যুদ্ধকালীন অপরাধের বিচার -বিএনপির অবস্থান পুনর্মূল্যায়নের দাবি রাখে

একাত্তরের যুদ্ধকালীন অপরাধের বিচারের প্রশ্নে বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের বক্তব্য আরও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করল। অথচ প্রত্যাশা ছিল, তিনি এ বিষয়ে তাঁর দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করবেন। কিন্তু প্রচলিত আইনে যুদ্ধকালীন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার চেয়ে বিএনপি আমাদের অবাক করল।
বিএনপিসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলেরই জানা যে ১৯৭৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনটি বাংলাদেশের সংবিধানে বিশেষভাবে রক্ষাকবচ দেওয়া আছে। সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদ বলেছে, এই আইন সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য বিবেচনায় কখনো বেআইনি বা বাতিল বলে গণ্য হবে না। সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ ও ১৯৭৩ সালের আইনটি কালের সাক্ষী। আমাদের সাংবিধানিক কাটাছেঁড়ার ইতিহাস পেরিয়ে এই আইন সত্যি কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। সে কারণে হাইকোর্টের মর্যাদাসম্পন্ন আমাদের নবগঠিত ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধকালীন খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ ইত্যাদি অপরাধসহ যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে সম্পূর্ণরূপে এখতিয়ারপ্রাপ্ত।
আমাদের বাদানুবাদপূর্ণ রাজনীতির কোনো পর্বেই ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে বলে জানা যায় না। প্রচলিত আইনে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার করা সম্ভব—এমন কথা এর আগে কখনো শোনা যায়নি। মনে রাখা দরকার, রোম সংবিধি ও আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত প্রবর্তন-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশ যুদ্ধকালীন সময়ে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধসহ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের শর্তাদি নির্ধারণে রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকার স্বীকৃত। বিশ্বের অন্য যেসব দেশ যুদ্ধকালীন অপরাধের বিচার করেছে, তারা বিশেষ আইন বা ট্রাইব্যুনালের আওতায় করেছে। কতিপয় দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো, বিশেষ করে বিচার বিভাগের অবস্থা এতটাই নাজুক যে তারা জাতিসংঘের সহযোগিতা নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা এতটা শক্তিশালী রয়েছে যে তারা নিজেরাই ট্রাইব্যুনাল করে বিচার সম্পন্ন করতে পারে। যথেষ্ট বিলম্বে হলেও সম্প্রতি সে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারে তাঁদের আপত্তি নেই। কিন্তু নবগঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করুক তা তাঁরা সমর্থন করেন না। বিএনপি নেতার বক্তব্যে এটুকুও পরিষ্কার হয়নি যে তাঁরা যুদ্ধাপরাধের বিচার চান। সরকার বিচার না করলে তাঁরা যে আদৌ মনঃক্ষুণ্ন হবেন, এমন কিছুরও ইঙ্গিত মেলে না। বিএনপি নেতা ২ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি স্পষ্ট করেন এভাবে: ‘প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এখন তো যুদ্ধাপরাধী নেই।’
১৯৭৩ সালের আইনটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। উপরন্তু যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা আইনে দেওয়া আছে। এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনের বিকাশের আলোকে দেখাই সংগত। তবে বিএনপি যদি আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের স্বাভাবিক আশঙ্কা ব্যক্ত করে, তা বোধগম্য। সেখানে হয়তো আমাদেরও অভিন্ন উদ্বেগ থাকবে। কিন্তু বিএনপির মহাসচিব যা বলেছেন, তা মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের নীতিগত অবস্থান হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।

No comments

Powered by Blogger.