‘এশিয়ান গেমস বাংলাদেশের ফুটবলের ভালো অভিজ্ঞতা’

‘দেশাত্মবোধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে খেললে উজবেকিস্তানের বিপক্ষে ভালো ফলাফল সম্ভব’—বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার শেখ মো. আসলামের এ অভিমতই আজ গুয়াংজু এশিয়ান গেমস ফুটবলে উজবেকিস্তানের বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচে মাঠে নামার মূল অনুপ্রেরণা হতে পারে বাংলাদেশের। নয়তো ফিফা র‌্যাঙ্কিংযের ৯৬তম স্থানে থাকা উজবেকদের বিপক্ষে মাঠে নামাটা ১৫০তম স্থানে থাকা বাংলাদেশের জন্য একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যায়। আসলাম খেলোয়াড়দের ‘ভালো ফলাফলের’ জন্য দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হতে বলেছেন। তবে এই ভালো ফলাফলটা কী, সে ব্যাপারটি নিয়ে অবশ্য খোলাসা করেননি তিনি। বাংলাদেশের হয়ে কোনো একক খেলোয়াড় হিসেবে পরপর চারটি এশিয়াড খেলা এ কিংবদন্তিতুল্য স্ট্রাইকার বলেছেন, ‘অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যেও উজবেকিস্তানের বিপক্ষে খেলাটা বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য ভালো। প্রচণ্ড শক্তিশালী দলের বিপক্ষে যত বেশি খেলা যাবে, ততই দল ও খেলোয়াড়েরা মানসিক দিক দিয়ে শক্ত হতে থাকবে।’
বাংলাদেশ সময় বেলা দুইটার সময় (স্থানীয় সময় চারটা) ম্যাচটি শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশ শিবিরের অবস্থা কিন্তু তেমন আশাপ্রদ নয়। ক্রোয়াট কোচ রবার্ট রুবচিচ যতই বলুন, তিনি উজবেকদের ভয় পাচ্ছেন না। তার পরও সন্দেহটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। সন্দেহের মূল কারণ, খেলোয়াড়দের ইনজুরি ও অসুস্থতা। দলের অধিনায়ক আমিনুল হক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে গেমস ভিলেজে শয্যাশায়ী। ওয়ালি ফয়সালের মতো পরীক্ষিত ডিফেন্ডার ইনজুরিতে ভুগছেন। কিছুদিন আগেই ফেডারেশন কাপে খেলা আরও কয়েকজন খেলোয়াড় ইনজুরিতে পড়েছেন। তবে ইনজুরি-আক্রান্ত খেলোয়াড়দের নিয়ে গুয়াংজু যাওয়াটা একদমই মেনে নিতে পারছেন না সাবেক ফুটবলার আসলাম। তিনি বলেন, ‘ইনজুরি-আক্রান্ত খেলোয়াড়দের পরিবর্তে নতুন সম্ভাবনাময় কয়েকজন খেলোয়াড়কে সুযোগ দিলে দেশের ফুটবলেরই লাভ হতো। তরুণ কয়েকজন খেলোয়াড় এশিয়ান গেমসের অভিজ্ঞতা নিতে পারত।’
আগেই বলা হয়েছে, আসলাম আজকের ম্যাচে দেশাত্মবোধকেই খেলোয়াড়দের মূল শক্তি হিসেবে দেখছেন। এ ব্যাপারে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি যখন বাংলাদেশের জার্সি গায়ে মাঠে নামতাম, নিজের মধ্য থেকেই ভালো খেলার একটা তাড়না অনুভব করতাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি খেলোয়াড় যদি এমন মনোভাব নিয়ে মাঠে নামে, তাহলে প্রতিপক্ষ যতই শক্তিশালী হোক, পারফরম্যান্সে নিজেদের উতরে যাওয়া সম্ভব।’ তিনি আশা করেন, আজ এশিয়ান গেমস ফুটবলের প্রথম ম্যাচে উজবেকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা ঠিক এমন মনোভাব নিয়েই মাঠে নামবেন।
বাংলাদেশ এশিয়ান গেমস ফুটবলে ভালো করুক, তা চান জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ওয়াসিম ইকবালও। বর্তমানে কোচ হিসেবে ব্রাদার্সের দায়িত্বে থাকা সাবেক এ তারকা মনে করেন, ‘এশিয়াডে খেলতে যাওয়া বাংলাদেশের দলটি খুব একটা খারাপ নয়। তবে এশিয়ার সর্বোচ্চ পর্যায়ে বড় দলের বিপক্ষে খেলার অনভিজ্ঞতা ও দলগুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকাটাই দলকে ভোগাতে পারে।’
ওয়াসিমের খেলোয়াড়ি জীবনের স্মৃতির পাতায় এখনো ১৯৮২ সালের দিল্লি এশিয়াড জ্বলজ্বল করছে। তাঁর মতে, ‘১৯৮২ সালে বাংলাদেশের ফলাফল ভালো ছিল। আমরা সেবার দুর্দান্ত খেলেছিলাম। মালয়েশিয়াকে হারিয়েছিলাম ২-১ গোলে। চীনের মতো দল আমাদের বিরুদ্ধে জিততে ঘাম ঝরিয়েছিল। ওরা জিতেছিল ন্যূনতম ব্যবধানে।’ তবে সেবারই পুরো ম্যাচে দুর্দান্ত খেলে ভারতের কাছে ২-১ গোলে হেরে যাওয়ার স্মৃতি এখনো পোড়ায় ওয়াসিমকে।
ওয়াসিম মনে করেন, এবারের এশিয়াডে উজবেকিস্তান ও আমিরাতের বিপক্ষে ফলাফল যা-ই হোক না কেন, হংকংকে বাংলাদেশের হারানো উচিত। কারণ, এই হংকংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের ফিফা র‌্যাঙ্কিংযের ব্যবধান খুব বেশি নয়।
স্মৃতি হাতরে ওয়াসিম বললেন, ১৯৮৬ সালের সিউল এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ সবচেয়ে কঠিন গ্রুপে পড়েছিল। তার পরও সেবার নেপালকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। গোল করেছিলেন আসলাম। সেবার বাংলাদেশের গ্রুপে কুয়েত, ইরান ও জাপানের মতো দলগুলো ছিল। ওয়াসিম মনে করেন, এখনকার তুলনায় সে সময় কুয়েত, ইরান ও জাপানের মতো দলগুলোর বিপক্ষে খেলাটা অনেক বেশি শক্ত ছিল। তবে বাংলাদেশের ফুটবলের মানও একেবারেই ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না বলে তিনি মন্তব্য করেন। আজকের ম্যাচে আমিনুলের খেলা না-খেলা উজবেকিস্তানের বিপক্ষে খুব একটা পার্থক্য তৈরি করবে না বলে মনে করেন ওয়াসিম।
দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ডিফেণ্ডার কায়সার হামিদও মনে করেন, ‘এশিয়ান গেমসে খেলাটা বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের জন্য চমত্কার এক অভিজ্ঞতা।’ তবে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন, মৌসুমের শুরুতে অথবা মাঝখানে জাতীয় দল আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলতে গেলে খেলোয়াড়েরা নিজেদের সেরাটা দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা রক্ষণশীল থাকেন। দেশের হয়ে খেলতে নামলে এ ধরনের মনোভাব খুবই অন্যায় বলে মনে করেন তিনি। তিনি আশা করেন, আজ উজবেকিস্তানের বিপক্ষে খেলোয়াড়েরা সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়ে নিজেদের উজার করে দেবেন। তিনি আরো বলেন, ‘এমনিতেই বাংলাদেশের ফুটবলাররা এশিয়ার সেরা দল গুলোর বিপক্ষে খেলার সুযোগ পায় না। তাই এশিয়ান গেমস উজবেকিস্তান ও আমিরাতের মতো দলগুলোর বিপক্ষে খেলা, দেশের ফুটবলের জন্য ইতিবাচক। কায়সার আশা প্রকাশ করেন, এবারের এশিয়াডে বাংলাদেশ ভালো খেলবে। তিনি মনে করেন, সামর্থ্যের পুরোটা দিয়ে খেললে উজবেকিস্তান ও আমিরাতের বিপক্ষে ড্র করা সম্ভব। তবে বাংলাদেশ হংকংকে হারাবে বলে তাঁর প্রত্যাশা।
জাতীয় দলের আরেক সাবেক স্ট্রাইকার ইমতিয়াজ আহমেদ নকিবও মনে করেন, হংকংয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের জেতা উচিত। তিনি আরও বলেন, ‘উজবেকিস্তান অনেক ভালো দল। তার ওপর ইনজুরি সমস্যা দলকে বেশ ভোগাবে।’ দেশসেরা গোলরক্ষক আমিনুল আজ খেলতে না পারলে খুব চিন্তার কারণ হবে বলে তিনি মনে করেন। ১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়ান গেমসে নিজের খেলার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সেবার আমরা সৌদি আরব ও জাপানের বিপক্ষে খেলেছিলাম। সে সময় জাপান ফুটবলে এতটা এগিয়ে যায়নি। মাঠে নামার আগেও জাপানকে কিছুটা “আন্ডারএস্টিমেট” করেছিলাম আমরা।’ নকিব আরও বলেন, ‘মাঠে নেমেই বুঝতে পারি, ফুটবলে উঠে আসছে দেশটি। সেবারই কাজুইউশো মিউরার মতো খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার।’ ফুটবলে উন্নতি করতে হলে এশিয়ার সেরা দলগুলোর বিপক্ষে নিয়মিত খেলার বিকল্প নেই বলে মনে করেন নকিব। তিনি বলেন, এশিয়ান গেমসের ফল যা-ই হোক, উজবেকিস্তান ও আমিরাতের মতো দেশের বিপক্ষে খেলতে নামা বাংলাদেশের ফুটবলকেই সমৃদ্ধ করবে বলে তিনি মনে করেন।

No comments

Powered by Blogger.