পশ্চিমা চাপ একাই সামাল দিচ্ছেন পুতিন

নানা জটিল হিসাবের এক সমীকরণ। তা এক রাশিয়াকে কেন্দ্র করে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপ, সিরিয়া ইস্যু, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক, সর্বশেষ বৃটেনে গুপ্তচরের ওপর নার্ভ গ্যাস প্রয়োগ। প্রতিটি বিষয়ই এই সমীকরণকে আরো জটিল করে তুলেছে। রাশিয়ান গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল ও তার মেয়ে ইউলিয়ার ওপর নার্ভ গ্যাস প্রয়োগ করা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার দা-কুমড়ো সম্পর্ক। পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক বহিষ্কার থেকে শুরু করে নানা উত্তেজনাকর বক্তব্য প্রতিদিনই ছড়িয়ে পড়ছে মিডিয়ায়। পশ্চিমা ওইসব হুমকি ধামকিতে কুচপরোয়া করছেন না নতুন করে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। এতে সৃষ্টি হচ্ছে দ্বিতীয় আরেক শীতল যুদ্ধ। বিভিন্ন মহল থেকে এমন ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে। আদতে ঘটছেও তাই। দৃশ্যত পশ্চিমা বিশ্ব একদিকে। আর তাদেরকে সামাল দিচ্ছেন একা পুতিন। সাবেক কেজিবির এই বস তার চৌকষ বুদ্ধিমত্তা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রেখেছেন। টেক্কা দিচ্ছেন তাবড় তাবড় সব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে। ময়দানে যুদ্ধ নেই। যুদ্ধ চলছে স্নায়ুতে  স্নায়ুতে। তাই তো এ যুদ্ধ  স্নায়ুযুদ্ধ। এটা অনুভব করা যায়, বাস্তবে দেখা যায় না। বিবিসিকে এ বিষয়ে অনেক বোদ্ধা তাদের বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য জানিয়েছেন। তাদের অন্যতম যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা উইলসন সেন্টারের গবেষক মাইকেল কফম্যান। তিনি বলেছেন, এর আগে শীতল যুদ্ধ ছিল বিশ্বের দুই পৃথক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে রেষারেষি, প্রতিযোগিতা। সে সময় দুই পরাশক্তি তাদের অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তির বলে আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলো। বিশ্বজুড়ে আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের কারণে ওই প্রতিযোগিতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিলো তখন। আরেকটি কারণ ছিল সামরিক শক্তির ভারসাম্য। কফম্যান বলছেন, সে তুলনায় এখনকার বিরোধের পেছনে সামরিক সেই ভারসাম্য নেই অথবা আদর্শের কোনো লড়াই নেই। এখনকার বিরোধের প্রধান কারণগুলো হচ্ছে কিছু নেতার কিছু সিদ্ধান্ত, কৌশল এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে মতবিরোধ। কফম্যান মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে বেশ কিছু আঘাত আসবে। কিন্তু তার মাত্রা কখনই শীতল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতো দাঁড়াবে না। তাছাড়া রাশিয়ার সেই ক্ষমতা এখন নেই যে, তারা শক্তির ভারসাম্যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে পারবে অথবা বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে বদলে দিতে পারবে। শীতল যুদ্ধের সময় ইউরোপে কোনো সামরিক সংঘাত হয়নি। কিন্তু অ্যাঙ্গোলা বা কিউবা থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বের আরো নানা জায়গায় সংঘাত চলেছে। বিবিসি আরো লিখেছে, এখনকার সংঘাতের জায়গা প্রধানত রাশিয়ার সীমান্তে - জর্জিয়া, ইউক্রেন। এছাড়া শক্তির ভারসাম্যও এখন অনেকটাই আলাদা। রাশিয়ার হাতে এখন আর তেমন কোনো ‘সফট পাওয়ার’ নেই, যেটা দিয়ে আদর্শিকভাবে তারা বিশ্বকে প্রভাবিত করতে পারে। শীতল যুদ্ধ প্রধানত ছিল কমিউনিজম এবং ক্যাপিটালিজমের যুদ্ধ। এখন তাহলে রাশিয়া এবং আমেরিকার প্রতিযোগিতা কি নিয়ে? এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন কফম্যান। তিনি বলেছেন, রাশিয়ার এখন চিন্তা হচ্ছে কিভাবে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় একটি শক্তিধর দেশ হিসাবে টিকে থাকা যায়, এবং এখনও অবশিষ্ট যে জায়গাগুলোতে তাদের প্রভাব রয়েছে, সেটিকে ধরে রাখা যায়। অন্যদিকে আমেরিকার সমস্যা - তাদের প্রভাব এতটাই প্রসারিত হয়েছে যে তা সামাল দেওয়া অনেক সময় কষ্ট হয়ে পড়েছে। গত দু’ দশক ধরে কোনো চ্যালেঞ্জ না থাকায় আমেরিকা তার সুযোগ নিয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তারের একটা স্বাভাবিক পরিণতি রয়েছে। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, দিন দিন পরিষ্কার হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী উদার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে একদিনেও চীন বা রাশিয়া মেনে নেয় নি এবং তাদের ওপর সেটা চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও এখন পশ্চিমা বিশ্বের নেই। ফলে রাজনীতিতে ক্ষমতার রেষারেষি ফিরে আসছে। এর দায় থেকে কি পশ্চিমা বিশ্ব মুক্ত? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়Ñ না। তারা এর অনেকটার জন্য দায়ী। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের যে অভিযোগ তা এখনও তদন্তাধীন। কিন্তু যদি সে অভিযোগ সত্য হয়ে থাকে (গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতে) তাহলে স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লদের মাথার ওপর দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে রাশিয়া। তারা দেখিয়ে দিতে চায় যে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশের গণতন্ত্রকে তারা নস্যাৎ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। একই রকম অভিযোগ উঠেছিল ফ্রান্স সহ আরো ইউরোপীয় কিছু দেশে। অভিযোগ আছে, রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা করতে ট্রাম্প টিমের অনেকে গোপনে বৈঠক করেছেন। যদি অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে তাতে মার্কিন রাজনীতির দেউলিয়াত্ব ফুটে ওঠে। তারা পুতিনের মতো একজন ব্যক্তিকে তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য ডাকেন (যদি অভিযোগ সত্য হয়)। এর জন্য দায়ী কে পুতিন নাকি পশ্চিমা বিশ্ব, নাকি মার্কিন মুলুকের কেউ। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, বর্তমান এই পরিস্থিতির জন্য পশ্চিমা বিশ্বেরও কিছুটা দায় রয়েছে, এবং নতুন এক শীতল যুদ্ধের যে ধারণা পশ্চিমাদের কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে, তাতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল ওয়ার কলেজের গবেষক লাইল গোল্ডস্টোইন বিবিসিকে বলেছেন, শীতল যুদ্ধের পর অনেক পশ্চিমা দেশ যেন শত্রুর অভাব বোধ করতে শুরু করেছে। অনেক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা যেন সহজবোধ্য হুমকির অপেক্ষায় অস্থির হয়ে পড়েছেন। গোল্ডস্টেইন বলছেন- পশ্চিমারা ইউক্রেন এবং জর্জিয়ার ঘটনায় শীতল যুদ্ধের ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা অনেক জটিল। এই দুই দেশের পরিস্থিতির সাথে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ার এবং জাতীয়তা এবং সীমান্তের অনেক যোগাযোগ রয়েছে।
রাশিয়া কতটা শক্তিধর?
কফম্যান বলেছেন, রাশিয়া এখন দুর্বল একটি শক্তি। ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমের তুলনায় তারা প্রযুক্তি এবং আধুনিক পরিশীলিত রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে পিছিয়ে। কিন্তু অর্থনৈতিক শক্তি তাদের দিন দিন বাড়ছে। রাশিয়ার শক্তি এখন আর কমছে না, উল্টোটা বরঞ্চ সত্যি। কফম্যান মনে করেন, সামরিক খাতে সংস্কার এবং আধুনিকায়নের পথে গেলে এবং অভ্যন্তরীণ ঝামেলা মেটাতে পারলে, নিজের প্রভাব বলয় অক্ষত রাখার ক্ষমতা রাশিয়া অর্জন করতে পারবে। এবং অনেক সময় দূরে গিয়েও শত্রুকে শিক্ষা দিতে হয়তো পারবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো জোটের শক্তি এক করলে তার তুলনায় রাশিয়ার শক্তি অনেক কম। কিন্তু রাশিয়া গত ১৫ বছরে খুব চিন্তা করে সামরিক খাতে বিনিয়োগ করেছে। তাদের ইস্কান্দার পারমাণবিক অস্ত্র-সম্ভার ন্যাটো কম্যান্ডারদের ভাবিয়ে তুলছে। ইলেকট্রনিক যুদ্ধে এবং কামান বা ট্যাংকের শক্তিতেও রাশিয়া খুবই পারদর্শিতা অর্জন করেছে। গোল্ডস্টেইনের মতে পশ্চিমা বিশ্বের অন্য সমস্যাটি হলো - রাশিয়াকে প্রভাবিত করতে উপযুক্ত কৌশল নিতে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। পশ্চিমারা বুঝতে পারছে না তারা রাশিয়ার কাছ থেকে ঠিক কী চায়?

No comments

Powered by Blogger.