বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান ও by ড. ইউনূসড. মোহাম্মদ ভুঁইয়া

বাংলাদেশের ভোটারের সংখ্যা আট কোটি এক লাখ এবং অতীত ইতিহাস থেকে দেখা যায়, কেবল ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ভোটার নির্বাচনে ভোট প্রদান করে। আমরা যদি শুধু গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৫ লাখ সদস্য, তাদের স্বামী ও প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের হিসাব করি, তাহলে সেই সংখ্যা সহজেই দুই কোটি ছাড়িয়ে যায়।
গ্রামীণ সদস্যরা সুসংগঠিত খুদে ব্যবসায়ী এবং তারা শুধু নিজেরাই ভোট দেয় না, তারা অন্যদেরও ভোট দিতে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সুতরাং এটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে গ্রামীণ ভোটারদের সংখ্যা সারা দেশের ভোট প্রদানকারী ভোটারের সংখ্যার প্রায় অর্ধেক। আমার বিবেচনায় 'গ্রামীণ ভোটার'রা ইচ্ছে করলেই দেশের যেকোনো নির্বাচনী এলাকা থেকে তাদের পছন্দসই প্রার্থীকে নির্বাচিত করে আনতে পারে। বর্তমান সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে করায়ত্ত করতে গিয়ে একটি মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে এবং তার মাসুল দিতে হবে আগামী নির্বাচনগুলোতে। আমরা সবাই জানি, সরকারনিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত ব্যাংকগুলো দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার দায়ে জর্জরিত হয়ে দেউলিয়া হতে বসেছে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের কপালেও তাই জুটবে, যদি সরকার কোনোভাবে এই বিশ্বনন্দিত নোবেল পুরস্কারবিজয়ী এই প্রতিষ্ঠানটিকে করায়ত্ত করতে পারে।
আমরা যদি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনটিকে বিশ্লেষণ করি, তাহলে এটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে ভোট কেন্দ্রগুলোতে মহিলা ভোটারদের উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি। অনেকের মতে, গাজীপুর এলাকার প্রতিটি গ্রামীণ সদস্য সরকারমনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট প্রদানে অংশগ্রহণ করে। গ্রামীণ ব্যাংককে তার সদস্য-মালিকদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার সরকারি হীন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই সব গ্রামীণ সদস্য এই ভোট যুদ্ধে অংশ নেয়। সরকারবিরোধী এই মনোভাব শুধু যে গ্রামীণ সদস্যদের মধ্যেই কাজ করেছে তা নয়, এটা ছিল আরো অনেক ভোটারের মাঝেও। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে সরকারি দলের বিকল্প দলটিও সমপরিমাণেই খারাপ এবং অযোগ্য। আমরা সবাই জানি যে বিএনপি কিভাবে পাঁচ বছর ধরে দেশবাসীকে তাদের দুর্নীতি ও অরাজকতার শাসন উপহার দিয়েছে এবং দেশবাসী তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বিএনপিবিরোধী ভোট দিয়ে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা প্রদান করেছে।
এ বছরের শেষদিকে যদি দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে দেশবাসী নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করবে এবং বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাবে। এটি অন্তত নিশ্চিত করে বলা যায় যে বিএনপি এককভাবে সরকার গঠন করলে তারা দেশবাসীকে বেশি না হলেও কমপক্ষে গত পাঁচ বছরের দুর্নীতি ও অরাজকতা উপহার দেবে।
বাংলাদেশের জনগণ দুটি অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক রাজনৈতিক পছন্দের জাঁতাকলে পড়ে এক অসহনীয় অবস্থার মাঝে দিন কাটাচ্ছে। জনগণ কয়েকবার সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা থেকেও বুঝতে পেরেছে যে সেটিও কোনো ভালো সমাধান নয়। সুতরাং দেশের জনগণ নতুন কোনো সমাধানের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। কিন্তু এ জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একজন সৎ ও যোগ্য নেতার, যিনি দেশে এবং বিদেশে সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবেন। আমার মতে প্রফেসর ইউনূসই নিঃসন্দেহে একমাত্র বাংলাদেশি, যাঁর যোগ্য নেতৃত্ব দেশের দুর্নীতি ও অব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশকে সত্যিকার সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা সম্ভব।
আমি মনে করি, আমরা যারা বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি, আমাদের সবার দায়িত্ব হলো যে জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা। যদিও প্রফেসর ইউনূস বারবার বলেছেন যে তিনি রাজনীতির বাইরে থাকতে চান, কিন্তু আমি মনে করি যে তিনি সারা দেশের মানুষের আবেদনকে উপেক্ষা করে নীরব হয়ে বসে থেকে দেশের ক্রমেই অবনতি দেখতে চাইবেন না। দেশের জন্য এখনই উপযুক্ত সময়, যেখানে প্রফেসর ইউনূস তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে একটি 'জাতীয় ঐক্য পরিষদ' গঠন করে দেশকে আশার আলো দেখাতে পারেন।
এখানে আমি বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক নেতাকে চিন্তা করে দেখার জন্য একটি পরিকল্পনার প্রস্তাব দিচ্ছি। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশের প্রেক্ষাপটে সব বিরোধী দল যদি সম্মিলিতভাবে কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রদান করে, তাহলে আগামী নির্বাচনে সেই প্রার্থী নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিজয়ী হবেন। সুতরাং নিজেদের স্বার্থেই সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের উচিত একজন যোগ্য নেতৃত্বের দ্বারা গঠিত 'জাতীয় ঐক্য পরিষদে' যোগদান করা। এ ছাড়া যদি আওয়ামী লীগের কোনো সৎ ও যোগ্য প্রার্থী দলের আনুগত্য ভেঙে 'জাতীয় ঐক্য পরিষদে' যোগদানে আগ্রহী হন, তাহলে তাঁকে যথাযথ বিবেচনা করা যেতে পারে।
এই নবগঠিত পরিষদে যোগ দেওয়ার জন্য সব রাজনৈতিক দল ও নেতাকে একটি অবকাঠামোর সব শর্তের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। অন্যান্য বিষয় ছাড়াও এই অবকাঠামোতে থাকবে :
১. প্রতিটি দলের, নেতা ও সদস্যদের ব্যবহার বিধি (Code of Conduct)।
২. পরিষদের দলগুলোর মাঝে পার্লামেন্ট আসনের বণ্টনবিধি।
৩. পার্লামেন্ট আসনের জন্য প্রার্থীর যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা।
৪. মন্ত্রিসভার সদস্য, স্পিকার ও অন্যান্য পদে মনোনীত হওয়ার যোগ্যতা ও নীতিমালা।
৫. দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণের সঙ্গে যেকোনো নির্বাচিত সদস্যের পদ বাতিল।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সবাই জানি যে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কিভাবে তার অপব্যবহার করেছে। আমরা আরো দেখেছি যে একদলীয় সরকার গঠন করে এই দুই দল কিভাবে দেশে দুর্নীতি ও অরাজকতা কায়েম করেছে। সুতরাং আমরা আশা করি যে দেশে এমন একটি নতুন গঠনতান্ত্রিক পরিবর্তন প্রয়োজন, যাতে কোনো একক দল এককভাবে সরকার গঠন করতে না পারে।
এই নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী বিএনপির আসনসংখ্যা হবে ১০০, বাকি সব রাজনৈতিক দল মিলিতভাবে পাবে ১০০টি আসন এবং অবশিষ্ট ১০০টি আসনে দেশের ব্যবসায়ী, শ্রমিক, মজুর, কৃষক, মিলিটারি, শিক্ষা ও অন্যান্য পেশার নেতাদের মনোনয়ন দিতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে এই বিভিন্ন পেশার নেতার মনোনয়নের জন্য ঐক্য পরিষদের কমপক্ষে ৮০ শতাংশ নেতার সমর্থনের প্রয়োজন হবে। সব শেষে কোনো ব্যক্তি যদি দুর্নীতি ও বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত ও প্রমাণিত হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তিকে কোনো অবস্থায়ই মনোনয়ন প্রদান করা যাবে না।
এটি আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, প্রফেসর ইউনূসকে প্রভাবিত করতে হলে ঐক্য পরিষদের সব সম্ভব্য সদস্যকে সর্বোচ্চ মানের নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করতে হবে। এ ছাড়া সব প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র দাখিল করার সময় তাদের আর্থিক অবস্থার পূর্ণ চিত্র তুলে ধরতে হবে এবং তা নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দিতে হবে আর প্রার্থীর নিজ ওয়েবসাইট সবার দর্শনের জন্য খোলা রাখতে হবে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রফেসর ইউনূসকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কাজে দেখার সুযোগ পেয়েছি। তিনি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের গর্বের বিষয়। পৃথিবীর অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে লাভবান হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করেন। সারা বিশ্বের ১৫০টির বেশি দেশের দরিদ্র মানুষ তাঁর ক্ষুদ্র ঋণের ধারণা থেকে উপকৃত হচ্ছে। প্রফেসর ইউনূসের নতুন 'সামাজিক ব্যবসা'র ধারণা খুব সম্ভবত তাঁকে দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার এনে দেবে। প্রফেসর ইউনূস একজন সৎ ব্যক্তি, যিনি খুবই সাদামাটা ও কর্মঠ জীবনযাপন করেন। প্রফেসর ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত সব গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিমুক্ত ও অত্যন্ত সুষ্ঠুতার সঙ্গে পরিচালিত।
আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য যে সরকারি দলের অপচেষ্টার কারণে বাংলাদেশ ও তার জনগণ প্রফেসর ইউনূসের মেধা ও বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারদলীয় নেতারা যদি নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থকে দেশের স্বার্থের চেয়ে বড় করে না দেখতেন, তাহলে প্রফেসর ইউনূসকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ অনেক বেশি লাভবান হতো।
বাংলাদেশ বর্তমানে এক ক্রান্তিলগ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। সরকার ও বিরোধীদলীয় ব্যর্থতা, দুর্নীতি আর অরাজকতা দেশের ১৬ কোটি মানুষকে অস্থির করে তুলেছে। দেশ ও জাতি খুঁজছে নতুন পথ এবং অনেকেরই বিশ্বাস, প্রফেসর ইউনূস জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে দেশে 'জাতীয় ঐক্য পরিষদ' গঠনের নেতৃত্ব প্রদান করে দেশবাসীকে একটি নতুন পথের সন্ধান দিতে পারেন।

লেখক : অর্থনীতিবিদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের টাসকেগি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন প্রশাসক

No comments

Powered by Blogger.