বাংলাদেশ: রূপক না প্রতীকাশ্রয়ী কাহিনি by উইলিয়াম বি মাইলাম

লন্ডনের দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এ গত সপ্তাহে একটি চমকপ্রদ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, লেখাটির বক্তব্যের সঙ্গে আমার সাম্প্রতিক বক্তব্যের বেশ মিল রয়েছে। এতে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে, যেখানে তিনি উদার গণতন্ত্রকে ছুড়ে ফেলে একটি ‘অনুদার রাষ্ট্র’ গঠনের কথা বলেছেন। তিনি রুশ, তুর্কি ও চীনা শাসনের ধাঁচের প্রশংসা করেছেন।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একটি সদস্য রাষ্ট্রের পক্ষে এ কথা বলা কিছুটা বিস্ময়করই বটে। বিশেষ করে যে দেশটি ৬০ বছর আগে পরাক্রমশালী সোভিয়েত শাসনের জোয়াল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রবল লড়াই-সংগ্রাম করেছে। আর মুক্ত হওয়ার পর তা উদ্যাপনও করেছে বিশেষ কায়দায়: অতিসত্বর দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র কায়েম করে তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। হ্যাঁ, আমরা এখনো জানি না হাঙ্গেরির মানুষ কী ভাবছে। অন্যদিকে, যেসব দেশ তথাকথিত ‘তৃতীয় ধাক্কায়’ ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেছিল, তারাও এখন কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছে। প্রকৃত গণতন্ত্র আসলেই খুব কঠিন ব্যাপার। আর চার্চিলের সেই ভর্ৎসনা দুনিয়ার সংবাদমাধ্যমগুলো ভুলতে বসেছে: ‘গণতন্ত্র সবচেয়ে নিকৃষ্ট সরকারব্যবস্থা। তবু যত সরকারব্যবস্থা আছে, তার মধ্যে এটাই শ্রেয়।’
পূর্ব ইউরোপের এই চলমান সংকটে এই প্রবণতার নেতিবাচক দিকটি উন্মোচিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আমাকে বলেছেন, ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ায় আধুনিকায়ন হয়েছে, এর বাজার উন্মুক্ত হয়েছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পুতিন ও কেজিবির সাবেক সদস্যদের হাতে পড়ে রাশিয়া আবারও কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠেছে। রাশিয়া এখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমার্থক হয়ে উঠেছে, যেটি ছিল কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রগুলোর শিরোমণি। এই কর্তৃত্বপরায়ণ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে ২৩ বছর আগে রাশিয়া সরে এসেছিল। আর রাশিয়ার বর্তমান অতি জাতীয়তাবাদের মূলে রয়েছে সেই সোভিয়েত কর্তৃত্বপরায়ণতার যুগে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত প্রাধান্য নতুন করে বিস্তার করা।
পুতিন সেই কল্পিত গৌরবময় অতীতের স্বপ্নে বিভোর। তিনি জানেন, তাঁর দেশের আশপাশে যে জায়মান গণতান্ত্রিক দেশগুলো রয়েছে, সেগুলো তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তাই পূর্ব ইউরোপ এমন এক সংকটে পড়েছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময়কার সংকটের সঙ্গে তুলনীয়। বাস্তবে ১৯৩৯ সালের পর পূর্ব ইউরোপ এরূপ সংকটের মুখোমুখি হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি যেমন নিজের দখল হওয়া ভূমি পুনরুদ্ধারে ও প্রতিশোধের নেশায় আগ্রাসী হয়ে উঠেছিল, ঠিক তেমনি এবার রাশিয়াও আগ্রাসী হয়ে উঠছে।
ইউক্রেন-সংকট সৃষ্টি আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শতবর্ষ পূর্তি প্রায় একই সময়ে ঘটল। বিতর্কিত লেখক ও অর্থনীতির ইতিহাসবিদ নিয়াল ফার্গুসনও এরূপ একটি মিল দেখতে পাচ্ছেন। প্রথম মহাযুদ্ধে প্রায় ১৭ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। এর কারণেই ১৯৩০-এর দশকে যুদ্ধংদেহী, অতি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগুলোর জন্ম হয়; যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ফার্গুসন আরও বলেছেন, মিল থাকলেও সময় অনেক পাল্টে গেছে, আবার ভিন্নতাও আছে অনেক। ইতিহাস কোনো অনিবার্যতার ব্যাপার নয়, এটা পছন্দের ব্যাপার।
আমাদের প্রশ্ন তুলতে হবে, ২০ শতকের শেষ ভাগে ‘ইতিহাসের শেষ’ দেখার পর একুশ শতকের শুরুর দিকে গণতন্ত্র আবার এমন পেছন দিকে হাঁটা শুরু করল কেন। কেউ বলবেন অর্থনীতি হোঁচট খাওয়ার কারণে সেটা হয়েছে, কেউ বলবেন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের রোগভোগের কারণে সেটা হয়েছে। এই গণতন্ত্র সেই দেশগুলোর জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রত্যাশা ও দাবি মেটাতে পারছে না। এরা এখন আর অনুসরণ করার মতো কিছু নয়—হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী যেমনটা বলেছেন। কিন্তু রাশিয়া, চীন ও তুরস্কেও এমন কিছু হচ্ছে না। জনগণ গণতন্ত্রের দাবি করে, গরিবেরা স্বাধীনতার দাবি করে, আইনের শাসন ও সুযোগ দাবি করে।
না, উত্তরটা গণতন্ত্রের কমজোরির মধ্যে নিহিত নয়। কর্তৃত্ববাদের পথে পুনরায় হাঁটার ব্যাপারটা বেছে নেওয়ার ব্যাপার। যে দেশগুলো পিছিয়ে পড়ছে, তারা নিজেরাই গণতন্ত্র পরিহার করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার জোর করে ক্রিমিয়া দখলের আগ পর্যন্ত কোনো আগ্রাসী দেশ তার প্রতিবেশীর ওপর হামলে পড়েনি। তবে যে কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্র থেকে কোনো প্রদেশ বের হয়ে যেতে চেয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রটি জোর করে প্রদেশটিকে ধরে রেখেছে, সে ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়।
কিন্তু বহু রক্ত ও সম্পদের বিনিময়ে রাষ্ট্র থেকে কোনো প্রদেশ বেরিয়ে এলেই সে গণতান্ত্রিক হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেমন বাংলাদেশ, এটি একটি শিক্ষাও বটে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর দেশটির সরকার একদলীয় শাসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা এ লক্ষ্যে তার শেষ পদক্ষেপ। এনজিওগুলো নিয়ন্ত্রণেও নতুন আইন হচ্ছে। বিরোধীদের কণ্ঠ চেপে ধরা হচ্ছে। একসময় হয়তো বেছে নেওয়ার ব্যাপারটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে, যতক্ষণ না একটি সুসংবদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বিরোধী দল না আসছে। আমরা সে লক্ষ্যের জন্য অপেক্ষা করছি।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

উইলিয়াম বি মাইলাম: বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত।

No comments

Powered by Blogger.