বাড়বে কন্যা নিরাপদে -চারদিক by তৌহিদা শিরোপা |

১. ‘বেটা হইলে নেইস, বুড়াকালে তোকে দেইখবে। বেটির মায়া করিস না।’ সন্তান জন্মের আগে স্ত্রী লক্ষ্মীকে এ কথাই বলেছিলেন গজেন। কিন্তু বিধি বাম। আবারও কন্যাসন্তানের জন্ম। বৈশাখী নামের চার মাসের শিশুটির জীবনে তাই নেমে এল ঘোর অমানিশা। তার অন্য দুই বোনের মতো তাকেও বিক্রি করে দেওয়া হলো। একটি শাড়ি ও চারশো টাকার বিনিময়ে । অপরাধ—তারা কন্যাশিশু। (৯ সেপ্টেম্বর, প্রথম আলো) এ চিত্র তো হতদরিদ্র, অশিক্ষিত এক পরিবারের।
কিন্তু উচ্চশিক্ষিত অনেক পরিবারেও এমনটা দেখা যায়। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত না হলেও অজ্ঞ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন তারা। শম্পার পরিবারের কথাই ধরা যাক। বাবা উচ্চপদের সরকারি কর্মকর্তা। পর পর দুই সন্তানই মেয়ে হওয়ায় ভেবেছিলেন তৃতীয়টি হয়তো ছেলে হবে। কিন্তু শম্পার জন্মের পর বাড়ির দৃশ্যপট বদলে গেল। কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে ওর মা প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত হচ্ছেন। শম্পার অন্য দুই বোনের জীবনে নেমে এল কালো ছায়া। ওদের বাবা সারাক্ষণ কটূক্তি করেন। অবজ্ঞা আর অবহেলায় দিন কাটছে। এ বাড়িতে শম্পা যেন ভিনগ্রহের প্রাণী। সাত বছরের শম্পা জানে না, বাবার সঙ্গে কথা বলতে কেমন লাগে। তবে বুঝতে পারে, বাবা ওকে পছন্দ করে না। সে জন্যই হয়তো ওর সঙ্গে কথা বলে না। বাবার স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে। অদৃশ্য দোষে শম্পা নিজেকেই যেন দায়ী করে। ভাবে, ইস, যদি ছেলে হতাম, তবে বাবা কতই না ভালোবাসত!
সেদিক থেকে অনু নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। ওর পরিবারে ছেলেমেয়েতে ভেদাভেদ নেই। বৈষম্যের শিকার হতে হয়নি ওদের দুই বোনকে। বরং অনেক ক্ষেত্রেই ছেলেদের চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে ওর মা-বাবা। অনুর বাবা বলেন, ‘মেয়েরাই আমার সব। ওদের ঠিকভাবে মানুষ করতে পারাটাই আসল কথা। ছেলে হলেই যে ভালো হবে, মা-বাবাকে দেখভাল করবে, এমনটা নয়। ওদের কখনো বুঝতে দেইনি ছেলেমেয়ের ভেদাভেদ। মানুষ হিসেবে যেন তারা নিজেকে তৈরি করতে পারে, সে চেষ্টাই সব সময় করেছি।’
এমন বোধগম্যতা, বিচারবুদ্ধি আমাদের অনেকেরই নেই। যে কারণে প্রতিদিনই ঘটে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা। এমনটা কাম্য নয়। মেয়েকে মেয়ে হিসেবে না দেখে শুধু সন্তান হিসেবে বিবেচনা করুন। তাহলে ছেলে না হওয়ার কষ্টটা দূর হয়ে যাবে। কন্যাসন্তানটিকেই সঠিক মূল্যবোধ দিয়ে শিক্ষিত করে তুলুন, দেখবেন, ছেলের চেয়ে কোনো অংশেই সে কম নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রেই সে-ই আপনার পরম নির্ভরশীলতার জায়গা।
২. জাতীয় কন্যাশিশু দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় - ‘বাড়বে কন্যা নিরাপদে, আনন্দঘন পরিবেশে’। শিশুসপ্তাহের দ্বিতীয় দিন ‘জাতীয় কন্যাশিশু দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০০০ সালে এটি কার্যকর করে। ৫ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া শিশু সপ্তাহজুড়ে রয়েছে নানা আয়োজন।
৩. কখনো কি ভেবেছেন, আপনার মেয়েটি সঠিক পরিবেশে বেড়ে উঠছে কিংবা তার প্রাপ্য নিরাপত্তাটুকু তাকে দিতে পেরেছেন?। সময়ের অভাবে, অজ্ঞতার কারণে মা-বাবারা তা জানেন না। আমরা সন্তানের কাছে প্রত্যাশা করি অনেক। কিন্তু তার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারি না। সঠিক পরিবেশ পেলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবে তারা। সমাজের প্রায় সব ক্ষেত্রে মেয়েরা তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করছে। পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করছে। তারাও কারও মা, কারও বোন, কারও মেয়ে। আপনার মেয়েকে উত্সাহিত করুন। দেখা যাবে, সে-ই আপনার মুখ উজ্জ্বল করছে। মেয়ে বলে হেয় করা উচিত নয়। বরং ঘরে-বাইরে তার জন্য সুশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করুন। এর জন্য প্রত্যেককেই এগিয়ে আসতে হবে, যাতে কোনো মেয়েই নিরাপত্তাহীনতার না ভোগে। অনেক সময় কাছের মানুষের দ্বারা কিশোর মেয়েটি শারীরিকভাবে নিপীড়িত হয়। তাই মা-বাবাকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সন্তানের সঙ্গে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক তৈরি করুন। যেকোনো সমস্যার কথা সে যেন আপনাকে বলতে পারে। আনন্দময় ও নিরাপদ পরিবেশে কন্যাসন্তানটি যেন বেড়ে উঠতে পারে, সে জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। অন্যের জন্য পরিবেশ তৈরি করে দিলে, তা একদিন নিজেরই কাজে লাগবে। বিশেষ দিনে, বিশেষ সপ্তাহে নয়, সারা বছরই আমাদের কাজে-কর্মে এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। সঙ্গে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

No comments

Powered by Blogger.