হাত নেই, এখন কীভাবে চাকরির পরীক্ষা দেবেন রাজিব

মা-বাবা হারিয়ে ছোট দুই ভাইকে নিয়ে ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিতুমীর কলেজের স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী রাজিব হোসেন। কম্পিউটারের দোকানে খণ্ডকালীন চাকরি করে নিজের এবং দুই ভাইয়ের খরচ জোগাতেন। স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তির পর থেকেই   বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করে আসছেন। চাকরির পরীক্ষা দিয়েছেন। সামনে আরো কয়েকটি পরীক্ষা আছে। বেপরোয়া দুই বাসের চাপায় ডান হাত হারানো রাজীব এখন কিভাবে সেই পরীক্ষা দেবেন। আর পরীক্ষা দিলেও হাত ছাড়া কিভাবে চাকরি করবেন এমন প্রশ্ন তার স্বজনদের। এখন তার চিকিৎসা নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছেন তারা। মঙ্গলবার কাওরান বাজার এলাকায় দুই বাসের চাপায় ডান হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রাজিবের। সেখান থেকে পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে যান। বেসরকারি ওই হাসপাতালে এক রাত থাকার পর বুধবার সকালে জানানো হয় তার চিকিৎসায় খরচ হয়েছে এক লাখ ২৬ হাজার টাকা। বিপুল এ খরচ বহন করতে না পারায় স্বজনরা সকালেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে চান। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিল পরিশোধ না করা পর্যন্ত রোগী না ছাড়ার কথা জানায়। পরে সংবাদকর্মীরা উপস্থিত হলে ৭৫ হাজার টাকা পরে দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
হাসপাতালে রাজিবের খালা খাদিজা বেগম জানান, তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় রাজিব। বাবা মা ছোট বেলায় মারা যাওয়ার পর বড় খালার বাসায় থেকে পড়াশোনা করেছেন তিনি। ছোট দুই ভাই যাত্রাবাড়ীর তামিরুল মিল্লাত মাদরাসায় ৭ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। রাজিব মতিঝিল কোস্টাল হাইস্কুল থেকে মেট্রিক ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন।
রাজিবের আরেক খালা জাহানারা বেগম জানান, বাবা-মা মারা যাওয়ার পর ছেলেটা একটু সুখের মুখ দেখতে পারলো না। সরকারি চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেখে ছেলেকে দিয়ে আমি চাকরির দরখাস্ত করাতাম। তিনি বলেন, গত মাসেও ১০ থেকে ১২টা চাকরির দরখাস্ত করেছে ও। মঙ্গলবারও আমার রাজিবের একটি চাকরির লিখিত পরীক্ষার কার্ড আসছে। যখন খবর পেলাম আমার বাবা যে ডান হাত দিয়ে লিখিত পরীক্ষা দিবে সেই হাতটিই নেই, তখন আর কার্ডের খাম খুলে কি হবে। রাজিবকে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, রাজিবকে আপনারা সাহায্য করেন। ওতো আর কোনোদিন কাজ করে খেতে পারবে না।
রাজিবের ছোট মামা মিরাজ জানায়, ঘটনার পরপরই পথচারীরা রাজীবকে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করেন।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, রাজীবের ডানহাত কনুইয়ের ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। রাজিবের অপারেশন বাবদ মোট বিল আসছে ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। মেডিসিন বাবদ ২০ হাজার ও অপারেশন বিল ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে ৭৫ হাজার টাকা বাকি রেখে গতকাল দুপুরে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
কলেজ বন্ধ থাকায় তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষের পক্ষ থেকে কলেজের শিক্ষক ডা. সেলিম ও মো. আব্দুল হামিদ প্রাথমিক পর্যায়ে ১০ হাজার টাকা দিয়ে অর্থ সহায়তা প্রদান করেন। এদিকে ঘটনার পরপরই রাজিব নিজেই বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন।
শমরিতার আইসিইউ এর মেডিকেল অফিসার ডা. হোসেন বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত রাজিবের হাতের অপারেশন হয়েছে। তার শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়াতে শরীর অনেকটা দুর্বল রয়েছে। তবে তার অবস্থা এখন স্থিতিশীল। এদিকে বাস দুর্ঘটনায় রাজীবের হাত ‘বিচ্ছিন্নকারী’ দুই বাস বিআরটিসি বাসের চালক ওয়াহিদ ও স্বজন বাসের চালক মো. খোরশেদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বুধবার এক বার্তায় ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেসন্স বিভাগ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ কেন নয়: হাইকোর্ট
এদিকে হাত হারানো কলেজ শিক্ষার্থী রাজীব হোসেনের চিকিৎসা ব্যয় ওই দুই বাস মালিককে বহন করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে আহত রাজীব হোসেনকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ কেন দেয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গতকাল বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হক’র সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন রিটকারী আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দ কুমার রায়। পরে রুহুল কুদ্দুস কাজল মানবজমিনকে বলেন, বিদ্যমান আইন কার্যকরের মা্যধমে যাত্রী সাধারণের চলাচলে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করা এবং এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ, প্রয়োজনে নতুন আইন ও বিধি প্রণয়ন, সংযোজন করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না-তাও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে। স্বরাষ্ট্র সচিব, সড়ক পরিবহন সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ডিএমপি কমিশনারসহ আট বিবাদীকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে আদেশে। তিনি বলেন, রাজীবের হাত প্রতিস্থাপন সম্ভব হলে সেই ব্যয়ভার বহন করতে বাস মালিকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.