মাসেই বিবর্ণ ৭ কোটি টাকার ভবন

সাত মাস না যেতেই ৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ২৪ হাজার বর্গফুটের ত্রিতল একাডেমি ভবনের শরীরে ফুটে উঠছে বার্ধক্যের নানা জীর্ণতা

বাইরে থেকে দেখলে তো বটেই, মোটা কাচের দরজা ঠেলে যখন ভেতরে পা রাখবেন, মনে হবে কোনো পাঁচ তারকা হোটেলেই বুঝি ঢুকলেন। সাদা পাথরের মেঝে, আধুনিক নির্মাণশৈলীর অন্দরসজ্জা। সুপরিসর কামরাগুলোর নির্মাণেও আছে নান্দনিকতা। কিন্তু চোখ যদি গিয়ে পড়ে দেয়ালে আর ছাদে, ভুল ভাঙতে সময় লাগবে না। ব্যবহার শুরুর মাত্র সাত মাসের মধ্যে একি হাল গ্রামীণফোন-বিসিবি একাডেমি ভবনের! স্যাঁতসেঁতে দেয়াল আর ছাদে শ্যাওলা পড়ে জায়গায় জায়গায় বিবর্ণ। সিড়ির গাঁয়ে হলুদ ছাপ একে দিয়েছে বৃষ্টির পানির স্রোত।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের নিজস্ব একাডেমি ভবনে কার্যক্রম শুরু করেছে গত ২৪ জানুয়ারি। কিন্তু সাত মাস না যেতেই ৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ২৪ হাজার বর্গফুটের ত্রিতল ভবনের শরীরে ফুটে উঠছে বার্ধক্যের জীর্ণতা। একটু বৃষ্টি হলেই ওপর, নিচ আর চারপাশ থেকে পানি ঢুকতে শুরু করে ভবনে। রান্নাঘরের মেঝে চুইয়ে পানি ওঠে, ওপর থেকে পানির স্রোত নামে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে। কার্নিশ নেই, তাই বৃষ্টির ঝাপটা বেশি হলে জানালা দিয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। কখনো কখনো সদর দরজা দিয়েও।
নিষ্কাশন-ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় গোসল করার সময় দোতলা-তিনতলার অনেক কক্ষের বাথরুমেও পানি জমে যায়! কক্ষগুলোর দেয়ালে দেয়ালে ড্যাম্প, শ্যাওলা ধরে খসে পড়তে শুরু করেছে রং। একজন আবাসিক কর্মকর্তা ছাড়া ভবনে কর্মচারী মাত্র তিনজন। পরিষ্কার করার লোক নেই বলে নোংরা হয়ে আছে সিঁড়ি-করিডর। সব দেখে মনেই হবে না এই ভবনের বয়স মাত্র সাত মাস, গ্রামীণফোনের পৃষ্ঠপোষণায় এর পেছনে বিসিবির খরচ হয়েছে প্রায় সাত কোটি টাকা!
অভিযোগ আছে, একাডেমির বিভিন্ন কক্ষের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র আর আসবাবপত্রও নিম্নমানের। অনেক ফিটিংসই বদলে ফেলতে হয়েছে এরই মধ্যে। ভবনে একাধিকবার থাকা এক খেলোয়াড় নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করলেন, ‘বেশির ভাগ এসিই ঠিকমতো কাজ করে না। বাথরুম ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে প্রায়ই। যারা এই ভবন বানিয়েছে, তারা ইচ্ছেমতো টাকা মেরেছে। বিসিবিকে একটা বিল্ডিং বুঝিয়ে দিতে হয় বলে, নইলে পুরো টাকাটাই মেরে দিত।’ আরেক ক্রিকেটারের ক্ষোভ, ‘বাইরে থেকে মনে হবে ফাইভ স্টার হোটেল। কিন্তু দুদিন থাকলেই বুঝবেন, এটা আসলে কী। চারদিক দিয়ে পানি ঢোকে। ফার্নিচারও সব দুই নাম্বার।’ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী নির্মাণের পর এক বছর পর্যন্ত যাবতীয় ত্রুটি সারানোর দায়িত্ব নির্মাণসংস্থার। তারা সেটা করছেও। দুশ্চিন্তাটা এক বছর পর কী হবে, তা নিয়েই।
মাত্র সাত মাসেই একাডেমি ভবনের এমন হাল কেন, সেটা খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ। বিসিবির গ্রাউন্ডস অ্যান্ড ফ্যাসিলিটিজ কমিটির প্রধান শফিকুর রহমান প্রথমে ‘নির্মাণকাজে প্রাথমিকভাবে এ রকম সমস্যা থাকেই’ বললেও পরে বলেছেন, ‘নির্মাণসংস্থার কাছ থেকে ১০ শতাংশ জামানত রাখা আছে। তা ছাড়া তাদের বিলও পুরোপুরি শোধ হয়নি, এখনো দুই কোটি টাকার মতো পায় আমাদের কাছে। তারা যদি সমস্যাগুলোর সমাধান না করে, তাহলে এই টাকা দিয়ে আমরাই সে কাজ করব।’
কিন্তু একাডেমি ভবন নির্মাণে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বসত আর্কিটেক্ট অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্সের প্রধান স্থপতি মাসুদুর রহমান খান বলেছেন, একাডেমি ভবনের যে এই হাল, সেটা নাকি তাঁরা জানেনই না, ‘আমরা যখন বিসিবিকে ভবন বুঝিয়ে দিই, তখন কিছু সমস্যার কথা বলা হয়েছিল। আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দেশ বিল্ডার্সকে সেসব ঠিক করে দিতে বলেছি। এত দিনে কাজগুলো তাদের করেও দেওয়ার কথা। না দিলে বিসিবির উচিত ছিল আমাদের জানানো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ রকম কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি।’
দেশ বিল্ডার্সের পরিচালক মোফাজ্জল হোসেনের দাবি, একাডেমি ভবন সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত, ‘ভবনে কোনো সমস্যা নেই। শুরুতে টুকটাক সমস্যা থাকলেও সেগুলো ঠিক করা হয়েছে। দেয়াল ড্যাম্প করার যে কথা বলা হচ্ছে, সেটা দেয়ালের ভেতরে থাকা কিছু পানির পাইপ লিক করার কারণে। পানি শুকিয়ে গেলে আমরা দেয়াল আবার রং করে দেব।’ কার্নিশ না থাকায় বিভিন্ন জায়গা দিয়ে ভবনে পানি ঢোকার ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য, ‘বসত আমাদের যে নকশা দিয়েছে, আমরা সে অনুযায়ীই কাজ করেছি। নকশায় কার্নিশ না থাকলে আমরা কেন কার্নিশ দেব?’
নিম্নমানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও আসবাবের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘বিসিবি আমাদের যে নমুনা দিয়েছে, আমরা সে অনুযায়ীই আসবাব দিয়েছি। এখন সেগুলো নিম্নমানের হলে দায় তো আমাদের নয়।’ দেশ বিল্ডার্স নির্মাণকাজ করলেও একাডেমি ভবনের নকশা করেছে বসত আর্কিটেক্ট অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স।
একাডেমি ভবন বিসিবিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝিয়ে দেওয়া নিয়েও আছে অস্পষ্টতা। বসতের দাবি, বিসিবি নাকি গত জানুয়ারি থেকে একরকম জোর করেই একাডেমি ভবন ব্যবহার শুরু করেছে। কাজ শেষ হয়নি বলে ভবন এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝিয়ে দেয়নি তারা। এ ছাড়া ঠিকাদারদের বিল ঠিকমতো পরিশোধ না করায়ও কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে। তবে বিসিবির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজামউদ্দিন চৌধুরী বলছেন, ‘জোর করে ভবন ব্যবহার করা হচ্ছে, কথাটা ঠিক নয়। দুই পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতেই গত জানুয়ারিতে ভবন বুঝে নেয় বিসিবি। তবে যেহেতু আমরা এখনো তাদের পুরো বিল পরিশোধ করিনি, কিছু আনুষ্ঠানিকতা তো বাকি আছেই। সব কাজ বুঝে নিয়েই বাকি বিল শোধ করা হবে।’
বিসিবিকে বসতের ভবন বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল ২০০৯ সালের এপ্রিলে, আর এখন ২০১০ সালের আগস্ট। ভবন যদি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝিয়ে না-ই দেওয়া হয়, তাহলে তো পুরোনো প্রশ্নটাই ওঠে—কবে বুঝিয়ে দেওয়া হবে সেটা? কবে শেষ হবে একাডেমি ভবনের কাজ?

No comments

Powered by Blogger.