সোনার পালঙ্ক নয় সোনার নৌকা -বাঘা তেঁতুল by সৈয়দ আবুল মকসুদ

হাততালি আর ঘুষ আদান-প্রদানের পদ্ধতি একই রকম। এক হাতে কপাল ও বুক চাপড়ানো যায়, কিন্তু তালি বাজে না। ঘুষও এক পক্ষের ব্যাপার নয়: এর জন্য একজন দাতা আর একজন গ্রহীতা দরকার। দুইয়ে দুইয়ে মিলে গেলে ঘুষকার্য সুচারুরূপে সম্পন্ন হতে পারে।
ইংরেজরা আসার আগে চুরি-ডাকাতি থাকলেও এ দেশে ঘুষ জিনিসটি ছিল না। মুঘল আমলে যে প্রশাসনিক পদ্ধতি ছিল তাতে ঘুষ আদান-প্রদানের প্রয়োজন হতো না। পলাশীর যুদ্ধে অবৈধভাবে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জেতার জন্য কোম্পানির কর্তারা পরীক্ষামূলকভাবে ম্যাক্রো ঘুষ চালু করেন। কারণ তত দিনে এ দেশের মানুষের চরিত্র ইংরেজরা টের পেয়ে গিয়েছিল। তারপর পলাশীতে নবাবকে পরাজিত ও হত্যা করার পর থেকে মাইক্রো লেভেলে ঘুষ শুরু হয়ে যায়।
আরও পরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে যখন ইংরেজি শিক্ষিত মানুষ তৈরি হওয়া শুরু হয় তখন ঘুষপ্রথারও বিকেন্দ্রীকরণ শুরু হয়। একপর্যায়ে তা পৌঁছে যায় ক্ষুদ্রঋণের মতো মাইক্রো বা তৃণমূল পর্যায়ে। অনেককাল থেকেই ঘুষ বাঙালির জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ঘুষ দেওয়ার জন্য বাঙালির অন্তর আঁকুবাঁকু করে। দাতার হাত থেকে ঘুষ নেওয়ায় মধ্যে আছে এক ধরনের অহংকার। অন্যদিকে ঘুষ দেওয়ার মধ্যে আছে এক ধরনের গভীর তৃপ্তি। সেই পরম তৃপ্তি থেকে খুব কম বাঙালিই বঞ্চিত হতে চায়। শুধু সে থাকে সুযোগটির অপেক্ষায়। সে সুযোগ আসা মাত্র সে তার সদ্ব্যবহার করে।
ক্ষমতাবানকে অযাচিতভাবে উপহার বা উপঢৌকন দেওয়াও এক ধরনের ঘুষ—ঘুষের এক মার্জিত ও নির্দোষ সংস্করণ। ঘুষ-সংস্কৃতির এই নির্মল সংস্করণটি আগাগোড়াই ছিল। যেকোনো ধরনের ঘুষ দেওয়ার মধ্যে একটি আর্ট আছে। যেমন নিজের ছোট পুকুরে ১০ ইঞ্চির বেশি কাতলার পোনা নেই। সেটা কোনো সমস্যা নয়। বাজার থেকে ১০ কেজি ওজনের রুই কিনে বড় সাহেবের বাড়িতে পাঠানোতে সমস্যা কী? শুধু হাত কচলে বড় সাহবেকে বললেই হলো, ‘সকালবেলা জাল ফেইলা চাকর মাছটা ধরল। আমার ওয়াইভ কইল, স্যারেরে দিয়া আইস।’ নিজেকে একেবারে নির্দোষ প্রমাণের জন্য গিন্নিকেও পার্শ্বচরিত্রে এনে দাঁড় করাতে শুধু বাঙালিই পারে।
উপঢৌকন দেওয়ারও একটি উপলক্ষ দরকার। ধামরাইয়ে একটি পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে গিয়ে সোনার নৌকা উপহার নিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক ও সরকারদলীয় স্থানীয় সাংসদ বেনজীর আহমদ। প্রতিমন্ত্রীকে ১০ ভরি এবং সাংসদকে এক ভরি সাত আনা ওজনের সোনার নৌকা উপহার দেওয়া হলে তাঁরা তা নেন। [বিডি নিউজ/সমকাল]।
খবরে আরও বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রতিমন্ত্রীর হাতে সোনার নৌকা তুলে দিলে প্রতিমন্ত্রী তা গ্রহণ করে ব্যক্তিগত কর্মকর্তার কাছে দেন। সাংসদের সঙ্গে ছিলেন তাঁর অধ্যক্ষা স্ত্রী। গৃহকর্তার ছেলে সাংসদের হাতে সোনার নৌকাটি তুলে দেন। তিনি সেটা কার হাতে তুলে দেন, তা জানা যায়নি। তবে পাশেই ছিলেন তাঁর সহধর্মিণী।
উপঢৌকনদাতা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার বাড়ির পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে মন্ত্রী এসেছেন, এ আমার সৌভাগ্য। তাই খুশি হয়েই মন্ত্রী ও সাংসদকে সোনার নৌকা উপহার দিয়েছি।’ এই উপহার নিভৃতে গোপনে দেওয়া হয়নি। ‘মাইকে ঘোষণা দিয়ে এ সোনার নৌকা উপহার দেওয়া হয়।’ ১০ ভরি সোনার দাম আড়াই লাখ টাকার কম নয়। মজুরিসহ নৌকা নির্মাণে লাখ তিনেক টাকা পড়েছে। সাংসদের পেছনে গেছে ৭০-৮০ হাজার টাকা। প্রতিমন্ত্রী-সাংসদকে খুশি করতে এবং নিজে খুশি হতে পৌনে চার লাখ টাকা খরচা বেশি কিছু নয়।
আমাদের মতো সন্দেহপ্রবণ ও পরশ্রীকাতর মানুষের মনে যে প্রশ্ন জাগতে পারে তা হলো: উপহারদাতার বাড়িতে প্রতিমন্ত্রী-সাংসদ যাবেনই এর কি কোনো নিশ্চয়তা ছিল? গৃহকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, ঢাকা থেকে অর্ডার দিয়ে সোনারুকে দিয়ে নৌকা বানাতে কয়েক দিন সময় লেগেছে। যদি মাননীয়রা তাঁর বাড়িতে না যেতেন তিনি ওই নৌকা দুটি কী করতেন? যে বাড়িতে সোনার নৌকা তৈরি হলো ঠিক সেই বাড়ির পূজামণ্ডপ দেখতেই ক্ষমতাসীনরা গেলেন। সবকিছু কেমন যেন খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে।
অতি ওপরের দিকে কী হয় না-হয় তা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কর্তারা জানেন। মাইক্রো পর্যায়ে আজকাল ঈদে ও অন্যান্য পার্বণের আগে অনেকেই স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের জন্য কাপড়চোপড় কেনার আগে ওসি, ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, ডিসি, এসপি, বিভিন্ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ও তাঁদের স্ত্রীদের জন্য শার্ট-পাঞ্জাবি ও শাড়ি-গয়না কেনে। টেন্ডার পাওয়ার ব্যাপার আছে, ঠিকাদারির বিল পাসের প্রশ্ন আছে, অর্পিত সম্পত্তি বরাদ্দ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, দুই বছর আগে নিজের প্রতিষ্ঠিত এক ছাত্রীবিহীন কলেজের ছাত্রসংসদের ভিপি নিজের সন্ত্রাসী ছেলেটির ফেঁসে যাওয়ার ব্যাপার আছে। সুতরাং ঈদ ও পূজার আগে কর্তাদের খুশি করতেই হয়। এসব ঘুষ, না উপহার! উেকাচ ও উপঢৌকন একটি সেক্যুলার ব্যাপার।
রূপকথার যুগে নায়ক-নায়িকারা ঘুমাত সোনার পালঙ্কে। আজ গণতন্ত্রের যুগ। এখনকার প্রভুরা চড়বেন সোনার নৌকায়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.