আমরা কি এই চট্টগ্রাম চেয়েছিলাম? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম প্রায়ই বক্তব্য-বিবৃতিতে বলে থাকেন, সাম্প্রতিক কালে চট্টগ্রাম শহরের যে উন্নয়ন হয়েছে, স্বাধীনতার পর আর কখনোই তা হয়নি। তাঁর পাঁচ বছর মেয়াদকালের এই উন্নয়ন চট্টগ্রামকে ৫০ বছর এগিয়ে দিয়েছে—এমন দাবিও করেন তিনি। বর্তমান সরকারের কাছ থেকে দেনদরবার করে এই নগরের উন্নয়নের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ আনতে পারার সাফল্যে তিনি উজ্জীবিত। অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মন্জুর আলম তাঁর মতো উচ্চকণ্ঠ নন। দলীয় লোক নন বলে সরকারের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ পান না। কিন্তু তাঁর আমলে নগরের উন্নয়ন নিয়ে তাঁকেও যথেষ্ট সন্তুষ্ট মনে হয়।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও সিটি করপোরেশনের এই আত্মতৃপ্তির সঙ্গে এখানকার নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিটা কিছুতেই যেন মিলছে না। যতই উন্নয়নের ফিরিস্তি দেওয়া হোক না কেন, এই শহরটা ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে—এমন একটি উপলব্ধি দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়েছে নগরবাসীর মধ্যে। সাধারণ মানুষকে কিছুতেই সন্তুষ্ট করা যায় না, তাঁরা দৃশ্যমান উন্নতির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখেন ইত্যাদি নানা রকম নিন্দা-মন্দ হয়তো করা যায় ‘অকৃতজ্ঞ’ নগরবাসীকে। কিন্তু বর্তমান সরকারেরই একজন মন্ত্রী যখন এই শহরে সফরে এসে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে,’ তখন বিষয়টাকে আর সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘...কয়েক বছর আগেও এমন ছিল না। যেদিকে তাকাই ময়লার স্তূপ। দুর্গন্ধের জন্য হাঁটা যায় না। বিলবোর্ডের জন্য সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায় না। বিলবোর্ডে ঢেকে গেছে সবুজ আর পাহাড়।’ কয়েক বছর আগে বলতে তিনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সময়কালের কথা। এ কথা ঠিক যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একগুঁয়েমি ও নাগরিক সমাজের দাবি উপেক্ষা করে নানা উদ্যোগ নেওয়ার কারণে মহিউদ্দিন চৌধুরীর যথেষ্ট সমালোচনা করেছি আমরা। কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না, তাঁর সময়ে চট্টগ্রাম শহর সত্যিকার অর্থেই একটি পরিচ্ছন্ন নগরে পরিণত হয়েছিল।
যোগাযোগমন্ত্রীর বক্তব্যের পরদিনই করপোরেশনের জরুরি বৈঠকে আক্ষেপ করে মেয়র মন্জুর আলম বলেছেন, জাইকার অর্থায়নে ওয়াসা পানির পাইপ বসাতে রাস্তা কাটছে। এই কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত রাস্তা মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া সিডিএর সড়ক উন্নয়ন, উড়ালসড়ক ও নালার নির্মাণকাজ চলমান থাকায় রাস্তাগুলোর অবস্থা বেহাল হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো নির্ধারিত সময়ে রাস্তা হস্তান্তর না করায় সব দায়ভার সিটি করপোরেশনকে বহন করতে হচ্ছে।
এ বক্তব্যে মেয়রের অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। এখানেই সাবেক মেয়র মহিউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য। বলা বাহুল্য, সমন্বয়হীনতা এই নগরে, এমনকি দেশের সব কটি বড় নগরে উন্নয়নকাজের সবচেয়ে বড় বাধা। যেমন সিডিএর সড়ক সম্প্রসারণ কাজের জন্য দীর্ঘদিন বিভিন্ন এলাকার মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এই দুর্ভোগ তাঁরা মেনে নেন সম্প্রসারিত সড়কে নির্ঝঞ্ঝাট যাতায়াতের সুফল ভোগ করবেন ভেবে। কিন্তু সড়ক সম্প্রসারণ ও নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার অব্যবহিত পরই যেন ওয়াসা কর্তৃপক্ষের নতুন করে রাস্তা খোঁড়ার কথা মাথায় আসে। কখনো বিদ্যুৎ, কখনো টেলিকম কোম্পানি, কখনো বা ওয়াসার পালাক্রমে রাস্তা খোঁড়া ও মেরামতের এই চিরন্তন দৃশ্য থেকে মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর। এ কারণেই হয়তো মেয়রের নেতৃত্বে সিটি গভর্নমেন্ট গঠনের দাবি উঠেছিল একসময়। কিন্তু সে দাবি পূরণ হয়নি, সমন্বয়হীনতার দুর্ভোগ থেকেও মুক্তি মেলেনি নাগরিকদের। তবে মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে তাঁর একরোখা ভাবমূর্তির কারণেই হোক বা সহজাত নেতৃত্বগুণের কারণেই হোক, উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন তিনি।
আজ বিলবোর্ডের কথা উঠেছে। যত্রতত্র বিলবোর্ডের যন্ত্রণা কী পরিমাণ অসহনীয় হয়ে উঠেছে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো দীর্ঘদিন ধরে এর প্রতিবাদে তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় এক কলাম তিন ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা খালি রেখে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিলবোর্ডগুলোর অধিকাংশের মালিকানা ভোগ করছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা বা ক্যাডাররা। কিন্তু বর্তমান মেয়র এখানেও অসহায়। তিনি কারও সঙ্গেই বিরোধে জড়াতে চান না কিংবা সে সামর্থ্যও হয়তো তাঁর নেই।
অন্যদিকে, সিডিএ চেয়ারম্যান আত্মতৃপ্তিতে ভুগছেন। তাঁর সময়কালে এই নগরের উন্নয়নকে ‘যুগান্তকারী’ বলতে ভালোবাসেন তিনি। বেশ কিছু রাস্তা সম্প্রসারিত হয়েছে এই সময়ে। কিন্তু সম্প্রসারিত এলাকাগুলো হকার ও ব্যবসায়ীদের দখল থেকে মুক্ত করতে না পারলে তার সামান্যই সাধারণের কাজে আসবে। ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে তাঁর আমলে নির্মিত বহদ্দারহাট উড়ালসড়ককে উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতে চান তিনি। কিন্তু সুবৃহৎ উড়ালসড়কে গুটিকয় গাড়ির চলাচল আর তার নিচেই বহদ্দারহাট মোড়ের তীব্র যানজটের চিত্রটি তাঁর দাবিকে সমর্থন করে না। অর্থাৎ পরিকল্পনায় গলদ ছিল। বিশেষজ্ঞরাও এ কথাটিই বলছেন। কিন্তু তিনি মানতে নারাজ। নারাজ বলেই নতুন উড়ালসড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। পরিকল্পনাধীন রয়েছে আরও কয়েকটি।
সমস্যা হচ্ছে, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ভিন্নমত ও পরামর্শ গ্রহণ করতে কখনোই রাজি নয়। ‘ফোরাম ফর প্ল্যান্ড চিটাগং’ (এফপিসি) নামের একটি সংগঠন রয়েছে এখানে। এরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়। স্থপতি, প্রকৌশলী, নগর পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে গঠিত এই সংগঠন প্রায়ই সভা-সেমিনার ইত্যাদি করে নগর উন্নয়ন নিয়ে তাদের মতামত ও পরামর্শ তুলে ধরে। কিন্তু তাদের গায়ে পড়া পরামর্শ কেউ কানে নেয় বলে মনে হয় না। বহদ্দারহাট উড়ালসড়ক নির্মাণের অনেক আগে থেকেই তারা এই ব্যয়বহুল প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে। ভবিষ্যতে আরও উড়ালসড়ক নির্মাণের পরিকল্পনাকে চমক ও অপচয় বলে অভিহিত করে এফপিসি বলছে, এর সিকি ভাগও যদি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যয় করা হয়, তাহলে এই নগর সম্পূর্ণ যানজট ুক্ত হবে। কথা হচ্ছে, হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের ডামাডোলে এফপিসির এই কম অর্থব্যয়ের পরামর্শ আদৌ কারও মনঃপূত হবে কি না। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, বেশি টাকার কাজের প্রতি বেশি আগ্রহ থাকার কারণ আছে অনেক।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.