বাকশাল বাদ দিয়ে তাহেরের জাতীয় সরকার? by মহিউদ্দিন আহমদ

১৫ আগস্ট সকালে মুহসীন হলের ছাত্র নূর মোহাম্মদ ঢাকা গণবাহিনীর উপপ্রধান আবুল হাসিব খানের কাছে ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেনের একটা চিরকুট নিয়ে আসেন। চিরকুটে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের অফিসে ঢাকা নগর গণবাহিনীর জরুরি সভা হবে বলে উল্লেখ ছিল। সভা শুরু হলে আনোয়ার হোসেন উপস্থিত সবাইকে বলেন, ‘ভাইজান (লে. কর্নেল আবু তাহের) সকালে রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলেন। তিনি মেজর ডালিমকে বকাঝকা করে বলেছেন, ‘...র মেজর হয়েছ, এখন পর্যন্ত একটা মার্শাল ল প্রক্লেমেশন ড্রাফট করতে পারলে না। জানো, কাল ইউনিভার্সিটিতে কারা বোমা ফাটিয়েছিল? দে আর মাই বয়েজ।’
লে. কর্নেল আবু তাহের মেজর রশিদের অনুরোধে সকাল নয়টায় ঢাকা বেতারকেন্দ্রে যান। সেখানে তিনি খোন্দকার মোশতাক আহমদ, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, মেজর ডালিম ও মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে দেখতে পান। তাঁর পরামর্শে ডালিমরা সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধানকে বেতার ভবনে নিয়ে আসেন অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে বিবৃতি দেওয়ার জন্য। তিনি খোন্দকার মোশতাককে পাঁচটি প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবগুলো ছিল:
১. অবিলম্বে সংবিধান বাতিল করতে হবে;
২. সারা দেশে সামরিক আইন জারি এবং এর প্রয়োগ করতে হবে;
৩. দলনির্বিশেষে সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে;
৪. বাকশালকে বাদ দিয়ে একটি সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে;
৫. অবিলম্বে একটি গণপরিষদ তথা পার্লামেন্টের জন্য সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
সামরিক শাসন জারির দাবি ছিল তাহেরের একান্ত নিজস্ব। এ বিষয়ে তিনি গণবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ড কিংবা জাসদের পার্টি ফোরামের সঙ্গে আলোচনা করেননি এবং এসব প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য পার্টি তাঁকে কোনো ম্যান্ডেট দেয়নি। প্রকৃতপক্ষে এই প্রস্তাব ছিল জাসদের মূলনীতির সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। বিশেষ করে, সামরিক আইন জারির প্রস্তাবটি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা যেকোনো সুস্থ রাজনৈতিক দলের জন্যই অপমানজনক এবং প্রগতিশীল রাজনীতির চেতনাবিরোধী। তাহের সব সময় শেখ মুজিবের ‘ফ্যাসিবাদী’ রাজনীতির বিরোধী ছিলেন এবং তাঁর সরকারের উৎখাত চাইতেন। জাসদও একই দাবি করেছে। কিন্তু জাসদ কখনোই দেশে সামরিক শাসন চায়নি।
সন্ধ্যায় খোন্দকার মোশতাক আহমদ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাহের উপস্থিত ছিলেন। এরপর তিনি মেজর খোন্দকার আবদুর রশিদসহ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে বঙ্গভবনেই বৈঠক করেন। বৈঠকের একপর্যায়ে তিনি সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকেও ডেকে আনেন। দুই দিন পর ১৭ আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নঈম জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় যান পরিস্থিতি সম্পর্কে আঁচ করতে। ১৯৭১ সালে নঈম ১১ নম্বর সেক্টরে তাহেরের সহযোদ্ধা ছিলেন এবং প্রায়ই তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন। তাহের আক্ষেপ করে নঈমকে বললেন, ‘ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া।’
১৫ আগস্টের পর গণবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি লিফলেট প্রচার করা হয়। লিফলেটের শিরোনাম ছিল, ‘খুনি মুজিব খুন হয়েছে—অত্যাচারীর পতন অনিবার্য।’
শেখ মুজিব যখন নিহত হন, জাসদের প্রধান নেতা সিরাজুল আলম খান তখন কলকাতার ভবানীপুরে চিত্তরঞ্জন সুতারের বাড়িতে। চুয়াত্তরের ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি হলে সিরাজুল আলম খান ভারতে চলে যান। মাঝে দুবার তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। শেষবার পঁচাত্তরের জুলাই মাসে। তাঁর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছিল। ভিসা নবায়নের জন্য তিনি কলকাতায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করেন। ১২ আগস্ট তঁাকে জানানো হয়, তাঁর পাসপোর্ট বাংলাদেশ সরকার বাতিল করে দিয়েছে।
ফলে তিনি বাংলাদেশে ‘পারসন নন গ্রাটা’ বা অবাঞ্ছিত ব্যক্তি হয়ে যান। সচরাচর তিনি বেলা ১১টা-১২টা পর্যন্ত ঘুমান। সকাল ১০টার দিকে সুতারের স্ত্রী মঞ্জুশ্রী দেবী তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে শেখ মুজিবের মৃত্যুসংবাদ দেন।
সিরাজুল আলম খান শেখ মুজিবকে জানতেন ১৯৬১ সাল থেকে। সুখে-দুঃখে বিপদে-আপদে তিনি শেখ মুজিবের ছায়াসঙ্গী ছিলেন ইতিহাসের একটা বিশেষ পর্বে, যখন বাংলাদেশ পাকিস্তানি উপনিবেশের জঠরে থেকে জেগে উঠছে। বেগম মুজিবও তাঁর ওপর আস্থা রাখতেন। শেখ মুজিব যখন জেলে, বিশেষ করে ১৯৬৬-৬৯ সালে, বেগম মুজিবের মাধ্যমে শেখ মুজিব ও সিরাজের যোগাযোগ হতো। সিরাজ যে কথা শেখ মুজিবকে বলতে পারতেন না, সে কথা বেগম মুজিবকে দিয়ে বলাতেন। বেগম মুজিব যে কথা স্বামীকে বলতে পারতেন না, সিরাজকে দিয়ে তা বলাতেন। খবরটা শুনে সিরাজুল আলম খান হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের শেখ মুজিবের প্রতি আনুগত্য যতটা ছিল, ততটা ভালোবাসা ছিল না। শেখ মুজিব এটা জানতেন এবং সিরাজুল আলম খানের ওপর নির্ভর করতেন। শেখ মুজিবের কাল্ট তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন সিরাজুল আলম খান। মুজিব তাঁকে একরকম ব্লাংক চেক দিয়েছিলেন। এককথায় সিরাজ ছিলেন শেখ মুজিবের সবচেয়ে ‘আস্থাভাজন শিষ্য’। এটাই ছিল সিরাজুল আলম খানের ক্ষমতার ভিত্তি। দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ায় দুজনই দুর্বল হয়ে পড়েন।
শেখ মুজিব নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে সিরাজুল আলম খান দুঃখ পেয়েছিলেন সন্দেহ নেই। তবে তিনি মনে করতেন, এটা ছিল অনিবার্য। মুজিব নিজেই এই পরিণতি ডেকে এনেছিলেন।
অক্টোবরে সিরাজুল আলম খান কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। বাংলাদেশ তখন অনেকটাই বদলে গেছে।

l প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিতব্য বই জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি থেকে নেওয়া অংশবিশেষ।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.