নতুন নতুন সংকটে গ্রামীণ ব্যাংক by ফখরুল ইসলাম ও জাহাঙ্গীর শাহ

গ্রামীণ ব্যাংক
গ্রামীণ ব্যাংকে সংকট বাড়ছেই। দিন যাচ্ছে, আর পুরোনো সংকটের সঙ্গে ব্যাংকটিতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সংকট, যা তৈরি করছে সরকার নিজেই।
নোবেল বিজয়ী এ প্রতিষ্ঠানে ১০ মাস ধরে পর্ষদ সভা হয় না। চেয়ারম্যান নিয়েও আছে বিভ্রান্তি। চার বছর ধরে এ ব্যাংকে নিয়মিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নেই। এমডি নিয়োগ দেওয়ার জন্য পর্ষদও নেই।
পর্ষদের নির্বাচিত সদস্যদের মেয়াদ ছয় মাস আগে শেষ হলেও নির্বাচন করা যাচ্ছে না। ব্যাংকটিকে নিজের কবজায় নিতে সরকার আইনকানুন বদলালেও বাস্তবায়ন করতে পারছে না কিছুই। একেকবার একেক পদক্ষেপ নিয়ে তা থেকে আবার সরে আসছে। ১০ মাস ধরে সরকার একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজই খুঁজে পাচ্ছে না, যিনি গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক নির্বাচন করে দেওয়ার জন্য কমিশনের চেয়ারম্যান হতে রাজি আছেন।
এত সব সংকট কীভাবে কাটবে এবং নির্বাচনই বা হবে কবে—জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক নির্বাচন করে দেবে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজের নেতৃত্বাধীন একটি কমিশন।’ মাসের পর মাস চেষ্টা করা হলেও কোনো জেলা জজ তো রাজি হচ্ছেন না—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘তাই নাকি? জানি না তো!’
এত সব সংকটের মধ্যেও গত এপ্রিলে পুরোনো সদস্যদের নিয়ে পর্ষদ সভা ডেকেছিলেন ব্যাংকটির সরকারের নিয়োগ দেওয়া চেয়ারম্যান (যিনি পদত্যাগ করলেও সরকার তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেনি) খন্দকার মোজাম্মেল হক। পর্ষদের নয়জন নারী সদস্যসহ সব সদস্যকে সভায় অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণও জানান তিনি। এ খবর অর্থ মন্ত্রণালয়ে পৌঁছালে সভা অনুষ্ঠানের আগের সপ্তাহে চিঠি দিয়ে বাতিল করা হয়। চিঠিতে বলা হয়, যেহেতু পর্ষদ সদস্য বা নির্বাচিত পরিচালকদের মেয়াদ তিন বছর পার হয়ে গেছে, তাই পর্ষদ সভা অনুষ্ঠানের কোনো কার্যকারিতা নেই। এরপরই সভাটি বাতিল করেন গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান।
এ অবস্থায় আরেকটি সংকটে পড়তে যাচ্ছে ব্যাংকটি। আগামী অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ এস এম মহিউদ্দিন নিয়মিত অবসরে যাচ্ছেন। তার আগে ভারপ্রাপ্ত এমডি নিয়োগ দিতে হবে। আর এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে ব্যাংকের পর্ষদকে।
২০১১ সালের ১১ মে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এমডির পদ থেকে সরে যান। চার বছরের বেশি সময় ধরে ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়েই চলছে গ্রামীণ ব্যাংক।
এ বিষয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান খন্দকার মোজাম্মেল হক কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে ভারপ্রাপ্ত এমডি এ এস এম মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে পর্ষদ সভা আহ্বান করা হলেও তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আপত্তিতে বাতিল করার কথা জানান।
পুরোনো সংকটগুলোও কাটছে না গ্রামীণ ব্যাংকের। পর্ষদের নির্বাচিত সদস্য বা পরিচালকদের মেয়াদ শেষ হয়েছে পাঁচ মাস আগে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তাঁরা তিন বছর মেয়াদ শেষ করেন। কিন্তু নতুন পরিচালক নির্বাচন করতে গেলে যে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে, সেটাই গঠন করতে পারছে না সরকার।
যোগাযোগ করলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের উদ্যোগগুলোতে একের পর এক সমস্যাই বেড়েছে। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত।
মেয়াদ নিয়ে দুই রকম কথা: পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচিত সদস্য বা পরিচালকদের মেয়াদ নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক আইন এবং গ্রামীণ ব্যাংক (পরিচালক নির্বাচন) বিধিমালার মধ্যে পরস্পরবিরোধী অবস্থানও রয়েছে।
অধ্যাদেশের আওতায় ১৯৮৪ সালে গঠিত হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক। অধ্যাদেশের ১১(২) ধারা অনুযায়ী, একজন পর্ষদ সদস্যের মেয়াদকাল হবে তিন বছর এবং পরবর্তী সদস্য নির্বাচিত না হওয়ায় তিনি কাজ চালিয়ে যাবেন।
কিন্তু ২০১৩ সালে সামরিক সরকারের আমলের প্রণীত দেশের সব অধ্যাদেশ আইনে পরিণত করতে গিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক আইনও প্রণয়ন করা হয়। সেখানে কিছু পরিবর্তনও আনা হয়। আইনের ১১(১) ধারায় বলা হয়েছে, সদস্যদের মেয়াদকাল হবে তিন বছর। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় সদস্যদের মেয়াদকাল শেষ হবে, তা নিয়ে কিছু বলা হয়নি। ২০১৪ সালের ৬ এপ্রিল পূর্ণাঙ্গ গ্রামীণ ব্যাংক (পরিচালক নির্বাচন) বিধিমালা জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। বিধিমালার ৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, পরিচালক নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যমান নির্বাচিত পরিচালকদের পদ শূন্য হবে। এর মানে হলো, যত দিন তফসিল ঘোষণা না হবে, তত দিন আগের পরিচালকেরা বহাল থাকবেন।
সুতরাং সর্বশেষ পর্ষদ সদস্যদের তিন বছরের মেয়াদ শেষ হলেও আইনমতে তাঁরা সদস্য নন, কিন্তু বিধিমতে সদস্য আছেন।wwww
গ্রামীণ ব্যাংকের পর্ষদ সদস্যদের পদ বহাল রাখা নিয়ে গত এপ্রিল মাসে একটি রিট করেন পর্ষদ সদস্য তাহসিনা খাতুন। সেই রিটের এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তাহসিনা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু নতুন পর্ষদ সদস্য নির্বাচিত হয়নি, তাই এখনো আমরাই সদস্য আছি।’
এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত এমডি এ এস এম মহিউদ্দিন বলেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংকে সব সময় নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন হয়েছে। এত দিন নতুন পর্ষদ সদস্য নির্বাচনের আগ পর্যন্ত পুরোনোরাই সদস্য থাকতেন।’
গ্রামীণ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, পর্ষদের নয়জন নারী সদস্যের কাছে এখনো প্রতি মাসের হিসাবসহ যাবতীয় তথ্যের প্রতিবেদন পাঠানো হয়।
জেলা জজ খুঁজে পাচ্ছে না: গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক নির্বাচনের জন্য অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ গত ১০ মাসেও খুঁজে পায়নি সরকার। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্বাচন করার দায়িত্ব দিয়ে বিধিমালা জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এ দায়িত্ব নিতে অপারগতা জানায়। ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে পরিচালক নির্বাচন করার সময়সীমা শেষ হয়ে যায়। এরপর সেই দায়িত্ব জেলা জজকে দিয়ে আবারও বিধিমালা সংশোধন করা হয়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে বিধিমালাটি সংশোধন করলেও তা ৫ অক্টোবর থেকে কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়।
সংশোধনীতে বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক নির্বাচনের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার হবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ। প্রজ্ঞাপনটিতে এবার কিছুটা কৌশল অবলম্বন করা হয়। বলা হয়, নির্বাচন হবে ‘বিধিমালার অধীন কমিশন গঠনের এক বছরের মধ্যে।’ অর্থাৎ, কমিশন গঠন করার আগ পর্যন্ত নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা নেই। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার পর্যন্ত সরকার নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারেনি। কারণ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার হতে কোনো অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজই রাজি হচ্ছেন না।
আবার প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজকে সরকার প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করবে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় না আইন মন্ত্রণালয় করবে, তা স্পষ্ট বলা নেই। এ ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি অবশ্য জানান, ‘আমরাই নিয়োগ করব।’ কোনো অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজই তো রাজি হচ্ছেন না, তাহলে কী দাঁড়াবে—এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
সরকার গঠিত গ্রামীণ ব্যাংক-সংক্রান্ত অনুসন্ধান কমিশনের সদস্য আজমালুল হোসেন কিউসি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিচালক নির্বাচন করতে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার দরকার ছিল না। আমাদের নির্বাচন কমিশনকে দিয়েই এ নির্বাচন করা সম্ভব। গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের প্রতিবেদনে এ রকম একটি সুপারিশও আমরা করেছিলাম।’
পরিচালক নির্বাচন করে দিতে একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন—এ প্রসঙ্গে মির্জ্জা আজিজ বলেন, ‘আমার মনে হয় সরকার এ ব্যাপারে সিরিয়াস নয়। আর একান্তই কাউকে না পাওয়া গেলে আবার আইন সংশোধন করতে হবে। এভাবে তো চলতে পারে না।’
এত বিপত্তির পরও গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কার্যক্রম ভালো চলছে, ভালো মুনাফাও হচ্ছে, কীভাবে—আবারও জানতে চাইলে মির্জ্জা আজিজ বলেন, ‘এ জন্য ড. ইউনূসকে কৃতিত্ব দিতে হয়। তিনি এমন পদ্ধতি দাঁড় করিয়েছেন যে তাঁর অনুপস্থিতিতেও প্রতিষ্ঠানটি নুয়ে তো পড়ছেই না, উল্টো মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়ে আছে।’
নির্বাচিতদের ছাড়াই কোরাম: গত ১৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচিত সদস্যদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ওই মাসেই অর্থ মন্ত্রণালয় তিনজন মনোনীত সদস্য নিয়োগ দেয়। তাঁরা হলেন চেয়ারম্যান খন্দকার মোজাম্মেল হক, তৎকালীন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব সুরাইয়া বেগম এবং আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি শাহ এ সারোয়ার। তাঁরাও এ পর্যন্ত কোনো সভা করতে পারেননি।
নির্বাচিত পরিচালকদের ছাড়াই কোরাম পূর্ণ করতে ২০১৩ সালের গ্রামীণ ব্যাংক আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আইনের ১৭(৩) ধারা অনুযায়ী, নির্বাচিত পরিচালকদের পদ শূন্য হলে পরিচালক নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত চেয়ারম্যান ও সরকার মনোনীত অপর দুজন সদস্য উপস্থিত থাকলেই সভার কোরাম হবে।
এর মানে হলো, সরকার চাইলে নির্বাচিত পরিচালক ছাড়াই গ্রামীণ ব্যাংকের পর্ষদ চালাতে পারবে। যেকোনো সিদ্ধান্তও পর্ষদ নিতে পারবে।

No comments

Powered by Blogger.