ব্রিটিশ নির্বাচনের শিক্ষা

যুক্তরাজ্যের গত বৃহস্পতিবারের সাধারণ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী কনজারভেটিভ পার্টির তেরেসা মে’র প্রত্যাশিত বড় বিজয়ের বিপরীতে তিনি যে বড় ধাক্কাটি খেলেন, তেমন একটি ধাক্কা প্রত্যক্ষ করেছিলাম, ১৯৭০ সালের ১৮ জুনের সাধারণ নির্বাচনে যখন লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন ৯৮ আসনের মেজরিটি খোয়ালেন; আর অপ্রত্যাশিতভাবে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা এডওয়ার্ড হীথ ৩০ আসনের মেজরিটি নিয়ে নতুন সরকার গঠন করলেন। তখন ১৯৬৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হ্যারল্ড উইলসন ইউরোপের অভিন্ন মার্কেটে যোগদানের জন্য নতুন ম্যান্ডেট নিয়ে শক্তিশালী অবস্থান থেকে আলোচনা চালিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার ব্যর্থতার পর সেই আলোচনা চালালেন এডওয়ার্ড হীথ এবং তিনিই ১৯৭২-এ অভিন্ন মার্কেটে যোগদানের চুক্তিতে সই করেছিলেন। ইন্টারেস্টিং বিষয়, এখন আরেক কনজারভেটিভ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে সেই অভিন্ন মার্কেটের নতুন রূপ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার আলোচনা আগামী ১৯ তারিখ থেকে ‘সিরিয়াসলি’ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করবেন।
তবে তেরেসা মে চেয়েছিলেন, তিনি তার ১৬ আসনের মেজরিটি বাড়িয়ে আরও শক্তিশালী অবস্থান থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার; মানে হাল আমলের অতি পরিচিত শব্দ ‘ব্রেক্সিট’ আলোচনা শুরু করবেন। কিন্তু কোথায় তিনি তার দলের বিজয়ী এমপিদের সংখ্যা বাড়াবেন; বরং তিনি খেলেন বড় এক ধাক্কা, তিনি ‘হাউস অব কমন্স’-এ তার সংখ্যাগরিষ্ঠতাই হারালেন। যা শুরুতেই উল্লেখ করেছি। আগের পার্লামেন্ট ‘হাউস অব কমন্স’-এ তার কনজারভেটিভ পার্টির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল ১৬ সদস্যের, এখন তা কমে ৩১৮-তে। মোট ৬৫০ আসনের ‘হাউস অব কমন্স’-এর সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য অন্তত ৩২৬ সদস্য জোগাড় করতে তেরেসা মে’কে এখন উত্তর আয়ারল্যান্ডের একটি ছোট দল ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টির ১০ এমপির ওপর নির্ভর করতে হবে। এই নির্ভরতার জন্য, আশংকা করা হচ্ছে, তাকে চড়া দাম দিতে হতে পারে। যে কোনো মুহূর্তে এই ছোট দলটি সমর্থন প্রত্যাহার করলে তার পতন ঘটবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন না পেয়েও তেরেসা মে যে ‘মাইনরেন্ট’ সরকার গঠন করেছেন শুক্রবার, তেমন একটি সরকার গঠন করেছিলেন হ্যারল্ড উইলসনও ১৯৭৪-এর ২৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের পর। বিষয়টা ছিল এমন।
হ্যারল্ড উইলসন যেমন ১৯৭০-এ আগাম নির্বাচন দিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে পরাজিত হলেন, তার উত্তরসূরি এডওয়ার্ড হীথও ৫ বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই একটি সাধারণ নির্বাচন ডাকলেন। তার সংকট এবং সমস্যা ছিল, তিনি ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে সামাল দিতে পারছিলেন না। একটির পর একটি ধর্মঘট; আজ এরা ধর্মঘট করে তো পরের সপ্তাহে ওরা; এডওয়ার্ড হীথ দারুণ বিপর্যস্ত হয়ে ঘোষণা করলেন, যুক্তরাজ্যটাকে কে শাসন করবে- পার্লামেন্ট না ট্রেড ইউনিয়ন- এই বিষয়ে একটি ফয়সলা জরুরি; দেশের মানুষই নতুন এক নির্বাচনে তা ঠিক করুক। কিন্তু তার এ জুয়াখেলায় তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন না; গরিষ্ঠতা পেলেন না লেবার পার্টি নেতা হ্যারল্ড উইলসনও। তারপরও এডওয়ার্ড হীথ কয়েকদিন চেষ্টা করলেন একটি কোয়ালিশন খাড়া করতে কয়েকটি ছোট দলকে নিয়ে। কিন্তু তিনি সফল হলেন না। তখন হ্যারল্ড উইলসন ‘হাউস অব কমনস’এ মেজরিটির জন্য ৩৩ জন কম এমপি নিয়ে একটি সংখ্যালঘু সরকার গঠন করলেন। এর বিকল্প ছিল, দ্রুত আর একটি সাধারণ নির্বাচন ডেকে অচলাবস্থার নিরসন করা। কিন্তু হ্যারল্ড উইলসন ঠিকই হিসাব করলেন, দ্রুত আর একটি নির্বাচন ডাকলে ঘন ঘন নির্বাচনে বিরক্ত ব্রিটিশ ভোটাররা কনজারভেটিভ পার্টির চেয়ে তার লেবার পার্টিকেই জয়যুক্ত করবে। কনজারভেটিভ পার্টিও ব্রিটিশ ভোটারদের মেজাজ বুঝতে পেরে নতুন নির্বাচনের পক্ষে জোরালো দাবি তোলেনি। কয়েক মাস দেরি করে ব্রিটিশ ভোটাররা যখন আর একটি নতুন নির্বাচনের জন্য মোটামুটি প্রস্তুত বলে জনমত জরিপে জানা গেল তখন হ্যারল্ড উইলসন নতুন নির্বাচন দিলেন ৮ মাস পর ৭৪-এর ১০ অক্টোবর। এই নির্বাচনে তিনি মাত্র ৩ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন এবং এইবার একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করলেন। সরকার গঠন করলেন তিনি ঠিকই; কিন্তু ৫ বছর মেয়াদের তিন বছর বাকি থাকতেই তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেন। আর তার জায়গায় নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন লেবার পার্টির জেমস ক্যালাহান। ১৯৭৯ সালের ৩ মে’র সাধারণ নির্বাচনে ক্যালাহানের দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না, সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল মার্গারেট থ্যাচারের কনজারভেটিভ পার্টি এবং তিনিই হলেন নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। এই মার্গারেট থ্যাচার এবং ১৯৮০তে জিমি কার্টারকে পরাজিত করে নতুন নির্বাচিত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান, এই দুজন দুনিয়াটাকেই ওলট-পালট করে দিলেন; আর আমরা, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের ভুক্তভোগীরা, তাদের প্রায় নির্ভেজাল ‘ক্যাপিটালিজম’ এর আঘাতে প্রাপ্ত ক্ষতগুলো এখনও বয়ে চলেছি। সে আরেক কাহিনী। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, ১৯৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তম স্থান- যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কনজারভেটিভ পার্টির এডওয়ার্ড হীথ, বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন হ্যারল্ড উইলসন এবং ছোট দল লিবারেল পার্টির প্রধান ছিলেন জেরেমি থর্প। এদের সবাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন, এডওয়ার্ড হীথ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরোক্ষভাবে এবং অন্য দুই নেতা প্রকাশ্যে। বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারির ভোরে পাকিস্তানের বন্দিজীবন থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এলেন, প্রধানমন্ত্রী হীথ এবং বিরোধীদলীয় নেতা হ্যারল্ড উইলসন সেদিন বঙ্গবন্ধুকে যে ইজ্জত-মর্যাদা এবং সম্মান দেখিয়েছিলেন, তা-ও প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়লে এত বছর পর এখনও চোখ ভিজে যায়।
দুই. নীতিগতভাবে আমি লেবার পার্টির একজন সমর্থক। আমার লন্ডন প্রবাসী মেয়ে, জন্মসূত্রে ব্রিটিশ নাগরিক অরু লেবার পার্টির একজন নিবন্ধিত সদস্য, প্রতি মাসে ১০ পাউন্ড চাঁদা দেয় লেবার পার্টিকে। তার স্বামী টুজুলও লেবার পার্টিকে ভোট দেয়। তাদের একমাত্র সন্তান, অন্তিক, বয়স ১৪, এখনও ভোটার নয়। লেবার পার্টির প্রতি আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশীদের সমর্থন, সহানুভূতি থাকাটা স্বাভাবিক। আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনটন চার্চিল, মহাত্মা গান্ধীকে ‘লেকেড় ফকির অব ইন্ডিয়া’ বলে উপহাস করেছিলেন। আর মার্গারেট থ্যাচার আরেক কনজারভেটিভ দলীয় প্রধানমন্ত্রী বর্ণনা করেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলাকে ‘টেরোরিস্ট’ হিসেবে। কনজারভেটিভ পার্টির অনেকেই এখনও তাদের অতীত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কথা ভুলতে পারে না, সাদাবর্ণের মানুষজনকে উন্নত জাতের মানুষ মনে করে, আর ‘ক্যাপিটালিজম’কে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মন্ত্র হিসেবে জপ করতে থাকে। দুর্বল শ্রেণীর মানুষজনের জন্য সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় তেমন বিশ্বাস করে না এ কনজারভেটিভরা। এর বিপরীতে সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনটিতে আমরা দেখলাম, লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন শিক্ষা খাতে বেশি বরাদ্দের কথা বলেছেন, পাবলিক সেক্টরের কতগুলো খাতকে আবার ৬০ ও ৭০-এর দশকের মতো জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়–য়া ছাত্রছাত্রীদের ‘ফি’ তুলে দেয়ার মতো কথাও বলেছেন তিনি। আর বলেছেন, সৌদি আরবে তিনি সব সমরাস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেবেন। কারণ ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরব ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লংঘন করে চলেছে। জঙ্গিবাদ দমনে অভিযুক্ত কোনো দেশকে আক্রমণে তিনি ঘোরতর বিরোধী, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানে তার অবস্থান স্পষ্ট। টেলিভিশনে জেরেমি করবিনকে দেখে মনে হয়েছে, তিনি অতি সাধারণ লোকদের একজন। কথাবার্তা, আচার-আচরণ বেশভূষায় তার মধ্যে প্রকট কোনো আভিজাত্যবোধ দেখিনি। তাই তো এখন নির্বাচনের পর তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির তেরেসা মে’র বিপরীতে কত সহজভাবে মানুষজনের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছেন, তার আলোচনা চলছে। লক্ষ করার বিষয়, তিনি তরুণ-তরুণীদের তার পাশে টানতে পেরেছেন। গতকাল সন্ধ্যায় ভারতীয় টিভি চ্যানেল এনডিটিভির একটি জরিপে দেখানো হল, তরুণ ভোটারদের ১৫ শতাংশ পেয়েছে কনজারভেটিভ পার্টি; আর তার বিপরীতে লেবার পার্টি পেয়েছে ৭১ শতাংশ। এই জরিপে আরও দেখা গেছে, নিন্মআয়ের ৪০ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে কনজারভেটিভ পার্টিকে; আর তার বিপরীতে ৫১ শতাংশ পেয়েছে লেবার পার্টি। এই জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, শ্রেণীভেদের চেয়ে ভোটারদের বয়স বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জেরেমি করবিন তা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তরুণ ভোটারদের নিবন্ধনের ওপর জোর দিয়েছিলেন; সঙ্গে সঙ্গে আরও জোর দিয়েছিলেন, তারা যেন ভোট দিতে ভোট কেন্দ্রে যায়। পশ্চিমের লিবারেল ডেমোক্রেসির দেশগুলোতে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটারদের ভোট দেয়ার আগ্রহ কম। এই প্রসঙ্গে আমার নিজের অভিজ্ঞতাটা বলি। ১৯৭০-এর ১৮ জুনের যে নির্বাচনে হ্যারল্ড উইলসন হারলেন, তার আগের দিনের কথা। আমি তখন লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনে একজন তরুণ কূটনীতিবিদ, বিদেশের কোনো দূতাবাসে আমার প্রথম পোস্টিং, থার্ড সেক্রেটারি হিসেবে। গাড়ি একটি কিনে ফেলেছি। কিন্তু গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স তো নেই। তাই আমি ড্রাইভিং লেসন নিচ্ছিলাম। ৪০-৪৫ বছর বয়সী এক শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ আমাকে ড্রাইভিং শেখায় তার গাড়িতে। তাতে খরচ কম, এক ঘণ্টার এক লেসন, দিতে হয় এক পাউন্ড। তো ১৭ জুন, নির্বাচনের আগের দিন, এক ঘণ্টা ড্রাইভিং শেষে তাকে আমি জিজ্ঞাসা করি, আগামীকাল তো তুমি আসছ না। জবাবে তার প্রশ্ন, কেন, কেন আসব না? বললাম, কাল তোমাদের ইলেকশন না? আমার সেই ইনস্ট্রাক্টর বলল, ওহ, না আমি আসব। ইলেকশন তো কী হয়েছে? আমি তো ভোট দেই না। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি; মনে মনে ভাবতে থাকি, এ কেমন এক লোক, ভোট দিতে যায় না? আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে সে আমাকে বলে, দেখো, ভোট দিয়ে কী হবে? লেবার পার্টি বলছে, ক্ষমতায় থাকতে পারলে তারা পাউরুটির দাম কমাবে। কিন্তু আমরা জানি, পাউরুটির দাম কমালেও ডিমের দাম ঠিকই তারা বাড়াবে। কনজারভেটিভ পার্টিও তো ক্ষমতায় যেতে পারলে, ডিমের দাম হয়তো কমাবে; কিন্তু পাউরুটির দাম ঠিকই বাড়াবে। তাহলে ভোট দিতে গিয়ে আমার সময় অপচয় করি কেন? তবে হ্যাঁ, আমার স্ত্রী লেবার পার্টি করে, ভোট দিতে যাবে সে। আমার জন্য এই অভিজ্ঞতাটা বড় একটা ধাক্কা ছিল। সেই ’৫৪ সালে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় থেক সব স্তরের নির্বাচনগুলোকে উৎসব হিসেবে দেখে আসছি। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড এবং ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচনে আমরা ছোটরা কত লাফালাফি করেছি; আব্বা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রার্থী হতেন, জিততেন। তখনকার দিনের চুঙ্গা হাতে কত স্লোগান দিয়েছি, মিছিল করেছি। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের এক প্রার্থীর হাতি প্রতীকের পক্ষে তিনি জ্যান্ত হাতি নিয়ে চমকে দিলেন আমাদের জিএম হাট বাজারের এক হাটবারে। আর আমাদের পোলা-পানের আনন্দ উত্তেজনা দেখে কে?
তিন. লেবার পার্টি বলেই আমাদের বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত তিনকন্যা, রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক এবং রূপা হক এ পার্টি থেকে নমিনেশন পেলেন এবং বিজয়ীও হলেন। কনজারভেটিভ পার্টিও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকদের নমিনেশন দিয়েছে; কিন্তু সংখ্যায় কম এবং বোধ হয় এমন আসনে যেখানে বিজয়ের সম্ভাবনাও কম। লেবার পার্টি বলেই লন্ডনের মতো এত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি শহরে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাদিক খান নমিনেশন পান এবং বিজয়ীও হন। একজন ড্রাইভারের সন্তান, সাদিক খান এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে লন্ডনের সর্বসাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার বিষয় নিয়ে টুইট বার্তায় আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছেন। সাদিক খানের পূর্বসূরি বরিস জনসন এখন তেরেসা মে’র পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দুর্বল তেরেসা মে’র জায়গায় সম্ভাব্য কনজারভেটিভ পার্টি নেতা। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে তেরেসা মে আবার যাত্রা শুরু করলেন। তাকে ইতিমধ্যেই একটি অপ্রয়োজনীয় নির্বাচন ডেকে কনজারভেটিভ পার্টিকে বেইজ্জত করার অভিযোগ তোলা হচ্ছে তার দল থেকেই। এক বছর আগে ডেভিড ক্যামেরনও একটি অপ্রয়োজনীয় গণভোট ডেকে পরাজিত হন; তাকে তখন প্রধানমন্ত্রীর পদও ছাড়তে হয়। বৃহস্পতিবার সকালে একটি ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড দৈনিকের বড় বড় হরফে দুটি শব্দে শিরোনাম ছিল- ‘তেরেসা ডিসমেড’ (Therese Dismayed)। আর শনিবার সকালে বন্ধু ও অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত আশরাফ উদদৌলার ফেসবুকে এই কটূক্তি দেখলাম : ‘জুন ইজ দ্য এন্ড অব মে’। লক্ষ করার বিষয়, এ নির্বাচনে ডেভিড ক্যামেরন কী করলেন, কোথায় ছিলেন, ভোট দিলেন কী দিলেন না, কোথাও এতটুকু উল্লেখ দেখলাম না। তেমন দেখলাম না আগের কয়েকজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, টনি ব্লেয়ার, গর্ডন ব্রাউন বা জন মেগরের কোনো খবর। আর দেখলাম না পোলিং স্টেশন দখল, জালভোটে ব্যালট বক্স পূরণ এবং ছিনতাই, ক্যাডার বাহিনীর পেশিশক্তি প্রদর্শন, অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবির মতো বাহিনীগুলোর দাপট। তাদের নির্বাচনী প্রচার পথসভা এবং টিভি, রেডিও, সামাজিক মাধ্যমে। আমাদের দেশের মতো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা লালদীঘির ময়দানে নয়। ব্রিটিশ নির্বাচনগুলোর মতো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, ঝামেলামুক্ত নির্বাচন ১৯৫৪ সালে দেখেছি। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনটি নিয়েও কোনোই বিতর্ক নেই। বাংলাদেশেও তো এমন নির্বাচন আমরা দেখেছি। কিন্তু তারপরও আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে কেন বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে আশ্বস্ত করতে হয়, ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি মতো নির্বাচন এদেশে আর নয়।
শনিবার, ১০ জুন, ১৭
মহিউদ্দিন আহমদ : সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; কলাম লেখক।
‘শিউলীতলা’ উত্তরা, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.