বিচারহীনতায় বাড়ছে শিশু নির্যাতন

বর্তমানে একের পর এক বীভৎস কায়দায় শিশুহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। মানুষের অমানবিক, নিষ্ঠুর এই আচরণের পেছনে কাজ করছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে না থেকে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সোমবার দুপুরে প্রথম আলো আয়োজিত ‘আসুন শিশুদের পাশে দাঁড়াই’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এ কথা বলেন। কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম ও ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীন।
গোলটেবিল বৈঠকে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শান্তিপ্রিয়, সংগীতপ্রিয় বাঙালির চরিত্রের পাশাপাশি এখন মানুষের মধ্যে যে ধরনের মারমুখী, নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে, তা উল্লেখ করে বলেন, বাঙালি জাতিগতভাবে শান্তিপ্রিয়—বিষয়টি এখন প্রশ্নের মুখোমুখি। বর্তমানে শিশুরা হতাশাজনক অবস্থার মধ্যে অবিবেচনার শিকার হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শিশুদের প্রতিকার পাওয়া দুরূহ। কেননা কাউকে না কাউকে শিশুদের হয়ে কথা বলতে হবে। সমাজের সচেতন মানুষকেই সেই দায়িত্ব নিতে হবে। এটা সচেতন মানুষের কর্তব্য। সব সময় শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখের দিকে না তাকিয়ে সামাজিকভাবে সবাইকে অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
খুলনায় নির্যাতনে রাকিবের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে আনিসুজ্জামান বলেন, শরীরে হাওয়া ঢুকিয়ে শিশুকে মারা হয়েছে, এটি অমানবিক। ভাবতেই ভয় লাগে। সমাজকে রক্ষার জন্য, উন্নত পরিবেশের জন্য সবাইকে দাঁড়াতে হবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘মোটা দাগে শিশুর প্রতি নির্যাতনের কারণ হলো, আমরা সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে চলছি। অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতার জন্ম দিচ্ছে। কোনো কিছুতেই কারও ধৈর্য থাকছে না। একটা কিছু হেস্তনেস্ত করে দেওয়ার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে প্রথমে আসে বিচারহীনতার কথা।’
এই বিচারহীনতার সঙ্গে রাজনৈতিক পরিবেশের সম্পর্ক আছে বলে উল্লেখ করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল অকল্যাণকর কাজ করছে। মানুষ পুড়িয়ে হত্যাসহ বিভিন্ন কাজ করছে। কিন্তু তাদের কয়জনকে আইনের আওতায় আনা গেছে? রাজনৈতিক ও পেশিশক্তির প্রভাবে দুর্নীতিতেও দেশ ছেয়ে গেছে।
গোলটেবিল বৈঠকে সিলেট কারাগার পরিদর্শনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন মিজানুর রহমান। বলেন, সেখানে অভিযুক্তের দুই বছরের সন্তানসহ স্ত্রীকে আটক করে রাখা হয়েছে। কেননা অভিযুক্তকে পাওয়া যায়নি। যাকে ধরার কথা তাকে ধরার নাম নেই। এটি বিচারহীনতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
মিজানুর রহমান বলেন, অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী নিজে যতক্ষণ না কিছু উচ্চারণ করছেন, ততক্ষণ অন্যরা এ বিষয়ে কথা বলতে উৎসাহ পাচ্ছেন না। প্রধানমন্ত্রীকেই যদি একা সব দায়িত্ব পালন করতে হয়, তাহলে অন্যদের থাকার দরকার কী? রুশ লেখকের উদাহরণ দিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, শৈশবে শিশুকাল ছিল না, তা যেন শিশুদের বলতে না হয়।
গোলটেবিল বৈঠকে শিশু অধিকার নিয়ে কর্মরত সংগঠনের প্রতিনিধি, মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, পুলিশ, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া শিশু নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি কারণগুলো বিশ্লেষণ করেন। ভবিষ্যতে করণীয় সম্পর্কেও সুপারিশ করেন তাঁরা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, মুক্তিযুদ্ধ, সংস্কৃতি, আদর্শিক চিন্তা-চেতনায় ‘সব মানুষের সমান অধিকার’ কথাটি সব সময় ছিল। ২১ ফেব্রুয়ারির গানের মধ্যেও বলা হয়েছে, শিশুহত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা। তবে বাস্তব জীবনে কাজের মধ্যে তার কতটুকু পরিস্ফুটন ঘটেছে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকাশ আছে। এ মুহূর্তে যা ঘটছে তাকে সামাল দিতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে।
সুলতানা কামাল বলেন, বিচারহীনতার কারণেই অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। অপরাধীরা বার্তাটা পেয়ে যাচ্ছে যে, কিছুই হবে না। কর্তৃপক্ষ ব্লগারদের দেশ ছাড়তে বলছে, পয়লা বৈশাখে পাঁচটার মধ্যে ঘরে ঢুকতে হবে, এরপর কর্তৃপক্ষ আর দায়দায়িত্ব নেবে না, তা বলে দিচ্ছে। ব্লগার হত্যার পর পুলিশপ্রধান যখন বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবেন না, অর্থাৎ কথাগুলো যখন দায়িত্বশীল জায়গা থেকে আসে, তখন যারা বিভিন্ন অজুহাতে অপরাধ করে, তারা উৎসাহী হয়।
ঘটনা ঘটার পরও মানুষ দাঁড়িয়ে দেখে, প্রতিবাদ করতে পারে না কেন বা পুলিশ বাহিনীর কানে ঘটনার কথা কেন পৌঁছাচ্ছে না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সুলতানা কামাল। শিশু সহিংসতা প্রতিরোধে তিনি সামাজিক আন্দোলনের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যাতে অপরাধী প্রভাবশালীদের কাছে নতি শিকার না করেন, সে ধরনের পরিবেশ তৈরিতে রাষ্ট্রকেই ব্যবস্থা করতে হবে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, যেকোনো নাগরিকের স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া যাবে না। পয়লা বৈশাখের ঘটনার পর মেয়েদের পোশাকের অজুহাত তোলা হলো। মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ বছর করার ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, মেয়েরা পালিয়ে বিয়ে করছে। অর্থাৎ অপরাধীদের শাস্তির আওতায় না এনে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ফলেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে।
সমাজ একধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে চলছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর চেয়ারম্যান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, শুধু আইন বা পুলিশ দিয়ে এ ধরনের বিপর্যয় রোধ করা যাবে না, নাগরিক সমাজকেও দাঁড়াতে হবে। যৌথভাবে কাজ করলে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
সেলিনা হোসেন বলেন, দেশের শিশুরা রক্ষা পাচ্ছে না। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রকে স্কুলে ভর্তি করতে বাধা দিয়েছেন একজন সাংসদ। তিনি কীভাবে এ কাজটি করলেন? এ ধরনের মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করতে না পারলে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ গ্রাস করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম বলেন, একটার পর একটা নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার উপায় নেই। ঘটনাগুলো অনেকগুলো বিষয়ের সমন্বয়ে ঘটছে। ঘটনা ঘটছে, কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করছে না। দাঁড়িয়ে দেখছে বা মুঠোফোনে ছবি তুলছে। তার কারণ, সবাই যার যার নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবছে। বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা নেই বলেই এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
মেহতাব খানম সিলেটের রাজনসহ শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো গণমাধ্যম যেভাবে প্রচার ও প্রকাশ করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘ঘটনাগুলো আমরা বড়রা দেখে সহ্য করতে পারছি না, সেই জায়গায় আমরা ভাবি না, শিশুরা দৃশ্যগুলো কীভাবে নিচ্ছে। শিশুরা দৃশ্যগুলো দেখে প্রথমে মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হয়, পরে তারা একসময় নিজেরাই নির্যাতনকারীর ভূমিকা পালন করে। তাই সব গণমাধ্যমকে একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি হেল্পলাইন আছে, কিন্তু তা বেশির ভাগ মানুষ জানে না। ৬৪ জেলায় জেলা মনিটরিং কমিটি কাজ করছে। এই কমিটিগুলো কী কাজ করছে, তা নজরদারির আওতায় আনতে হবে। শিশুরা জানে, তাদের বিচার চাওয়ার কোনো জায়গা নেই। শিশুদের অধিকার রক্ষায় যা সুযোগ রয়েছে, তা গণমাধ্যমে বেশি করে প্রচারের সুপারিশ করেন তিনি।
পুলিশের এআইজি (প্রশাসন) রখফার সুলতানা খানম বলেন, বর্তমানে শিশুহত্যাসহ নির্যাতনের কিছু অমানবিক ঘটনা ঘটছে। তবে ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এ ধরনের অপরাধ যারা করছে তারা ক্রিমিনাল, ডাকাত বা চোর, সে ধরনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুছ সহিদ মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের মতো অন্যান্য দেশেও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। তবে পার্থক্য হলো, উন্নত দেশে দ্রুত বিচার হয়, বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনকে অন্যান্য অপরাধের মতোই মনে করা হয়। তিনি শিশুসংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারের সুপারিশ করেন।
খুলনার আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী মোমিনুল ইসলাম শিশু রাকিব হত্যা প্রসঙ্গে বলেন, তার ওপর যে ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে, তা ভাষায় বর্ণনা করার উপায় নেই।
প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীন শিশুদের ওপর নির্যাতনসহ সার্বিক বিষয়টি গণমাধ্যমসহ সবাই অগ্রাধিকার দিচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। শুধু বড় ঘটনা ঘটলেই সবাই সক্রিয় হচ্ছে বা প্রতিবাদ করছে কি না, তা দেখতে হবে। সবাই আরেকটা রাজন হত্যার অপেক্ষায় আছে কি না, তা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন।
সিলেটের মানবাধিকারকর্মী লক্ষ্মীকান্ত সিংহ বলেন, সিলেটে রাজন হত্যার ঘটনার আগে মার্চ মাসে আবু সাঈদ নামে নয় বছর বয়সী একটি শিশুহত্যার ঘটনা ঘটে। লাশ পাওয়া যায় এক পুলিশ সদস্যের ঘরে। ওই ঘটনায় আসামি গ্রেপ্তার হলেও অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। আবু সাঈদের হত্যার ঘটনার কোনো ভিডিও নেই, তাই হয়তো গণমাধ্যমও ততটা গুরুত্ব দেয়নি। রাজনের হত্যার পর ঘটনা চাপা পড়ে যায়।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী যারিন মুসাররাত মানিতা বলে, ‘রাজন হত্যার পর ফেসবুকে ও বিভিন্ন টেলিভিশনে ব্যাপকভাবে প্রচার হতে দেখে বিস্মিত হয়েছি। আমাদের মনে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে।’
নির্যাতনের শিকার হলে শিশুরা যাতে অভিযোগ জানাতে পারে—পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গায় সে ধরনের অভিযোগ কেন্দ্র খোলার সুপারিশ করেছে ওই শিক্ষার্থী।
প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল ‘আসুন শিশুদের পাশে দাঁড়াই’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। ছবিতে অন্যান্যের মধ্যে রয়েছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, মিজানুর রহমান, সেলিনা হোসেন, সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধূরী, মেহতাব খানম l ছবি: প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.