সম্প্রচার নীতিমালা বাতিল করুন by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা এ রকম সমালোচনার মুখে পড়বে, সরকার হয়তো তা ভাবেনি। নীতিমালা রচনার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন ছাড়া কেউ এই নীতিমালার সমর্থনে কথা বলেননি। এমনকি সরকারের অনুগ্রহভোগী অন্যান্য সেক্টরের নেতারাও এই নীতিমালার সমর্থনে এগিয়ে আসেননি। সরকারঘেঁষা বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিকেরাও এই নীতিমালা সমর্থন করেননি। তাঁরাও বুঝতে পেরেছেন, এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে টেলিভিশনের ‘খবর’ মোটেও পেশাদারি সাংবাদিকতার পর্যায়ে থাকবে না। একটি কৃত্রিম অনুষ্ঠান হবে মাত্র। এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে টিভির সাম্প্রতিক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘টক শো’ (নীতিমালার ভাষায় আলোচনা অনুষ্ঠান) অনাকর্ষণীয় হয়ে যাবে। টক শোর প্রধান আকর্ষণ হলো একটি ঘটনা বা ইস্যু নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা ও তর্ক। সেখানে সরকারপক্ষ, বিরোধীপক্ষ, নির্দলপক্ষ, বিশেষজ্ঞ সবাই থাকেন। আরও থাকেন সাধারণ মানুষ, যাঁরা টেলিফোনের মাধ্যমে মতামত ব্যক্ত করেন। গণতন্ত্রের এই দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে আর কোথাও দেখা যায় না।
আমাদের জাতীয় সংসদের বিতর্কও একদলীয়। রাজনীতিমনস্ক মানুষ জাতীয় সংসদের বিতর্ক শুনে মোটেও আনন্দ পান না। কারণ, সেখানে নেতৃবন্দনা, স্তুতি ও বিরোধী দলের সমালোচনাই প্রাধান্য পায়। জাতীয় সংসদের বিতর্কের চেয়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের একাডেমিক বিতর্ক অনুষ্ঠান অনেক বেশি গঠনমূলক ও উপভোগ্য। তবে এটা ঠিক যে টিভি টক শোর কাঠামো, অতিথি নির্বাচন, বিষয়বস্তু ইত্যাদি নিয়ে আরও চিন্তাভাবনার সুযোগ রয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই অনুষ্ঠানকে জনগণের আরও কাছাকাছি আনা যায়।
সম্প্রচার নীতিমালায় টক শো প্রসঙ্গে এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যার ফলে স্বাধীন ও স্বাভাবিক গতিতে টক শো করা আর সম্ভব হবে না। নীতিমালার নানা ধারা অনুযায়ী টক শোর আলোচকদের হয়রানি করার সুযোগ রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ভয়ে অনেক চ্যানেল-মালিক টক শোর স্পষ্টভাষী, সাহসী, সরকারের সমালোচক ও জনপ্রিয় আলোচককে আর আমন্ত্রণ জানাবেন না। (ইতিমধ্যে কয়েকজন অতিথি নিষিদ্ধ হয়েছেন।) ফলে টক শো দর্শকদের কাছে আকর্ষণ হারাবে। তাতে সরকারের লাভ। তথ্য মন্ত্রণালয়ের চাপ বাড়বে চ্যানেল-মালিকদের ওপর। তাঁরা ব্যবসায়ী, রাজনীতিক নন। কাজেই তাঁদের ব্যবসার স্বার্থে তাঁরা এই চাপের কাছে হয়তো নতিস্বীকার করবেন।
টক শোতে আলোচকেরা স্বাধীনভাবে তাঁদের মতামত প্রকাশ করেন। তা অব্যাহত থাকতে দিতে হবে। মতামতের কাউন্টার মতামত থাকতে পারে। সেটা এখনো প্রতি টক শোতে দর্শক-শ্রোতারা শুনছেন। তবে খবর ও টক শোতে ভুল তথ্য দেওয়ার কোনো সুযোগ রাখা উচিত নয়। কেউ ভুল তথ্য দিলে এবং তার প্রতিবাদ পাওয়া গেলে তা পরদিন ঠিক একই অনুষ্ঠানে প্রচার করতে হবে। ভুল তথ্য প্রচারের জন্য আলোচক ও উপস্থাপককে ক্ষমা চাইতে হবে। তবে মতামত বা বিশ্লেষণ দেওয়ার ব্যাপারে আলোচকেরা শতভাগ স্বাধীন।
বাংলাদেশে প্রাইভেট টিভির ‘খবরও’ একটি আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। শুধু খবরকেন্দ্রিক পাঁচ-পাঁচটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেল রয়েছে। প্রতি ঘণ্টায় তারা খবর প্রচার করে। শোনা যায়, সব টিভি চ্যানেলই খবর প্রচার থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ বেশি আয় করে থাকে। খবর টিভি চ্যানেলের কাছে সবচেয়ে লাভজনক অনুষ্ঠান। খবর নিয়ে সমালোচনা করার অনেক দিক আছে, যা আজ আলোচনা করব না। সম্প্রচার নীতিমালায় খবর সম্পর্কে এমন কিছু বিধান রাখা হয়েছে, যা অনুসরণ করতে গেলে খবরের কোনো আকর্ষণই আর থাকবে না। শুধু সরকারি সেমিনার, প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান ও সরকারের উন্নয়নের খবরই প্রচার করতে হবে। অবশ্য দুর্ঘটনার খবর প্রচার করতে বাধা আসবে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন, শ্রমিক সংগঠন—এদের কোনো আন্দোলনের খবর ও ছবি ‘খবরে’ আর দেখানো যাবে না। সেনা কর্মকর্তা, র্যাব, পুলিশ সদস্য—এঁদের কোনো অপকর্মের ‘খবর’ টিভিতে দেখানো যাবে না। এঁরা যে ভালো ভালো কাজ করছেন, শুধু সেগুলো দেখানো হবে। এই নীতিমালার রচয়িতারা হয়তো জানেন না ‘খবর’-এর সংজ্ঞা কী। কুকুর মানুষকে কামড়ালে তা খবর হয় না। মানুষ কুকুরকে কামড়ালে সেটাই খবর। তথ্য মন্ত্রণালয় এই নীতিমালার মাধ্যমে এ দেশের টিভি দর্শকদের একটি প্রিয় অনুষ্ঠানকে (খবর) অনাকর্ষণীয় ও অপেশাদারি করার একটা ব্যবস্থা করেছে। টিভির খবর যদি সত্যি সত্যি এ রকম পানসে হয়ে যায়, তাহলে দর্শক-শ্রোতারা আবার সত্তর-আশির দশকের মতো বাংলাদেশের খবর শোনার জন্য বিবিসি (বাংলা) ও ভয়েস অব আমেরিকার দ্বারস্থ হবেন। মানুষকে তো দেশের প্রকৃত খবর জানতে হবে।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের আমলারা এই নীতিমালা করার সময় চিন্তা করেননি দেশে এখন তথ্য প্রচারের জন্য অনলাইন পত্রিকা, নিউজ পোর্টাল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার, ইউটিউব ও নানা রকম প্রযুক্তি রয়েছে; যা ইতিমধ্যে দেশে ও বিদেশে লাখ লাখ বাংলাদেশি ব্যবহার করছেন। যার মাধ্যমে শুধু এসব তথ্য নয়, অডিও ও ভিডিও ফুটেজও প্রচারিত হচ্ছে। তথ্য মন্ত্রণালয় এই নীতিমালা করে হয়তো দেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে দিতে পারবে।
জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় এমন বহু কথা রয়েছে, যা অপ্রয়োজনীয় ও বাহুল্য। এগুলো নীতিমালায় রাখার প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশের গণমাধ্যমকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তথ্য মন্ত্রণালয়কে শেখাতে হবে না। যদি কোনো টিভি চ্যানেল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো অনুষ্ঠান করে, তাদের দেশের প্রচলিত আইনে দণ্ড দেওয়া যায়। বাংলাদেশের সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ মান্য না করে এ দেশে কেউ গণমাধ্যম পরিচালনা করে না।
সম্প্রচার নীতিমালা ইতিমধ্যে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। নীতিমালা নিয়ে দেশে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। তথ্য মন্ত্রণালয় ও সরকারের অনুগ্রহভোগী বিশেষজ্ঞরা এই সমালোচনার লাগসই জবাব দিতে পারেননি। এ রকম অবস্থায় সরকার কী করবে? কয়েকটি উপায় আছে: ১. সরকার একটি সংসদীয় কমিটি করে নীতিমালাটি পর্যালোচনার জন্য পাঠাতে পারে ২. সংসদীয় কমিটি প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নিয়ে এর ৭৫ শতাংশ বাতিল করে ২৫ শতাংশ রেখে নতুন করে একটি সংক্ষিপ্ত নীতিমালা রচনা করতে পারে, যা গণতন্ত্রমনা ও দর্শক-শ্রোতাবান্ধব নীতিমালা হবে। ৩. জনগণের আস্থাভাজন, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ, কোনো দলের বশংবদ বা অনুগ্রহভোগী নয়, স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্বদের নিয়ে ‘জাতীয় সম্প্রচার কমিশন’ গঠন করে তাঁদের নীতিমালা রচনার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। সরকার বা দলের বশংবদ ব্যক্তিদের নিয়ে জাতীয় সম্প্রচার কমিশন গঠন করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। আবার সমালোচনা শুরু হবে। তাঁদের কেউ মানবেন না।
কিন্তু সরকার গায়ের জোরে এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে চাইবে। তখন কী হবে? সরকার যদি বাস্তবতা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আন্দোলন ছাড়া বিকল্প তো কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে শিল্পী, দর্শক ও শ্রোতাদের সম্মিলিত বিক্ষোভ, বয়কট, কর্মবিরতি, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে এই নীতিমালা প্রত্যাহারে সরকারকে বাধ্য করা ছাড়া আর পথ নেই। এই নীতিমালায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন টিভির দর্শক ও শ্রোতারা। কাজেই দর্শক-শ্রোতাদের ঠিক করতে হবে তাঁরা প্রাইভেট টিভিতে কী ধরনের অনুষ্ঠান চান। তাঁরা এখনকার মতো খবর ও টক শো দেখতে চান কি চান না। নাকি তারা ‘বিটিভির’ মতো খবর ও টক শো দেখতে চান। এই সংকটটি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির নয়; এটা দেশের সাধারণ টিভি দর্শক ও শ্রোতার সংকট। দর্শক-শ্রোতারা এই নীতিমালার বিরুদ্ধে সোচ্চার না হলে সরকার আরও নানা শর্ত দর্শকদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে। সরকার খুব শক্তিশালী, সন্দেহ নেই। কিন্তু দর্শক-শ্রোতা অর্থাৎ সাধারণ মানুষ সরকারের চেয়েও শক্তিশালী—এ কথা প্রমাণ করার সময় এসেছে।

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.