লোক ক্রিকেটের “সি”ও জানে না?’ রকিবুলের দৃষ্টিতে পুরো বিষয়টাই দেশের ক্রিকেট ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র, ‘এটা একটা ষড়যন্ত্র। ক্রিকেটকে ধ্বংস করে তারা সরকারকেও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার পাঁয়তারা করছে।’ একই আশঙ্কা আরেক সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদের, ‘আমাদের ক্রিকেট যে আজ এ অবস্থায় এসেছে, এটা সম্ভবত কিছু লোকের পছন্দ হচ্ছে না। তারা পরিকল্পনা করে ক্রিকেটকে ধ্বংস করতে চাচ্ছে।’
বর্তমানে বিসিবির পরিচালক ও সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেনও প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রস্তাবিত সংশোধনী, ‘এটা একটা গোষ্ঠীর চিন্তাভাবনা। কিন্তু দু-একজন লোকের চিন্তাভাবনা মেনে তো আর ক্রিকেট চলবে না। বোর্ডে এবং সাধারণ পরিষদে সেটা অনুমোদন হতে হবে।’ তিনি বরং মনে করেন, খেলোয়াড়-সংগঠক সব ক্ষেত্রেই কাউন্সিলর হওয়ার যোগ্যতা নিরূপণের মানদণ্ড নতুন করে ঠিক করা উচিত, ‘একজন খেলোয়াড় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জাতীয় দলে আসে, বোর্ড কর্মকর্তা হয়। সংগঠকদেরও এ রকম পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করে আসতে হবে। ক্রিকেট শুধু নামধারী সংগঠকদের জায়গা না।’

No comments

Powered by Blogger.