পাকিস্তানে আধুনিক দাসপ্রথা

শাহ মোহাম্মদ প্রতি রাতে স্বপ্ন দেখেন, ঋণ শোধ করে মালিকের কাছ থেকে মুক্তি পেয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। মুক্তির স্বপ্ন ধরা দেয় না তাঁকে। দিন কেটে যায় তাঁর ঋণের বেড়াজালে।
মোহাম্মদের বয়স ৬৮ বছর। পাকিস্তানের হাজারো চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের একজন। অনেক বড় একটি পরিবারে ভরণপোষণের দায়িত্ব তাঁর ঘাড়ে। পাঞ্জাবের ধূলিধূসর একটি ইটের কারখানা। মাথায় আগুন ঢালছে সুর্য। ঘেমে-নেয়ে একাকার। কোনো ফুরসত নেই। কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু এত মেহনত করেও খাবার, ওষুধ ও পরিবারের বাকি খরচের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।
মোহাম্মদ বলেন, ‘সূর্যোদয়ের আগেই কাজ শুরু হয়ে যায় আমার, চলে সূর্যাস্ত পর্যন্ত; এরপর অপেক্ষা পরের দিনের জন্য—ইট তৈরির।’ দুই বছর আগে এক ইটভাটার মালিকের কাছ থেকে দুই লাখ রুপি নিয়েছিলেন তিনি।
পাকিস্তানের কয়েক লাখ চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের একজন মোহাম্মদ। কঠোর শর্তে ভূস্বামীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন তাঁরা। বিনিময়ে নামমাত্র বেতনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভূস্বামীদের কাজ করতে হয়।
মানবসন্তানকে এখানে পণ্যের মতো ব্যবহার করা হয়। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিককে অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দিতে পারেন তাঁর মালিক। এ পদ্ধতিকে আধুনিক যুগের দাসপ্রথা হিসেবে অভিহিত করেছেন পাকিস্তানের মানবাধিকার কর্মীরা।
হাড্ডিসার দেহ অনাবৃত, কোমরে পেঁচানো এক টুকরো কাপড়। এ অবস্থায় দ্রুত একমনে ইট তৈরি করে যাচ্ছেন মোহাম্মদ। কাদামাটি লেপ্টানো শরীরে হাড়ের রেখা সুস্পষ্ট। কিন্তু হাড্ডিসার শরীরে তাঁকে কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হচ্ছে।
মোহাম্মদ জানান, ঋণের প্রাথমিক শর্ত অনুযায়ী প্রতি হাজার ইট তৈরির জন্য তাঁকে ৪৫০ রুপি করে দেওয়ার কথা। কিন্তু প্রাথমিক চুক্তি থেকে সরে যান তাঁর মালিক। এখন তাঁকে প্রতি হাজার ইটের জন্য দেওয়া হচ্ছে ৩৫০ রুপি। ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়া ঋণের ভার কমাতে গিয়ে আয় থেকে উধাও হয় ১০০ রুপি। চিকিত্সা খরচ, পরিবারের সদস্যদের বিয়ে ও শেষকৃত্যের ব্যয়ভার মেটাতে গিয়ে তাঁকে আরও ঋণ নিতে হয়েছে।
মোহাম্মদ বলেন, ‘কাজ, কাজ এবং কাজ—এটাই আমার জীবন। আমি মারা গেলে ঋণ শোধের জন্য আমার সন্তানদেরও আজীবন কাজ করে যেতে হবে।’
ঋণচুক্তির ফাঁদে আটকে যায় ঋণ গ্রহীতার পুরো পরিবার। পরিবারের নারী-পুরুষেরা কাদামাটি থেকে তৈরি করে ইট। আর জিনিসপত্র এগিয়ে দেয় শিশুরা।
শ্রমিকদের সহায়তায় কাজ করে বন্ডেড লেবারার লিবারেশন ফ্রন্ট পাকিস্তান (বিএলএলএফপি) নামের একটি সংগঠন। সংগঠনের এক জরিপে দেখা গেছে, অবৈধ এ প্রথার শিকার আনুমানিক ৪৫ লাখ শ্রমিক।
এ বিষয়ে সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে গবেষকেরা বলছেন, পাকিস্তানে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ।
চুক্তিবদ্ধ শ্রমপ্রথা নিষিদ্ধ করে ১৯৯২ সালে একটি আইন পাস করে পাকিস্তান সরকার। তবে এ আইনের প্রতি সম্মান দেখানোর লক্ষণ সামান্যই। পাকিস্তানের সামন্তবাদী গ্রামাঞ্চলে ভূস্বামীরা বিপুল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা উপভোগ করেন।
বিএলএলএফপির চেয়ারপারসন সৈয়দা গুলাম ফাতিমা বলেন, কোনো ইটভাটার মালিক চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক নিয়োগ করলে তাঁকে দুই বছরের কারাদণ্ড কিংবা ৫০ হাজার রুপি জরিমানা দিতে হবে। কিন্তু কোনো আইনভঙ্গকারীর ওপর কখনই এ আইন প্রয়োগ করা হয়নি। সরকার বলেছে, আইনটি পর্যালোচনা করে দেখা হবে।
মানবাধিকার কর্মী ও পুলিশের সহায়তায় বেশ কয়েকজন চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক পালাতে সক্ষম হয়েছেন। দক্ষিণাঞ্চলীয় সিন্ু্ল প্রদেশের একটি জায়গায় বসবাস করছে এ রকম একদল মুক্ত শ্রমিক। জায়গাটি হিম্মতাবাদ নামে পরিচিত। হিম্মতাবাদের অর্থ সাহসের শহর।
এক সময় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক ছিলেন লালি। তিনি এখন মানবাধিকার কর্মী। লালি বলেন, ‘আমরা এ জায়গার নাম দিয়েছি হিম্মতাবাদ। কারণ, প্রভাবশালী কোনো ভূস্বামী থেকে নিজেকে মুক্ত করতে অনেক সাহসের প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেন, নতুন জীবন শুরু করা অনেক বিশাল কাজ।
১৯৮৭ সালে ভূস্বামীর কবল থেকে পালিয়েছিলেন লালি। তখন তাঁর বয়স ছিল ২৪ বছর। এরপর থেকে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.