মিরসরাইয়ে খালের মুখ ভরাট, আমন চাষ নিয়ে শঙ্কিত কৃষক

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে খালের মুখ ভরাট, খালের উপর অবৈধ স্থাপনা নির্মান করায় সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদী জলাবদ্ধতার কারণে আমন মৌসুমে চাষাবাদ নিয়ে শঙ্কিত উপজেলার প্রায় ৭ হাজার কৃষক। গত মৌসুমেও আমন রোপার ঠিক আগে জলাবদ্ধতায় নষ্ট হয়ে যায় আমন বীজ তলা। আবার ফসল ঘরে তোলার ঠিক আগে বৃষ্টি হলে জলবদ্ধতায় নষ্ট হয়ে যায় শতশত একর পাকা আমন ধান। সম্প্রতি বৃষ্টিতেও উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ মেয়াদী জলাবদ্ধতা। ফলে সামনের আমন চাষ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। উপজেলার ১২ নম্বর খৈইয়াছড়া ইউনিয়নের বুর্জরনগর, চৌধুরীপাড়া, পদ্দাবাজ, ছড়ারকুল, মসজদিয়া, মুহুরীপাড়া এলাকায় রয়েছে প্রায় ১০ হাজার একর ফসলি জমি। ওই জমিগুলোতে আউশ ও আমন চাষ করে স্থানীয় কৃষকরা। জমিগুলো থেকে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে পানি যাওয়ার একমাত্র পথ কামারীয়া খাল। কিন্তু খালের মুখ ভরাট করে গাছ লাগিয়েছে চৌধুরীপাড়ার রবিউল নামে একব্যক্তি। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলে এখন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। চলতি মৌসুমে আউশ চাষ করা ছরারকুল এলাকার কৃষক মো.নুর নবী বলেন, জমিতে আউশ রোপা লাগানোর একদিন পরই বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টি বন্ধ হলে বৃষ্টি পানি ও পাহাড়ি ঢল নেমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। যে পানি এক দুই দিনের খালে নেমে যাওয়ার কথা সে পানি প্রায় ১০ দিনেও নামেনি। ফলে আউশ রোপার অধিকাংশ পানির নেচে থেকে পঁচে গেছে। আবার নতুন করে রোপা লাগিয়েছেন। মো. নুর নবী বলেন, বৃষ্টি পানি চলাচলে জায়গা না রেখে কামারীয়া খালের মুখ ভরাট করার গত দুই বছর ধরে এমন সমস্যা হচ্ছে। আবুল কালাম নামে আরেক কৃষক বলেন, গত আমন মৌসুমে পাকা ধান ঘরে তোলার ঠিক আগে বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে অনেক লোকসান গুনতে হয়েছে। বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানি খালে যাওয়ার জায়গা থাকলে এমন লোকসান গুনতে হতো না। বুর্জরনগর এলাকার কৃষক সামছুল অভিযোগ করেন, কামারীয়া খালে মুখ ভরাট করে ফেলায় গত দুই বছর ধরে একটু বেশি বৃষ্টি হলে বাড়ি ঘরে পানি উঠে যাচ্ছে। কৃষকরা চাষাবাদ করতে পারছেনা। সম্প্রতি বিষয়টি খৈইয়াছড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নন্বর ওয়ার্ডের সদস্য মাহফুজুল হক জুনুকে অভিযোগ করেছে কৃষকরা। কিন্তু কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। খালের মুখ ভরাট, খাল দখল ছাড়াও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রেখে অপরিকল্পিত বাড়ি ঘর নির্মানের ফলেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন ওই কৃষক। ১৩ নম্বর মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কবির আহম্মদ নিজামী অভিযোগ করেন, বড়তাকিয়া-আবুতোরাব সড়ক হয়ে আবুতোবার বাজারের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সাহেরখালী-মঘাদিয়া খালটি বাজার অংশ প্রায় দখল হয়ে আছে। খালের উপর নির্মান করা হয়েছে পাকা-কাঁচা বিভিন্ন স্থাপনা। কযেক বছর আগে বিএডিসি থেকে খালটি খননেন প্রক্রিয়া করা হলেও দখলের কারণে বাজার অংশে খনন করা সম্ভব হয়নি। খালের সামনে ও পিছনে খনন করে মাঝখানের জায়গাটি রেখে দেয়ায় বাজারের জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এছাড়া আবুতোরাব থেকে সাহেরখালী স্লুইচ গেইট পর্যন্ত গাছগাছালিতে জঙ্গল হয়ে যাওয়ায়ও পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্থ হয়। সাহেরখালী-মঘাদিয়া খাল দিয়ে সৈয়দালী, পূর্ব মায়ানী, মধ্যম মায়ানী এলাকার বন্যার পানি নিষ্কাশন হয়। ওই এলাকায় কমপক্ষে ৫ হাজার একর জমিতে দুই ফসলী চাষাবাদসহ রবি শস্য ও শাক সবজির চাষ হয়। কিন্তু খাল দখল ও খাল অপরিষ্কারের কারণে জলাবদ্ধতায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পূর্ব মায়ানী এলাকার কৃষক জহিরুল হক জানান, বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থায় বাঁধা সৃষ্টি করার কারণে জলাবদ্ধতায় চাষাবাদে কৃষকের অনীহা দেখা দিয়েছে। কৃষক বারবার লোকসান দিয়ে চাষ করে। আবার ফসল ঘরে তোলার সময়ও জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
ফসল ঘরে তোলার পর বাজারে নিয়ে গেলে খরচ অনুপাতে ফসলের দাম পায় না। বন্যার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ঠিক থাকলে লোকসান থেকে অনেকটা কৃষক বেঁচে যাবে। জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের সোনাপাহাড় এলাকায় বিএসআর নামে একটি শিল্প কারখানা স্থাপনের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে এলাকার পানি চলাচলের পথ। ফলে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে পানিতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃষক। সম্প্রতি বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে খিলমুরারী গ্রামে প্রায় ২ শতাধিক বাড়ি পানিতে ডুবে যায়। পানিতে ডুবে ধসে পড়ে প্রায় ৫০টি মাটির তৈরী বসতঘর। স্থানীয় কৃষক শফিউল বলেন, বিত্তশালীরা অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলছে কল কারখানা। দুর্ভোগে পড়েত হচ্ছে এলাকার গরীব মানুষকে। খিলমুরারী গ্রামে জলাবদ্ধতায় যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাতে সামনে জমিতে আমন চাষাবাদ দুরের কথা, বর্ষায় নিজেদের থাকাও দূরসাধ্য হয়ে যাবে। খৈইয়াছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহেদ ইকবাল চৌধুরী অভিযোগ করেন, সাহেরখালী-মঘাদিয়া খাল ও মঘাদিয়া খন্দাকাটা খাল দখলের কারণে সৈয়দালী, পশ্চিম খইয়াছড়া, ফেনাপুনী, গোভনীয়া এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে কৃষক চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রশাসন থেকে খাল দখলকারীদের উচ্ছেদের কোন পদক্ষেপ না নেয়া তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। খৈইয়াছড়া ইউনিয়নের কামারীয়া খালের মুখ ভরাট সম্পর্কে তিনি কৃষকদের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান। মিরসরাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ বুলবুল আহমেদ বলেন, এ উপজেলার ৬২ শতাংশ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল । আর এদের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে জলাবদ্ধতা। খালগুলো দখল মুক্ত ও যথাযথ সংষ্কার করা গেলে জলাবদ্ধতা আর থাকবে না। কৃষকও লোকসানের হাত থেকে অনেকটা রক্ষা পাবে। মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়া আহমেদ সুমন বলেন, যে সব খালের উপর স্থাপনা রয়েছে, খালের মুখ ভরাট করা হয়েছে সেসব জায়গায় শীঘ্রই আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালানো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.