আত্মহননের পথে ওরা!

নেহা সাওয়ান্তদের বাড়িতে এখন পিনপতন নীরবতা। ছোট্ট ফ্ল্যাটটিতে জীবনের কোনো ছোঁয়া নেই। অথচ কিছুদিন আগেও ১১ বছরের মেয়েটি হইচই করে সারা বাড়ি জমিয়ে রাখত। মাতিয়ে রাখত সবাইকে হাসি-খেলায়। তার অভাব এখন পুরো বাড়িতে। মেয়েটিকে একদিন তাদের বাড়ির জানালায় মৃত অবস্থায় ঝুলে থাকতে দেখা যায়। নেহা সাওয়ান্ত ছিল একজন টিভি তারকা। সনি টেলিভিশনের বগি-উগিসহ তিনটি চ্যানেলে নাচের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল সে।
মা-বাবার বকাঝকা, পরীক্ষায় ভালো ফল করতে না পারা, নাকি বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ঝগড়া? কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিল ১১ বছরের নেহা? তার পরিবার এখন খুঁজে ফিরছে এসব প্রশ্নের উত্তর। নেহার মা-বাবার জীবনে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া। তার দাদি এখনো ঘটনাটি বিশ্বাস করতেই পারছেন না। শুধু নেহা নয়, ভারতের বড় শহরগুলোতে অনেক কিশোর-কিশোরীই বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। গত ৫ জানুয়ারি মুম্বাইয়ের একটি বিদ্যালয়ের শৌচাগারে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে ১২ বছরের কিশোর সুশান্ত পাতিল। কেন, কী কারণে তারা জীবন থেকে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তা বুঝে উঠতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকেরা।
বিশেষ করে মহারাষ্ট্র ও এর রাজধানী মুম্বাইয়ে এটি নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত জানুয়ারি মাসের প্রথম ২৬ দিনেই ৩২ জন কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যা করে এই রাজ্যে। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার এ প্রবণতা দেখে উদ্বিগ্ন মনোবিদ ও শিক্ষকেরা। তাঁদের অনেকেই মনে করছেন, যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য মা-বাবারা ছেলেমেয়েদের অনেক বেশি চাপের মুখে রাখছেন। আর এই অতিরিক্ত মানসিক চাপ সামলাতে না পেরেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে কিশোর-কিশোরীরা।
বিবিসির এক জরিপে দেখা গেছে, ভারতে প্রতিবছর এক লাখ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে কেবল মুম্বাইয়েই দিনে গড়ে তিনজন আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরাই আত্মহত্যা করছে বেশি।
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের সহকারী মহাপরিচালক ক্যাথরিন ল গলস-কামু বলেন, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও আবেগতাড়িত হয়েই মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। আত্মহত্যার প্রবণতা কমিয়ে মানুষকে জীবনমুখী করতে মুম্বাই নগরের কর্মকর্তারা এরই মধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। মুম্বাইয়ের সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকেরা চেষ্টা করছেন ছাত্রছাত্রীদের জীবনমুখী করে তুলতে। কোমলমতি কিশোর-কিশোরীদের অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ না দিতে অভিভাবকদের পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা। এমনকি শচীন টেন্ডুলকার বা বিনোদ কাম্বলিদের মতো ক্রিকেট তারকারা বিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের উজ্জীবিত করছেন।
তবে এত চেষ্টা ও উদ্যোগের পরও শেষরক্ষা হচ্ছে না। ভারতে একের পর এক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেই চলেছে। মুম্বাইয়ের আস্রা নামের একটি হেল্পলাইন অনেক দিন ধরেই কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে কাজ করছে। হেল্পলাইনটির পরিচালক জনসন থমাস বলেন, বন্ধুদের চাপ, মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগের অভাব, সম্পর্কের ভাঙন, পড়াশোনার চাপ ও ব্যর্থ হওয়ার ভীতির কারণেই বেশির ভাগ শিশু-কিশোর আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। এ ধরনের বাস্তবতারই প্রতিফলন ঘটেছে ভারতে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত থ্রি ইডিয়টস চলচ্চিত্রে। জোর করে প্রকৌশলবিদ্যা পড়ানোর কারণে সেখানে এক কিশোরকে হতাশায় আত্মহত্যা করতে দেখা গেছে। অনেকেই অভিযোগ করেন, চলচ্চিত্রটি কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যার প্রবণতাকে আরও উসকে দিয়েছে। তবে মুম্বাইয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রিয়া টিমবেকার কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করে এ অভিযোগ উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, এই চলচ্চিত্র থেকে মা-বাবাদের শেখা উচিত যে সন্তানদের ওপর বেশি চাপ দেওয়া উচিত নয়। রিয়া এ রকম প্রচণ্ড চাপের একটি উদাহরণও দেন। পরীক্ষায় প্রথম স্থান না পেয়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করায় এক শিশুকে চার দিন না খাইয়ে রেখেছিল তার মা-বাবা। এ ধরনের মা-বাবার রীতিমতো মানসিক চিকিত্সা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। মা-বাবাকে বুঝতে হবে, আজকের কিশোর-কিশোরীরা অনেক বেশি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তারা অনেক বেশি সচেতন ও বহির্মুখী। এখন ১১ বছরের কিশোর-কিশোরীরাই অতীতের ১৪-১৫ বছরের কিশোর-কিশোরীদের মতো পরিণত মানসিকতার অধিকারী। আর এই পরিণত মানসিকতাকে সম্মান দিয়েই ছেলেমেয়েদের বড় করে তোলা প্রত্যেক মা-বাবার দায়িত্ব।
মনোরোগ চিকিত্সক রিয়া আরও বলেন, কোনো শিশুই সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে অকারণে হঠাত্ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় না। জীবনের শুরুতেই তারা কোনো না কোনো অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার শিকার হয়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে।
ভারতের সনাতনী পরিবারগুলোর ভাঙনকেও অনেকে এ সমস্যার জন্য দায়ী করছেন। মুম্বাইয়ের মতো নগরে, যেখানে সাধারণত মা ও বাবা দুজনেই কাজ করেন, সেখানে সন্তানেরা একাকিত্বে ভোগে আর খুব বেশি টেলিভিশন দেখে সময় কাটায়।
মা-বাবা যদি শর্তহীনভাবে তাদের সব ধরনের ব্যর্থতা ও সাফল্য মেনে নিয়ে সন্তানদের ভালোবাসেন, তবে এ সমস্যা অনেকখানি কমে যাবে বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানী দিলীপ পানিকার।

No comments

Powered by Blogger.