দৃপ্ত অহংকার by রফিকুর রশীদ

লোকটার বুকের ভেতরে এক ধরনের অহংকার ছিল।
কিসের অহংকার?

সে কথা খোলাসা করে বলেন না কোথাও। তবে এ অহংকারের কথা তিনি কখনও জোর গলায় অস্বীকারও করেননি। বরং কদম ফোটার মতো করে সারা মুখে স্মিত হাসি ছড়িয়ে বিনম্র ভঙ্গিতে তিনি বলেন, এক আধটু অহংকার থাকা ভালো। চারপাশের মানুষ হিসাব মেলাতে বসে। সবাই জানে, অহংকার পতনের মূল। মরণের ফাঁদ পাতা থাকে অহংকারের ভেতরেই। এসবই তো এতদিন সবাই শিখে এসেছে ইশকুলে কিংবা সমাজে, সর্বত্রই। অথচ সূর্যখোলা গ্রামের হুজুর স্যার দিব্যি হাসতে হাসতে বলেন- অহংকার না থাকলে মানুষ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে কী করে! অনেকেরই ভাবনা হয়, হুজুর স্যারের মুখে মাথা উঁচু করার কথা আসে কেমন করে! গ্রামের ইশকুলের ধর্মীয় শিক্ষক তিনি। ছাত্রেরা হুজুর স্যার বললেও আশপাশের দশগ্রামে তিনি মওলানা সাহেব নামে পরিচিত। তিনি বলেন, মাথা উঁচু করার কথা! দু-একজন আবার সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ মিশিয়ে উৎকট একদিকে ইঙ্গিত করে- অমুসলিম হয়েও রবীন্দ্রনাথ মাথা নত করতে বলেছেন, আমার মাথা নত করে দাও হে প্রভু... আর মওলানা হয়ে উনি কিনা বলেন...।
এসব মন্তব্য কখনও কখনও ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে তার কানে যায়, তিনি হাসেন। তিনি বিশ্বাস করেন- সবার উপরে মানুষ সত্য এই মন্ত্রে। সৃষ্টির সেরা কাকে বলে? কোথায় সেই শ্রেষ্ঠত্ব? সেই শ্রেষ্ঠত্বের সন্ধান পেলে মাথা উঁচু না করে পারে মানুষ! ওই যে কাজী নজরুল বলেছেন, উন্নত মম শির; অহংকার না থাকলে চলে?
তাহলে কী সেই অহংকার মওলানা মুজিবুর রহমানের?
টাকা-পয়সা কি অর্থ-বিত্তের অহংকার তিনি পাবেন কোথায়? ওসব কি আদৌ তার আছে! হ্যাঁ, জন্মদাতা বাপের কাছে বিস্তর গল্প শুনেছেন এবং শৈশব-কৈশোরে তিনি নিজেও খানিক দেখেছেন- সীমান্তের ওপারে বাপ-দাদার যথেষ্ট জমি-জায়গা ছিল, সঙ্গে সামাজিক প্রতিপত্তি ছিল। দেশ ভাগের ছোবলে সেসব তলিয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার ছোট ভাইয়ের মৃতদেহ ওপারে ফেলে রেখে শেখ মোঃ আজিজুর রহমান রাতের অন্ধকারে জন্মভিটা ত্যাগ করে চলে আসেন এপারে সূর্যখোলা গ্রামে। দেশান্তরের এ অপমানে তিনি এতই মুহ্যমান হয়ে পড়েন যে, পাক পবিত্র এই নতুন দেশে একমাত্র পুত্র মুজিবুর রহমানকে সংসার বন্ধনে আবদ্ধ করে দেয়ার বছর খানেকের মাথায় নিজেকে গুটিয়ে নেন। বংশের পদবী ‘শেখ’-এর ব্যবহার নিয়ে মুজিবুর রহমানের অন্তরে নানা রকম দ্বিধা এবং সংশয় দানা বেঁধেছে। মক্তব মাদ্রাসায় পড়ার সুবাদে সার্টিফিকেটে শেখ মোঃ মুজিবুর রহমানই লেখা হয়েছে, কিন্তু পিতার আকস্মিক মৃত্যুর পর তার মনে হয়েছে- কোথায় সেই দোর্দণ্ড দাপুটে শেখ, এ দেশে তাকে কুকুর-বেড়ালও ইজ্জত দেবে না! এসব ভেবে নিজের নামের আগে শেখ ব্যবহারে একেবারেই উৎসাহ পান না। মনে মনে জিভ কাটেন আর নিজেকে শুধান- বেড়াল কখনও রাগ হয়? এ্যাঁ?
এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শেখ মুজিবের উত্থান তিনি কখনও হৃষ্টচিত্তে মেনে নিতে পারেননি। অথচ চোখের সামনেই দেখেছেন সেই এক নেতার নামে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথাও বিলক্ষণ শুনেছেন। হাতের মুঠোয় যুক্তি খুঁজে খুব বেশি জড়ো করতে না পারলেও তার প্রবল বিশ্বাস- শেখ মুজিবের পক্ষেই সম্ভব এই দেশ ভেঙে টুকরো করার ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দেয়া। নাহ্ নিজের নামের সঙ্গে এ দেশদ্রোহী নেতার নামের সাদৃশ্য দেখে মোটেই স্বস্তি পান না। কিন্তু অবেলায় তিনি কি-ই বা করতে পারেন- এফিডেভিট করে নিজের নাম বদলে ফেলবেন? সেও নাকি দুস্তর ঝামেলার কাজ। নিজের হাজার গণ্ডা কাজ ফেলে ওই অকাজের পেছনে সময় দেয়ার সময় কোথায় তার! এদিকে মওলানা ভাসানীর কাণ্ড দ্যাখ- এমনিতেই দেশের মানুষ ক্ষেপে আগুন, তিনি কিনা সেই স্ফূলিঙ্গে দেশলাইয়ের কাঠি ঠুকে দিতে চান। কী সাংঘাতিক কথা! একি একটা স্লোগান হল- জেলের তালা ভাঙবেন, শেখ মুজিবকে আনবেন! লুঙ্গি পাঞ্জাবি তালের টুপিতে মোড়া অত বড় নেতা, কেন মুজিবকে ছাড়া তার কি চলবে না? বাপরে বাপ! সারা দেশ অচল-টচল করে দিয়ে শেষমেশ শেখ মুজিবকে বাইরে এনে ঘটনা কী ঘটল! সে াতে ভাসা জনতার মধ্যে তোফায়েলের ঘোষণার বরাত দিয়ে তিনি হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু, আর ভাসানীর কী হল! মজলুম জননেতা হয়ে তিনি ভেসে চললেন এ ঘাটে ও ঘাটে।
না, বঙ্গুবন্ধুর পিতৃপ্রদত্ত নামের সঙ্গে নিজের নামের কাকতালীয় সাদৃশ্যের কারণে সূর্যখোলার হুজুর স্যার আনন্দিত হতে পারেননি, অহংকার আসবে কোত্থেকে?
তাহলে তার অহংকারের উৎস কী!
তবে কি শহীদপুত্র হাফিজুর রহমানকে ঘিরেই তার এত অহংকার?
পর পর তিন কন্যার পর হাফিজুর এসে পিতৃবক্ষের পুত্রতৃষ্ণা নিবারণ করে। মায়ের সীমাহীন আশকারা পেয়ে মাদ্রাসা লাইন ছেড়ে জেনারেল লাইনে লেখাপড়া করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সারা দেশে তখন ছাত্রসমাজের আন্দোলন তুঙ্গে। ৬ দফার সঙ্গে ১১ দফা যুক্ত হয়ে দেশের রাজনীতিতে মাত্রা এনে দিয়েছে অভিনব- চাই মুক্তি, চাই স্বাধীনতা। আন্দোলন ধীরে ধীরে অগ্রসর হয় এক দফার দিকে- স্বাধীনতার চেয়ে আর একটুও কম কিছু নয়।
হাফিজুর সেই স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজেকে নিঃশেষে উৎসর্গ করে হুজুর স্যারকে দিয়ে যায় বীর শহীদের পিতার সম্মান। সূর্যখোলার মুজিবুর রহমানের মাথা উঁচু করা অহংকার কি তবে এই পুত্রের জন্য?
ওই বিশেষ সম্মানটুকু ছাড়া পুত্র তাকে কী দিয়েছে?
একটি মাত্র পুত্র তার। কত না নিদ্রাহীন রাতের ঐকান্তিক প্রার্থনায় তাকে পাওয়া। হাফিজুরের মা প্রতি মাসের বেশ কয়েকটি দিনে রোজা করেছে, এশার নামাজ শেষে কেঁদে কেঁদে জায়নামাজ ভিজিয়েছে ওই একই প্রার্থনায়। বড় বোনেরাও চেয়েছে তাদের যদি একটা ভাই থাকত! এত প্রত্যাশার সন্তান হাফিজুর যা চেয়েছে তা-ই দেয়া হয়েছে। মক্তবে পড়বে না, স্কুলে যাবে; তাই মেনে নিতে হয়েছে : যদিও হাফিজুরের দেওবন্দ পড়–য়া দাদু মৃত্যুর আগে ছেলের হাত ধরে অনুনয় করেছিলেন, তোমার পুত্রসন্তান হলে মক্তবে পড়তে দিয়ো। আহা, মৃত পিতার অনুনয় ভরা মুখচ্ছবি বারবারই মনে পড়েছে, তবু পুত্রের ইচ্ছায় বাদ সাধেননি। বড় হয়ে এ অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে, হাফিজুর গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের তখন উত্তাল টালমাটাল সময়। তবু ছেলেকে তিনি বাধা দেননি। কাউকে কিছু না বলে হাফিজুর মুক্তিযুদ্ধে গেছে জানার পর খুব নিভৃতে একটি দীর্ঘশ্বাস তিনি চাপা দিয়েছেন, আবার অবুঝ স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়েছেন- দেশের স্বাধীনতার জন্য ওরা তো যুদ্ধে যাবেই।
এই দেশ স্বাধীন হবেই।
হাফিজুরে মা অবাক চোখে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে, তার মুখে যেন এমন কথা আশাই করেনি। তবে কিছুদিন থেকে স্বামীর কথাবার্তায় খানিকটা ওলট পালট পরিবর্তনও তার নজরে পড়েছে। হাফিজুরের যুদ্ধে যাওয়াই কি এ পরিবর্তনের কারণ? ভেবে-চিন্তে হাফিজুরের মা নির্ণয় করেছে- এ পরিবর্তন ঘটেছে আরও কিছুদিন আগে। একেবারে মার্চ মাসের গোড়ার দিকে প্রতিদিন আধাবেলা হরতাল অসহযোগ আন্দোলন সবকিছু উজিয়ে হাফিজুরের বাবা ঢাকায় গিয়েছিলেন ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার জন্য। সে উদ্দেশ্য তার সফল হয়নি। ছেলেকে সঙ্গে না নিয়ে বহু কষ্টের পথ পেরিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন, কিন্তু চোখেমুখে তার ব্যর্থতার ছায়া পড়েনি। বরং কী একখানা যেন জগৎ উদ্ধার করে ফিরেছেন- এমনই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে স্ত্রীকে জানিয়েছেন, সত্যিকারের শেখ মুজিবকে দেখে এলাম।
হাফিজুরের মা বিস্মিত।
সে দিন ছিল সাতই মার্চ। রেসকোর্সভরা ছাত্র-জনতা-কৃষক-শ্রমিক। আকাশ কাঁপানো স্লোগান বজ কণ্ঠ বক্তৃতা। সূর্যখোলার হুজুর স্যার মুজিবুর রহমানের চেতনায় বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে। মানুষের
গায়ে মানুষ ঠাসা। তবু তিনি মানুষ ঠেলে মাথা গলিয়ে সামনে যেতে চেষ্টা করেন। এক জায়গায় এসে থামতেই হয়। সেখান থেকেই দেখতে পান শেখ মুজিবকে। সাদা পাঞ্জাবির ওপরে মুজিব কোট; চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। তার ডান হাতের শাহাদৎ অঙ্গুলি যেন আকাশ ছুঁতে চায়। কী যে দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম! জয় বাংলা স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে সবাই মুষ্টিবদ্ধ হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। এক সময় হুজুর স্যার চমকে ওঠেন, তিনিও কি হাত তুলেছেন? নইলে তার মুষ্টিবদ্ধ হাতে এত অহংকার কিসের?
পুত্রের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পুরস্কার হিসেবে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। মাসখানেকের অমানুষিক নির্যাতনে ডান পায়ের হাঁটুর নিচে ভেঙে যায়। পায়ের পাতা থেঁতলে দেয়; তার পর কী যে মনে হয় তাদের- বন্দির নাম শেখ মুজিবুর রহমান, একথা রাজাকারদের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ার পরও একযোগে হো হো করে হেসে ওঠে এবং সত্যি সত্যি তাকে আর্মি ক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেয়। বিশ্বাস হয় না হুজুর সারের। ডান-পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামনে এগিয়ে আসেন এবং সর্বদা আতংকে থাকেন- এই বুঝি পেছন থেকে গুলি ছুড়ছে। শেখ মুজিবকে হত্যার এ সুযোগ ওরা বেহাত করে!
বাড়ি পৌঁছনোর পর সেদিন একবার খুব অহংকার হয় নিজের নামের জন্য। হাফিজুরের মা পরম মমতায় গোসল করায়, হাতে তুলে ভাত খাওয়ায়, ধীরে ধীরে নরম বিছানায় শুইয়ে দেয়। তার পরই আকাশ-পাতাল জ্বর, সারা গায়ে আগুনের হলকা, দু’চোখ ভাটা ভাটা। তারই মধ্যে প্রলাপ বকেন- আমারই নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
একেবারে যুদ্ধের শেষ দিকে খবর আসে, সাতক্ষীরা নাকি বেনাপোল কোথায় নাকি সম্মুখ সমরে শহীদ হয়েছে হাফিজুর রহমান। এ সংবাদে মা-বাবা দু’জনেরই ভেঙে পড়ার কথা, মা ঠিকই লুটিয়ে পড়ে কান্নায়, বাবা প্রায় নির্বিকার ভঙ্গিতে জানান- না না শেখ মুজিবের সন্তান কিছুতেই মরে না, ওরা সব অমৃতের সন্তান। মরবে কেন! মাত্র মাস খানেক পরে হাফিজুরের সহযোদ্ধারা বিজয়ের পতাকা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়, হাফিজুরের মা তাদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আর্তনাদ করে, বোনেরা পাগলের মতো আছাড়ি-পিছাড়ি কাঁদে, বাবা কিছুই বলে না, ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে এসে তার পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে এবং পায়ের কাছেই নামিয়ে রাখে হাফিজুরের মুক্তিযোদ্ধা আইডেনটিটি কার্ড। সেই কার্ডটি তিনি হাতে নিয়ে পাঞ্জাবির বুক পকেটে সযতেœ ঢুকিয়ে রাখেন। কাউকে দেখার সুযোগ দেন না। বিগত সাড়ে তিন বছরে জামা বদল হয়েছে যখনই, তিনি সতর্ক আঙুলে তখনই সেই কার্ড চালান করেছেন পকেটে। কেউ জানে না কী লেখা আছে সেই কার্ডে।
জগৎ সংসারে এমন অনেক ঘটনাও ঘটে, আপাতদৃষ্টিতে তার কার্যকারণ সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না, ঘটনার অন্তরালে পূর্বাপর যোগসূত্রটি কখন কী রচিত হয়েছে, তারও উদ্দিশ মেলে না।
সূর্যখোলার মুজিবুর রহমানের বাড়িতে সেদিন সূর্য ওঠার আগে তেমনই এক অব্যাখ্যের ঘটনার অবতারণা হয়। না, সেই প্রত্যুষের ঘটনার বিবরণ দেয়ার আগে রাতের ঘটনাটুকুও খুলে বলা দরকার। মুজিবুর রহমান এশার নামাজ শেষে সালাম ফিরিয়ে স্ত্রীকে ডেকে বলেন, দক্ষিণের জানালাটা লাগিয়ে দাও তো জাহানারা। স্ত্রী সে আদেশ পালনের সময় গজর গজর করে, এত জোরে রেডিও বাজানোর মানে হয়! তা একি রকম মানে হয়ই তো! প্রতিবেশীর সুবিধে-অসুবিধে দেখতে গেলে তাদের চলে! তাদের দরকার ফুল ভল্যুমে গান শোনা। হল্যান্ড সেট ফিলিপস রেডিওতে যত রাজ্যের স্টেশন আছে সবগুলোই ধরে। উর্দু কিংবা হিন্দি একটা কিছু হলেই হল। মুজিবুর রহমান জায়নামাজে বসেই স্ত্রীকে শোনান। এ দেশটায় দু’বার এলো স্বাধীনতা। তুমি হিসাব করেছ জাহানারা, আমরা একবার হারালাম আমাদের ছোট চাচাকে। একবার হারালাম আমাদের ছেলেকে।
জাহানারা বেগম অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। একটু ফাঁক দিয়ে বাক্য শেষ করেন মুজিবুর রহমান- আমরা কী পেলাম বল দেখি!
কাছে বসে গায়ে হাত রেখে জাহানারা বেগম শুধায়- তোমার কী হয়েছে বল তো শুনি! শরীর খারাপ?
নাহ!
তুমি কি নামাজ পড়তে বসেছ, নাকি হিসাব মেলাতে বসেছ? ভোররাতে তাহাজ্জুদের সময়েও তাহলে এ ধ্যান কর?
প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে মুজিবুর রহমান বলেন- পারলে না তো বলতে! স্বাধীনতা, আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। বলতে গিয়ে একটু হেসেও ওঠেন বুঝিবা।
সেদিন ভোরবেলা জাহানারা বেগমের ঘুম ভাঙে প্রতিবেশীর রেডিও থেকে ভেসে আসা ঘোষণায় বিশ্বাসঘাতক এক মেজর নিজের নাম উল্লেখ করেই সগর্বে জানাচ্ছে, দেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে...। ভয়ার্ত কণ্ঠে আর্তনাদ করে ওঠেন জাহানারা বেগম, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দ্যাখেন, মেঝেতে বিছানো জায়নামাজে ডান দিকে গড়িয়ে পড়ে আছে তার স্বামীর নিথর দেহ। তার ফজরের নামাজ শেষ হয়েছে কিনা কে বলবে সে কথা!
এমন কাকতালীয়ভাবে মৃত্যুর সাদৃশ্যও ঘটে কখনও!
সারা দেশ তখন স্তব্ধ। ঘরের বাইরে বেরোনো পর্যন্ত নিষিদ্ধ। সূর্যখোলা গ্রামের শ্রাবণ আকাশ দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর একটুখানি সরিয়ে নেয় মেঘের পর্দা, তখনই এক ঝলক রোদ এসে সবার পরিচিত হুজুর স্যারকে প্রণতি জানিয়ে যায়। সেদিন যারা সব প্রতিকূলতা ঠেলে তার জানাযায় অংশ নেয়, তারা পরস্পর বলাবলি করে লোকটির খুব অহংকার ছিল দেশের স্বাধীনতা নিয়ে। নইলে মুক্তিযোদ্ধা পুত্রের পরিচয়পত্র এভাবে বুক পকেটে কেউ আগলে রাখে!

No comments

Powered by Blogger.