কবি শামসুর রাহমান by বিমল গুহ

কোন শিল্পই জোর করে সৃষ্টি করা যায় না। শিল্প তার স্বকীয় আদল নিয়ে স্রষ্টার মনে আপনা থেকেই সৃষ্টির পথ করে নেয়। একজন কবিও কবিতাকে অবলম্বন করে জীবনের নির্যাস ছেকে নিয়ে পাঠককে তার অংশী করে নেন। এই শিল্পের পথ স্বত:সিদ্ধ, স্বত:স্ফূর্ত। তা হয়ে ওঠার বিষয়। বিষয়টা সহজ করে বললে বলতে হয়- একজন কবি যখন লিখেন তখন তিনি নিমগ্নতার চূড়ান্ত স্থানে অবস্থান করেন। তাঁর মনের স্থিরতা যখন একটা বিন্দুতে গিয়ে পৌঁছে; তখন কবির কলমে একটি কবিতা লেখা হয়ে ওঠে। এটা সাধনা। এই সাধনার স্তর, আর আধ্যাত্মিক সাধনার স্তর সমান নিমগ্নতার, সমান শুদ্ধতার। এই স্তরে যতক্ষণ তিনি থাকেন, ততক্ষণই তিনি কবি। কেউ কেউ সার্বক্ষণিক কবি, কেউ আবার খণ্ড-সময়ের। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে সার্বক্ষণিক লেখক/কবি হওয়া দূরূহ ব্যাপার। হাতে গোনা কেউ কেউ আছেনও বটে। শামসুর রাহমান চাকুরি করলেও সাহিত্যসাধনার পথে ছিলেন সার্বক্ষণিক। আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। বিপুল তাঁর কাব্যসম্ভার, বিশাল তাঁর কবিতার ক্যানভাস। লেখার সময়, জীবনকালও পেয়েছেন দীর্ঘ। তাঁর লেখার গতি কখনো শ্লথ হয়নি। এ এক অবাক ব্যাপার যে, জীবনের কোন বাধাই তাঁর কাছে বাধাস্বরূপ হয়ে আসেনি। তাঁর লেখার বিস্তার দেখে কেউ কেউ ভিন্ন মন্তব্যও করেছেন কখনো কখনো। তাঁর কাছে তা পরিগণ্য বিষয় ছিলো না কখনো। নদীর গতির মতোই বেগবান তাঁর চেতনার স্রোত। আনন্দে বিগলিত হয়েছেন, বেদনায় কাতর হয়েছেন, মানুষের বিপদে ব্যথিত হয়েছেন, জন-অধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার হয়েছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন- এই কবি। এইসব বিষয়কে চৈতন্যে জারিত করে লিখেছেন অমর পংক্তিমালা। একজন বড় মাপের মানুষও ছিলেন তিনি।
কবির মানস গঠন হয়েছে কিশোর বয়সেই। তাঁর কথায়-‘আমি কিভাবে কবিতার পথে এসেছি, সেটা বলা মুশকিল। কেননা আমি কোনো প্ল্যান করে- মানে কোমর বেঁধে কবিতা লিখতে বসিনি, এটা অনেকটা হঠাৎ পেয়ে যাওয়া ধনের মতো। ...আমাদের মহল্লাতে একটি খ্রিস্টান পরিবার ছিল- তাদের একটা লাইব্রেরি ছিল। সেই লাইব্রেরিতে মহল্লার কেউ যেত না- আমিই বোধ হয় সেই লাইব্রেরিতে প্রথম বহিরাগত। সেখানে আমি পুরানো বাঁধানো ‘প্রবাসী’ দেখতে পাই এবং আরো কিছু কিছু বই পাই। আমার ক্ষুধা সে-লাইব্রেরি মেটাতে পারেনি। তখন পাটুয়াটুলির কাছে ব্রাহ্মসমাজের একটা লাইব্রেরি ছিল। সেটা হল- ‘রামমোহন লাইব্রেরি’। আমি সেই লাইব্রেরির সদস্য হয়ে গেলাম। সেখানেই আমার প্রকৃত পাঠ শুরু হল। সেখানেই আমি রবীন্দ নাথ, বঙ্কিমচন্দ , শরৎচন্দ এবং আরো দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনা পড়ার সুযোগ পাই। এভাবেই আমার কিছু মানস গঠন হয়েছে। তারপর হঠাৎ একদিন ১৯৪৮ সালে, আমার কি মনে হল- আমি লিখে ফেললাম কিছু আর কি- একটি কবিতা’! কবিতাটি ছাপা হয়- ‘সোনার বাংলা’ নামের সাপ্তাহিক পত্রিকায়। সেই শুরু কবির যাত্রা, বাংলা ভাষার অন্যতম শীর্ষকবি শামসুর রাহমানের। করেছেন- বাঙালি জাতির স্বপ্নচৈতন্য, উত্থান ও জীবনপ্রবাহের ধারাবাহিক ঐতিহাসিক রূপায়ন। নদীর গতি যেমন প্রকৃতি অনুসারী, সাহিত্যের গতিও তেমনি সমাজ-প্রকৃতি অনুগামী। স্বাভাবিক এর পথচলা, নিরন্তর এর যাত্রা সামনের দিকে। এই পথচলায় বাংলা কবিতার বিপুল আয়তনে খরস্রোতা নদীর মতোই বিশাল রেখা টেনে এগিয়ে গেছেন কবি শামসুর রাহমান।
সাতচল্লিশের ভারত-বিভক্তির পূর্বে ঊনিশ শতকের শুরু থেকে যে-বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিকাশ লাভ করেছিলো, তাতে স্বভাবতই নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের সৃষ্টিতে উল্লসিত বোধ করেছে অনেকে। পাকিস্তান সৃষ্টির পরে-পরে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন ও সাহিত্যশিল্পে শুরু হয় নতুন উদ্দীপনা। সেই সময়ে ও তৎপরবর্তীকালে এই অঞ্চলে, তৎকালীন পূর্ব বাংলার কবিতায় দ্বিমুখী ধারার আর্বিভাব ঘটে। একটি ধারা ইসলামী মূল্যবোধকে লালন করে এগোতে থাকে: এঁরা পাকিস্তানি আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলা সাহিত্য ইসলামী চেতনা প্রবর্তনের জন্য উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। বিভাগপূর্ব কালের ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’ ও ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’-এর আদর্শকে এঁরা বহন করেছিলেন। একই সময়কালে কারো কারো কবিতায় অসাম্প্রদায়িক ও তিরিশোত্তর নতুন কবিতার লক্ষণ প্রত্যক্ষযোগ্য হয়ে ওঠে। এভাবে দিন দিন প্রগতিশীল ধারাটি বিকশিত হতে থাকে, আর প্রগতিবিরোধী ধারাটি একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এর পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকে এ বাংলার কাব্যস্রোত আরো বেগবান হতে থাকে। কবি শামসুর রাহমান এই সময়ের কবিদের মধ্যে অগ্রসারিতে ছিলেন।
কাল-পরিক্রমণের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা সাহিত্যের এই গতিতে কখনো শতক-দশকওয়ারী বিভাজন করলেও, তা কোন প্রকৃত কবির কাব্যযাত্রায় তেমন প্রভাব ফেলে না। দশওয়ারী বিভাজন সচেতন পাঠকের কাব্যবিচারের সুবিধার্থেই কেবল করা হয়ে থাকে। প্রকৃত কবিতার পাঠকের কাছে তার কোন আলাদা অর্থ নেই। ভালো কবি সবসময়ই ভালো কবি। সেই খণ্ডিত পরিমণ্ডল অতিক্রম করে শামসুর রাহমান উঠে এসেছেন সমগ্র বাংলা কবিতার শীর্ষ সারিতে। শামসুর রাহমানের কবিতা মানে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বাঙালি জীবনাচরণের ধারাবাহিক ইতিহাস। তিনি তাঁর কবিতায় রূপায়ন করেছেন বাঙালি সমাজ ও সভ্যতার ইতিহাস। আমাদের জাতীয় জীবনে রবীন্দ -নজরুল যেভাবে প্রতিদিনকার জীবনযাপনের সাথে স¤পৃক্ত, শামসুর রাহমানের কবিতাও তাই। আমাদের জাতীয় জীবনের সকল আয়োজনে শামসুর রাহমানের কবিতার উজ্জ্বল উপস্থিতি থেকে তা সহজে অনুমান করা যায়। সচল কবি হিসেবেই পরিণত বয়সে জীবন অতিক্রান্ত করেছেন তিনি। লিখে গেছেন আমৃত্যুকাল্, তাঁর প্রত্যয়ও তা-ই ছিলো। জীবৎকালে,যোগ্য মর্যাদাও পেয়েছেন, নিজের অবস্থানও দেখে যেতে পেরেছেন। কম কবির এই সৌভাগ্য হয়! শামসুর রাহমান তাঁর ‘নিজ বাসভূমে’ কাব্যগ্রন্থে ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন এই বলে যে, ‘যদি বাঁচি চার দশকের বেশি/ লিখবো।/ ...যদি বেঁচে যাই একদিন আরো/ লিখবো’। হ্যাঁ তাঁর ইচ্ছা পূরণ হয়েছে, তিনি আমাদের জন্য কবিতার জগৎই শুধু সম্প্রসারণ করে যাননি, সম্প্রসারণ করেছেন সাধারণের কাছে কবিতার গ্রহণযোগ্যতা এবং কবিদের সামাজিক মর্যাদা। নিজের মর্যাদার প্রতিও তিনি ছিলেন- টান টান। তিনি সেই মর্যাদা অর্জন করেছেন এবং আমাদের দেখিয়ে গেছেন।
কবি স্বভাবে ছিলেন অতি বিনয়ী। কোন গরিমা দেখেনি কেউ- এই মাপের একজন কবির মধ্যে। ছোটবড় সবার বন্ধু। একজন অতি তরুণ কবিকেও কাছে টেনে নিতেন, উৎসাহিত করতেন লেখার ব্যাপারে। তাঁর কাছে যেতে কোন তরুণ কবির সাহস সঞ্চয় করার প্রয়োজন হয়নি। তবুও বলতে হয়- বিশাল কাব্যপরিমণ্ডল গড়ে তোলার এই কৃতি-মানুষের কাব্যবিচার করবে সময়। তবে এটুকু বলা যায় যে, শামসুর রাহমানের উচ্চারণ ছিলো হৃদয়-সংবেদী, সমাজলগ্ন ও কালজয়ী। শিল্পের সঙ্গে সাধনাকে যুক্ত করতে চেয়েছেন তিনি, যে-সাধনা অনিবার্যভাবে সৃজনশীল ও কালের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়িয়েছে কাল-পরিক্রমায়।

No comments

Powered by Blogger.