প্রার্থী পরিবর্তনে উজ্জীবিত তৃণমূল by কাফি কামাল

আসন্ন গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে পরিবর্তন এনেছে বিএনপি। তৃণমূলের মতামত প্রাধান্য পেয়েছে প্রার্থী মনোনয়নে। প্রকাশ পেয়েছে নীতিনির্ধারকদের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয়। এ পরিবর্তন দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছে নেতাকর্মীদের। নগরবাসী ও বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীদের রয়েছে জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা ও ইতিবাচক প্রভাব। যা একদিকে নির্বাচনী প্রচারণার মাঠে দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ ও একাট্টা  করবে অন্যদিকে সহজ হবে ভোটারদের আস্থা অর্জন। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে গাজীপুর ও খুলনা দুই সিটি করপোরেশনেই বিএনপি দলীয় প্রার্থী বিজয়ী হবেন বলেই দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীদের বিশ্বাস। তবে তাদের আশঙ্কা, সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত ও সরকার প্রশাসনের মাধ্যমে ফল পাল্টাতে নানা কৌশল করতে পারে। কিন্তু এবারের সিটি নির্বাচনকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে নিচ্ছে বিএনপি। তাই সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়েই ভোটের মাঠে নামছে তারা। গাজীপুর ও খুলনার স্থানীয় বিএনপি নেতারা এমন তথ্য জানিয়েছেন।
খুলনা জেলা ও মহানগর বিএনপি নেতারা জানান, খুসিক নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়ন পাওয়া নজরুল ইসলাম মঞ্জু কেবল খুলনা মহানগরই নয় পুরো বিভাগে জনপ্রিয় একজন নেতা। তিনি প্রার্থী হওয়ায় সাড়া পড়েছে সর্বত্র। খুসিকে মেয়র পদে মনোনয়ন পাওয়া বিএনপির মঞ্জু ও আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেক দুই জনই প্রার্থী হতে শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে অনাগ্রহ পোষণ করেছিলেন। কিন্তু দুই জনের অনাগ্রহের কারণ ভিন্ন। বিগত নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে হেরেছেন খালেক। অন্যদিকে নজরুল ইসলাম মঞ্জুর আগ্রহ ছিল জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি সদর আসনে এমপিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। দলের মনোনয়ন বোর্ডে তাই বর্তমান মেয়র মনির পক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। নেতাকর্মীরা জানান, খুলনা বিএনপির রাজনীতিতে মহানগর সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনি জুটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। মঞ্জু শেষ পর্যন্ত চেয়েছিলেন মনিকেই দেয়া হোক মনোনয়ন। কিন্তু মেয়র হিসেবে মনির কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট নয় দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা। এমন পরিস্থিতিতে তৃণমূলের পক্ষ থেকে শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে ব্যক্ত করা হয় পরিবর্তনের বার্তা। তারা পরিষ্কার জানিয়ে দেন, খুলনা বিএনপির সবাইকে একাট্টা করতে চাইলে মঞ্জুর বিকল্প নেই। ওদিকে কয়েকদিন ধরে তাই মঞ্জু নির্বাচনে রাজি কি না সে কৌতূহল ছিল তাদের। এমন পরিস্থিতি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত মেনেই তিনি তাই শেষমুহূর্তে রাজি হন। এ বার্তাটি স্বস্তির হাওয়া বইয়ে দিয়েছে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মনে।
খুলনা সিটি নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী নিয়ে দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও খুলনা মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহ- সভাপতি শাহারুজ্জামান মতুর্জা বলেন, খুলনা সিটিতে এখনো আমাদের দলের মেয়র আছেন। আমরা আবারো তাকে চেয়েছিলাম। তিনি বিগত নির্বাচনে ৬২ হাজার ভোটে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেককে হারিয়েছিলেন। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তৃণমূল নেতাদের মতামত ও নিজেদের প্রজ্ঞার বিচারে নতুন প্রার্থী দিয়েছেন। এখন যাকে প্রার্থী করা হয়েছে তিনি বর্তমান মেয়রের চেয়েও ভালো প্রার্থী নিঃসন্দেহে। এ মনোনয়ন এক অর্থে খুলনা বিএনপির জন্য ভালোই হয়েছে। দলের হাই কমাণ্ড খুলনা সিটিতে বিজয় সুনিশ্চিত করতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাদের বিশ্বাস, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমাদের প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু একলাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হবেন। তিনি বলেন, বর্তমান মেয়র মনিরুজ্জামান মনি ও জেলা বিএনপির সভাপতি শফিকুল ইসলাম মনা মনোনয়ন না পেলেও মঞ্জু ভাইয়ের সঙ্গে একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালাবেন। কারণ এটা আনন্দের নির্বাচন নয়, খালেদা জিয়া কারাগারে- তার মুক্তির নির্বাচন। বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক এমপি কাজী সেকান্দার আলী ডালিম বলেন, দল যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন তিনি সাংগঠনিকভাবে বর্তমান মেয়রের চেয়ে সিনিয়র।
তিনি দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহানগর বিএনপির সভাপতি। তিনি খুলনা সদর আসনের সাবেক এমপি। খুলনা রাজনীতিতে নজরুল ইসলাম মঞ্জু একজন জনপ্রিয় ও কর্র্মীবান্ধব নেতা। নগরবাসীর কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা অত্যন্ত উঁচু। নির্বাচনের মাঠে তার পক্ষে নেতাকর্মীরা যেমন একাট্টা থাকবে, তেমনি প্রকাশ্য সাড়া পাব সাধারণ মানুষের। মহানগর বিএনপির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সেকেন্দার জাফর উল্লাহ সাচ্চু বলেন, প্রার্থী নিয়ে দলে কোনো অনৈক্য, অসন্তোষ নেই। বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ৬২ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছিল আমাদের প্রার্থী। এবার সে ব্যবধান একলাখ পার করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। পরিস্থিতি বুঝতে পেরেই নির্বাচনে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক। ফলে আমাদের সংশয় রয়েছে, সরকার নির্বাচনের পরিবেশ সুষ্ঠু রাখবে কি না। তবে, এখন আমরা কাউন্সিলর মনোনয়নের জন্য মনোনয়ন বোর্ড গঠন করেছি। ভালো লোকদের কাউন্সিলর হিসেবে দলের সমর্থন দেয়া হবে। এ নির্বাচনকে আমরা সিরিয়াসলি নেব। খুলনা মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফখরুল আলম বলেন, নজরুল ইসলাম মঞ্জু কেবল খুলনাই নয় পুরোবিভাগেই জনপ্রিয় একজন নেতা। তিনি মনোনয়ন পেয়েছেন এটা জেনে প্রার্থী নির্বাচন সঠিক হয়েছে বলে আমাদের জানাচ্ছেন নগরবাসী। নেতাকর্মীরাও দারুণভাবে উজ্জীবিত। আশা করি, ভোটের ফলাফলে সেটার প্রতিফলন ঘটবে। 
এদিকে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে প্রার্থী পরিবর্তনের জোর দাবি ছিল তৃণমূলের। জনপ্রিয়তা থাকলেও নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াতে শারীরিকভাবে অক্ষম বর্তমান মেয়র এমএ মান্নান। বর্তমান সরকারের আমলে বারবার কারাবরণসহ দলের রাজনীতিতে মান্নানের অবদানের বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখেও বাস্তবতা এবং তৃণমূলের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে প্রার্থী পরিবর্তন করে বিএনপি। গাজীপুরে অন্য ছয় মনোনয়ন প্রত্যাশীর মধ্যে আলোচনা ছিল জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক এমপি হাসান উদ্দিন সরকার এবং কাশিমপুর ইউনিয়নের সাবেক একাধিকবারের চেয়ারম্যান শওকত হোসেন সরকারের নাম। তবে, ভোটারদের মধ্যে প্রভাব, জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং জনপ্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা মিলিয়ে হাসান উদ্দিন সরকারকেই বেছে নেন দলের নীতিনির্ধারক ফোরাম। তবে, এমএ মান্নান যেন মনে কষ্ট না পান সে জন্য সাক্ষাৎকারের পরদিন প্রার্থী ঘোষণার আগে চেয়ারপারসন কার্যালয়ে ডেকে এনে তার সঙ্গে আলোচনা করেন দলের নীতিনির্ধারক ফোরামের সদস্যরা।
এদিকে মেয়র পদে মনোনয়ন পেয়েই গতকাল মেয়র মান্নানের কাছে ছুটে যান হাসান সরকার। দুই বয়োজ্যেষ্ঠ নেতার হাসিমুখের ছবিটি এখন ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। জেলা বিএনপির একাধিক নেতা জানান, মনোনয়ন পেয়ে মেয়র মান্নানের কাছে হাসান উদ্দিন সরকারের এ ছুটে যাওয়া ভোটের মাঠে একটি ইতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া বিগত সিটি নির্বাচনে এমএ মান্নানের পক্ষে হাসান উদ্দিন সরকার সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আলোচনায় এসেছিলেন। এবার মান্নানের অনুসারী তার পক্ষেই একাট্টা থাকবেন এ প্রত্যাশা নেতাকর্মীদের। নেতারা জানান, গাজীপুরে বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার কারণে শিক্ষাবন্ধু নামে খ্যাতি রয়েছে হাসান সরকারের। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে যেমন তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে তেমনি ইসলামী দলগুলোর সঙ্গেও রয়েছে তার সুসম্পর্ক। শ্রমিক নেতা হিসেবে শ্রমিক অধ্যুষিত গাজীপুরে তার যেমন প্রভাব রয়েছে তেমনি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, টঙ্গি পৌরসভার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং সাবেক এমপি হিসেবে তার পরিচিতি, প্রভাব রয়েছে গোটা গাজীপুরে।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়ন নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা সভাপতি ফজলুল হক মিলন বলেন, গাজীপুরে আমাদের বর্তমান মেয়র এমএ মান্নান সিনিয়র নেতা এবং জনপ্রিয় রাজনীতিক। কিন্তু বিগত নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর উপর্যুপরী মিথ্যা মামলায় বারবার কারাগারে নিয়ে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলেছে সরকার। তার শারীরিক দিক বিবেচনা করে আরেকজন সিনিয়র নেতাকে মনোনয়ন দিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারক ফোরাম। এখানে বর্তমান মেয়রকে মনোনয়ন বঞ্চিত করা করা হয়েছে এমন দৃষ্টিতে দেখলে ভুল হবে। যিনি মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, টঙ্গি পৌরসভার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও গাজীপুরের সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। দলে ও গণমানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা আছে, আশা করি আমাদের প্রার্থী বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন। জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও গাজীপুর জেলার যুগ্ম সম্পাদক ডা. মাজহারুল আলম বলেন, দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী পরিবর্তনে জোরালো মত দিয়েছিলেন তৃণমূল নেতারা।
বর্তমান মেয়রের শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণেই সবাই এ পরিবর্তনের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তৃণমূলের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। যিনি মনোনয়ন পেয়েছেন তিনিও একজন অভিজ্ঞ ও জনসম্পৃক্ত নেতা। আমার বিশ্বাস, দলের এ সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিয়েছেন এবং দল মনোনীত প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সবাই ঐক্যবদ্ধ কাজ করবেন। গাজীপুর জেলা সদর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও মনোনয়ন প্রত্যাশীদের একজন শওকত হোসেন সরকার বলেন, দল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটার প্রতি আমাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা ও সমর্থন আছে। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ আছি। নির্বাচনের মাঠে সে ঐক্য আরো জোরদার হবে। কারণ বর্তমান মেয়রের স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনা করে সমঝোতার ভিত্তিতেই মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়েছে। আমাদের প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার গাজীপুরের একজন সিনিয়র ও গ্রহণযোগ্যতা সম্পন্ন নেতা এবং অভিজ্ঞ একজন সাবেক জনপ্রতিনিধি। তিনি মনোনয়ন পাওয়ার পর আজ (মঙ্গলবার) আমাদের নিয়ে বর্তমান মেয়র এমএ মান্নানের ঢাকার বাসায় গিয়েছিলেন। বর্তমান মেয়রের দোয়া নিয়ে আমরা শুরু করেছি। তিনি তার অনুসারীদের বলে দিয়েছেন, দলীয় প্রার্থীর পক্ষে যেন পূর্ণ উদ্যোমে কাজ করেন। আমাদের এ ঐক্য অটুট থাকলে বিজয় সুনিশ্চিত হবে। এ ছাড়া কাউন্সিলর পদেও সবখানে আমরা একক প্রার্থীকে সমর্থন দেব।

No comments

Powered by Blogger.