বাংলাদেশের পাটসুতা এখন আন্তর্জাতিক ফ্যাশন বাজারে by হানিফ মাহমুদ

দড়ি, কার্পেট, বস্তা এগুলোর বাইরে পাট যে উপকারে লাগতে পারে, এ কথা এক দশক আগেও কারও মুখে শোনা যেত না। সনাতনি এসব পাটপণ্য আশি ও নব্বইয়ের দশকে আন্তর্জাতিক বাজারে সিনথেটিকের সঙ্গে টিকতে পারছিল না। তখন প্রাকৃতিক এ তন্তুটি অস্তিত্বের সংকটে পড়েছিল।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রাকৃতিক এই তন্তুটি এখন ফ্যাশন, বিলাস ও স্বস্তিদায়ক সব পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হতে শুরু করেছে। আর এই বাজারে প্রবেশ করছে বাংলাদেশের পাট বিশেষত, পাটসুতা।
বাংলাদেশের সরকারি পাটকলগুলো এখনো পাটের সনাতনধর্মী পণ্য দড়ি ও বস্তা তৈরি করলেও বেসরকারি খাতের একদল উদ্যোক্তা আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের সুতার যে চাহিদা তৈরি হয়েছে, সেই বাজার ধরে ফেলেছেন। তাঁদের কারখানায় তৈরি পাটসুতা এখন রপ্তানি হচ্ছে তুরস্ক, সিরিয়া, চীন, ভারত, উজবেকিস্তান ও ইউরোপে।
দেশের অভ্যন্তরে ইতিমধ্যেই পাটসুতা ব্যবহার করে শাল বা চাদর তৈরি করা হচ্ছে। তবে পোশাক তৈরি সেভাবে শুরু হয়নি।
কিন্তু ভারতে এবং ইউরোপ-আমেরিকায় পাটসুতা ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের পোশাক। এ জন্যই বাড়ছে পাটসুতার চাহিদা।
পাটের তৈরি ফ্যাশনেবল পণ্যে সরু সুতার দরকার হয়। যেসব মিল উত্পাদকদের চাহিদা মেটাতে এখন সরু পাটসুতা তৈরি করছে, তাদের তালিকায় আছে আব্দুল মালেক জুট মিল, জনতা জুট মিল, সোনালী আঁশ জুট মিল, পূবালী জুট মিল প্রমুখ। দেশের বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা মোতাবেক এসব কারখানা উন্নতমানের পাটসুতা সরবরাহ করছে বলে বিজেএসএ সূত্রে জানা গেছে।
বহুমুখী বিচিত্র ব্যবহার: আমেরিকা, জাপান ও ইউরোপের বিখ্যাত মোটরগাড়ি নির্মাতারা গাড়িকে আরও পরিবেশবান্ধব করার জন্য পরীক্ষামূলকভাবে গাড়ির আসন ও ম্যাটে পাটের তন্তু ব্যবহার শুরু করেছে। গাড়ির এসব আনুষঙ্গিক সামগ্রীর কাজ চলে প্রধানত, সিনথেটিক দিয়েই।
উন্নত বিশ্বে সব সময় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) পরিবেশে গাড়ি চালানো হয়। দীর্ঘ সময় এসি চালানোর ফলে গাড়ির ভেতরে যে গ্যাস নির্গমন হয়, তা কমাতে কিছু গাড়ির ভেতরে পাটের ব্যবহার করা হচ্ছে।
আবার তুলা ও পাটের সুতা মিলিয়ে তৈরি কাপড় অধিক স্বস্তিদায়ক। পাটের তন্তুর সঙ্গে পলিয়েস্টার, অ্যাক্রেলিক ও রেয়নের মিশ্রণে তৈরি হতে পারে উন্নতমানের কাপড়। পাটের সুতার জ্যাকেট ও প্যান্ট ইতিমধ্যেই ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
আমেরিকায় কাঠের বাড়ির দেয়ালে পাটের ছালা সেঁটে দিয়ে অধিক শীত ও গরম থেকে বাড়ির ভেতরের পরিবেশকে স্বস্তিদায়ক করা হচ্ছে।
এভাবে পাটের তন্তু ও পণ্য ব্যবহারের নতুনত্ব আসায় পাট আবার হারানো গৌরব ফিরে পেতে শুরু করেছে। জাতিসংঘ ২০০৯ সালকে প্রাকৃতিক তন্তুর বছর হিসেবে ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশের চিত্র: বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, বিগত পাঁচ বছরে তাদের সমিতির অধীনে মিল মালিকদের রপ্তানি দ্বিগুণ হয়েছে। এরাই মূলত বাংলাদেশ থেকে পাটের সুতা রপ্তানি করে থাকে। সংগঠনের সদস্যদের অধীনে ৫০টিরও অধিক মিল বর্তমানে সচল।
সংগঠনটির সূত্র অনুসারে, ২০০৩-০৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে পাটের সুতা রপ্তানি হয়েছে ১০ কোটি ৬৯ লাখ ডলার, যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ২৩ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।
জার্মানির হামবুর্গ শহরে ডব্লিউজিসি নামের একটি সংস্থা সারা বিশ্বের প্রাকৃতিক তন্তুর যাবতীয় বাজারের মাসিক তথ্য জোগাড় ও সংরক্ষণ করে থাকে।
পাট-সম্পর্কিত তাদের ২০০৯ সালের আগস্ট মাসের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে যারা ভালো পাটসুতা তৈরি করে, তাদের সিংহভাগ কারখানারই পর্যাপ্ত কাজ আছে এবং তাদের পক্ষে নতুন করে আর কোনো কার্যাদেশ নেওয়া সম্ভব নয়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহমেদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে পাটের সুতা দিয়ে বহুমুখী পণ্য তৈরি হচ্ছে। মেয়েদের শাড়ির পাড় থেকে শুরু করে পাঁচতারা হোটেলের সংবাদপত্র রাখার ব্যাগ, ঘরের জানালার পর্দার কাপড়, সোফার কুশন কভার—এ সবকিছুতেই পাটের সুতা ব্যবহূত হচ্ছে
আহমেদ হোসেন অবশ্য এও বলেন, এটি দেশের মোট সুতা রপ্তানি বা দেশীয়ভাবে যে ব্যবহার, তার তুলনায় তেমন কিছু না। তবে বাংলাদেশে যারা সরু পাট সুতা তৈরি করে, তারা প্রত্যেকেই মনে করছে একটা ভালো যাত্রা শুরু হয়েছে।
এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) পাট নিয়ে তাদের সমীক্ষায় বলেছে, সরকারের আর নতুন করে পাটকল বন্ধ করা উচিত হবে না। মিল কলকারখানাগুলো চালু রেখেই এগুলোকে সংস্কার, যন্ত্রপাতি নবায়ন ও জনবলকে যৌক্তিক করতে হবে। সরকারকে সামনে থেকে বেসরকারি খাতকে বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। পাটশিল্পের উদ্যোক্তাদেরও নতুন নতুন পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে হবে। শুধু সনাতন পণ্য নয়, নতুন চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন নতুন পণ্য তৈরি করতে হবে।
বেসরকারি উদ্যোক্তাসহ সমাজের বিভিন্ন মহলের দাবিকে স্বাগত জানিয়ে সরকার গত মে মাসে ২২ সদস্যের একটি পাট কমিশন গঠন করেছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি কাজী খলীকুজ্জমান আহমদকে এই কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয়েছে।
কমিশন পাট ও পাটপণ্যের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চফলনশীল পাটবীজ উত্পাদন ও সংগ্রহ; সরকারি ও বেসরকারি পাটকলগুলোর বিদ্যমান সমস্যা নিরসন এবং পাটের নতুন বাজার সৃষ্টি ও বিদ্যমান বাজারকে ধরে রাখার বিষয়ে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে।
পাশাপাশি দেশে ও বিদেশে পাটের মেলা, বহুমুখী পাটপণ্যের উত্কর্ষ সাধনের জন্য গবেষণা ও উন্নয়ন, পাট খাতের প্রণোদনার জন্য শুল্ককাঠামো নিরূপণে সরকারকে সহায়তা দেওয়ারও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কমিশনকে।

No comments

Powered by Blogger.