শ্রদ্ধাঞ্জলি ‘আসি বলে চলে গেল...’ মুস্তাফা জামান আব্বাসী

ভাটিবাংলার বাউল সাধক শাহ আবদুল করিম গতকাল সকালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মন ছুটে গেল সুদূর অতীতে যেখানে কবির আপন বাসভূমে সেই উজানধলের কালনীর স্রোতের সামনে দেখেছিলাম তাঁকে তাঁর যুবা বয়সে। দীর্ঘাঙ্গে যেন প্রস্তুত দারিদ্র্য-বঞ্চনায় সিক্ত একটি চাবুকের মতো উপস্থাপনা, বাঙ্ময় চোখ দুটি যেন মুহূর্তে সামনে এনে দেয় তাঁর লোকাচার, স্মৃতি, তীরবর্তী জনজীবনের হতাশা ও দুঃখ। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘সত্যি, আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। কোথায় আপনাকে বসতে দিই?’
বললাম: রোটারির গভর্নর হিসেবে দিরাই এসেছি, দীর্ঘ জলপথ অতিক্রম করে ‘অফিশিয়াল ভিজিটে। আসল আকর্ষণ আমার: ‘কালনীর স্রোতের’ কবি আবদুল করিম দর্শন।
এর আগের বছর সিলেট শহরে তাঁকে নিয়ে উপস্থাপিত ‘আমার ঠিকানা’ টেলিভিশন উপস্থাপনায় তাঁর গানে এখনো কানে বাজছে: ‘মানুষ যদি হইতে চাও করো মানুষের ভজনা/সবার উপরে মানুষ সৃষ্টিতে নাই যার তুলনা।’ বিটিভির প্রযোজক মুসা আহমেদ অবাক হয়ে তাঁর গান শুনছিলেন। বললেন, আজ রাতে সিলেট রেস্ট হাউসে সারা রাত গান শুনব এই শিল্পীর। বললাম: তথাস্তু। রাতে আবদুল করিম আমার আরও ঘনিষ্ঠ হলেন।
গাইলেন একটার পর একটা গান চোখ বন্ধ করে। আল্লাহ স্মরণ, নবী স্মরণ, ওলি স্মরণ, পীর-মুর্শিদ স্মরণ—সর্বমোট ২৫টি গান। এমনি আসরে আমি নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাই। গুরু মশুরউদ্দীন, জসীমউদদীন ও বাবা আব্বাসউদ্দীনের ছিল একই রোগ।
বললাম, আবদুল করিম ও তাঁর পুরো দল আমার সঙ্গে খেয়ে বিদায় নেবেন।
কবি কী যেন বলতে গিয়েও বললেন না। লাজুক স্বভাবের। হয়তো অর্থকষ্টের কথা। রেডিও-টেলিভিশনের এই সামান্য অনুষ্ঠানে কটা টাকাই বা পাবেন। আমার সুন্দর লম্বা পাঞ্জাবিটা তাঁর গায়ে চড়িয়ে দিয়ে বললাম, আপনাকে দারুণ মানাচ্ছে। পাড়াগ্রামের অনেক সাধককে জামা পরিয়েছি, এটা আমার আরেক রোগ।
আবদুল করিমের গান এই প্রজন্ম গলায় তুলে নিয়েছে শুধু দিরাই, সিলেটেই নয়; লন্ডনে, নিউইয়র্কেও। যখন যেখানে যাই, দেখি আবদুল করিমকে গভীরভাবে ভালোবেসে তাঁর গানগুলো গাইছে:
‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান ঘাটু গান গাইতাম।’
এই গানের ছন্দে আজ বাংলা গানের সমঝদারেরা আন্দোলিত। গানগুলোর জনপ্রিয়তার মূলে সংগীতগোষ্ঠীর অবদান সর্বাধিক। তাঁরা গাইছেন বলেই আবদুল করিম আজ ‘বাউলসম্রাট’ নামে অভিহিত। লালনের আখড়ায় বাউলেরা গাইছেন বলেই লালনের গান আমরা ফিরে পেলাম। লালনগীতির শিল্পীরা এই কাজটি করেছেন। তুলনায় পাগলা কানাই, পাঞ্জু শাহ, দুদু শাহ ও অন্য এক শ জন বাউল সাধকের গান তেমনটি গাইতে দেখি না। তবে করিমের অবদান সর্বাধিক। তাঁর গান সহজ, সরল ও স্বভাবগতির। ড. জাফর আহমদ খান, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শাহ আবদুল করিমের রচনাসমগ্র পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে তাঁর শ্রেষ্ঠ গান স্থান পেয়েছে। প্রকাশিত গ্রন্থ আফতাব সংগীত, গণসংগীত, কালনীর ঢেউ (১৯৮১), ধলমেলা (১৯৯০), ভাটির চিঠি (১৯৯৮) ও কালনীর কূলের (২০০১) নির্যাস এই গ্রন্থটি। ধ্রুব এষ অসাধারণ প্রচ্ছদ এঁকেছেন। করিমের আউলা কেশ দেখা যাচ্ছে, মধ্যে একটি সাদা পালক।
সুমন কুমার দাশ সম্পাদিত শাহ আবদুল করিম সংবর্ধনা গ্রন্থে নাসির আলী মামুনের তোলা একটি অসাধারণ পোর্ট্রেট স্থান পেয়েছে আর ৩২ জন লেখকের হূদয়-নিঃসৃত নৈবেদ্য। আমিও আছি। সুমন একটি সুন্দর কাজ করেছেন। করিমের ‘একুশে পদক’ প্রাপ্তি সংস্কৃতিজগেক উদ্ভাসিত করেছে। ‘প্রথম আলো-মেরিল’ আজীবন সম্মাননা তার মুখে শেষ হাসিটুকু পৌঁছে দিয়েছিল। আমি ভাগ্যবান, কারণ পুরস্কারটি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম সেদিন।
শাহ আবদুল করিম তাঁর নিজের পরিচয় পদ্যাকারে দিয়েছেন এইভাবে:
‘কেউ বলে শাহ আবদুল করিম, কেউ বলে পাগল
যার যা ইচ্ছা তাই বলে বুঝি না আসল-নকল
বসত করি দিরাই থানার গ্রামের নাম হয় ধল
ধল একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম দূরদূরান্তে আছে নাম
এই গ্রামের জয় জিলাম নাই কোন সম্বল...
গানের উস্তাদ করমুদ্দিন, ধল আশ্রমে বাড়ি
পরে সাধক রশীদ উদ্দিন, উস্তাদ মান্য করি
বাউল ফকির আমি একতারা সম্বল
সবলাকে সঙ্গে নিয়া আদি উজানঢল।’

বছর খানেক আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার আমাকে ফোন করে জানালেন ‘আব্বাসী ভাই, আপনাকে এক্ষুণি একবার আসতে হয়। বাউল সম্রাট খুব অসুস্থ... তাঁকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করতে চাই।’ খানিকক্ষণ পর ফোন করে জানালেন উনি এত অসুস্থ আর কথা বলতে পারছেন না।
সেরা শিল্পীরা সেরা কবিরা তাঁদের সবটুকু দিয়ে চলে গেলেন। হয়তো দিনকতক হৈচৈ, তারপর সব স্তব্ধ। বয়ে চলবে কালনীর স্রোত। নতুন কোনো গায়ক গান গাইবে। শাহ আবদুল করিমেরই গান:
‘আসি বলে চলে গেল আর তো ফিরে এলো না
আজ আসবে কাল আসবে বলে গো
আমার দিন যায় না রাত পোহায় না।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সঙ্গীতব্যক্তিত্ব।

No comments

Powered by Blogger.