ডিজিটাল সরকারের এ কেমন আচরণ by পল্লব মোহাইমেন

সরকারের পরামর্শে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ২৯ মে ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছে। ফেসবুক কী? ইন্টারনেটের একটা ওয়েবসাইট। সামাজিক যোগাযোগের (সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং) তুমুল জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। এর প্রভাব শুধু ওয়েবসাইট বা ইন্টারনেটের মধ্যেই আর সীমিত নয়। আধুনিক জীবনযাপনে, সামাজিকতার একটি অংশ হয়ে উঠেছে ফেসবুক। গোটা দুনিয়ায় ৪০ কোটির বেশি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে, রীতিমতো নিজের একটি আলাদা পাতা (অ্যাকাউন্ট) খুলে। আর এই বাংলাদেশে যেখানে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে, সেই দেশেও ফেসবুকের ব্যবহারকারী প্রায় নয় লাখ। চালু হওয়ার মাত্র ছয় বছরের মধ্যেই ফেসবুকের এই ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণ নিয়ে দেশে দেশে গবেষণা চলে প্রতিনিয়ত। সহজভাবে বলতে গেলে, মানুষের সহজাত সামাজিক প্রবৃত্তির কারণেই ফেসবুক জনপ্রিয়। এই ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া যায় শৈশবের সেই বন্ধুটিকে, যার সঙ্গে হয়তো দেখা নেই অনেক বছর। আবার নতুন নতুন বন্ধু পাওয়া যায়। এই ফেসবুকের মাধ্যমে নিজের আবেগ, উচ্ছ্বাস বা বেদনা ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়। নিজের সদ্যোজাত সন্তানের বা নতুন জীবনের ছবিটিও ফেসবুকে প্রকাশ করে সবাইকে জানানো যায়। এই ফেসবুক অনেক সময় হয়ে ওঠে সংবাদ সংগ্রহের, বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যম। সেই ফেসবুক আজ বাংলাদেশে বন্ধ।
এর আগে ১৯ মে পাকিস্তানে ফেসবুক বন্ধ করার আদেশ দেন একটি আদালত। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন একটি পৃষ্ঠা থাকায় একজন পাকিস্তানি নাগরিক আদালতে মামলা করেন। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ৩১ মে পর্যন্ত ফেসবুক বন্ধ করার আদেশ দেন। আবার ২০ থেকে ২৭ মে ভিডিও দেখার ওয়েবসাইট ইউটিউব বন্ধ করে রাখে পাকিস্তান। তবে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এই পৃষ্ঠাটি অপসারণ করেছে দ্রুততার সঙ্গেই। অর্থাৎ ইস্যু শেষ। এরপর বাংলাদেশে কতিপয় মৌলবাদীর দাবির মুখে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা’র কারণ দেখিয়ে ফেসবুক বন্ধ করে সরকার কী বার্তা দিল বহির্বিশ্বে? আমাদের নতুন প্রজন্মই বা কী বার্তা পেল ডিজিটাল বাংলাদেশ আর দিনবদলের সরকারের কাছ থেকে?
২৯ মে বিকেল থেকেই অনেকে ফোনে জানাচ্ছিলেন, ‘ফেসবুকে ঢুকতে সমস্যা হচ্ছে, খোঁজ নেন তো’। সন্ধ্যা সাতটা, সোয়া সাতটা পর্যন্ত ঢোকাও গেল। কিন্তু এর পরই ফেসবুকে বাংলাদেশ থেকে প্রবেশ বন্ধ হয়ে গেল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এখন বাংলাদেশ থেকে ইন্টারনেটে যুক্ত হওয়ার যে দুটি পথ (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) আছে, সেই দুটি পথের মালিক বাংলাদেশ টেলিকম কোম্পানি লিমিটেড এবং ম্যাঙ্গো টেলিসার্ভিসেস লিমিটেডকে ফেসবুকের ওয়েব ঠিকানায় বাংলাদেশ থেকে প্রবেশ করার পথ বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বিটিআরসি। টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রটিতে সহায়ক শক্তি হয়ে ওঠার কথা ছিল এই বিটিআরসির। কিন্তু এখন সংস্থাটির কাজে উল্টোটাই প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলাদেশের ইন্টারনেট যোগাযোগের প্রায় সবটাই ফাইবার অপটিক সাবমেরিন কেব্ল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তাই ফেসবুক এখন প্রায় পুরোটাই বন্ধ। যে গুটিকয়েক ভিস্যাট এখনো আছে, সেসব দিয়ে ইন্টারনেট সেবা দেওয়া হয় না বললেই চলে। এই ভিস্যাটগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে ১৯ জুন থেকে।
বাংলাদেশে যেদিন ফেসবুক বন্ধ হলো সেদিন (২৯ মে) ভোরে ফেসবুকে দুই নেত্রীসহ রাজনীতিবিদদের কারও কারও ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের অভিযোগে মাহাবুব আলম রডিন নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগের দিন শুক্রবার কিছু মৌলবাদী ইসলাম ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ড ফেসবুকে পরিচালিত হচ্ছে—এমন অভিযোগ এনে ফেসবুক বন্ধ করার দাবি জানায় রাজপথে। আর সংবাদমাধ্যমে বিটিআরসির চেয়ারম্যানের যে বক্তব্য পাওয়া গেল, তাতে মৌলবাদীদের দাবির কথাই যেন উঠে এল। তিনি জানালেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে এমন কিছু ব্যঙ্গচিত্র ও ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করা হচ্ছিল। এসব ব্যঙ্গচিত্র যাতে প্রকাশ না হতে পারে, সে জন্য বিটিআরসি এর শাখা সংযোগগুলো (লিঙ্ক) বন্ধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু এটা করতে না পারায় সরাসরি ফেসবুক সাময়িক বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।’
যাঁরা ফেসবুক ব্যবহার করেন বা কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন কোনো আপত্তিকর, ভুয়া পাতা (অ্যাকাউন্ট) বা ছবি থাকলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে জানানো যায় (রিপোর্ট)। আর জানানোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সেই পাতা অপসারণ করে দেয় ফেসবুক। ফেসবুকের নীতিমালায় লেখা আছে, কোনো দেশের বিরুদ্ধে বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে, এমন কোনো লেখা, স্ট্যাটাস বা ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করা যাবে না। যদি করা হয় তবে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। ফেসবুক বন্ধের এ ঘটনা থেকে বলা যায়, সরকারের যেসব তথ্যপ্রযুক্তিবিদ বা পরামর্শক রয়েছেন, তাঁরা তাঁদের ব্যর্থতা ঢাকতেই মাথাব্যথার ওষুধ না দিয়ে মাথাটাই কেটে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন। এসব তথ্যপ্রযুক্তিবিদ বা পরামর্শকের দক্ষতার একটা নমুনা দেখা যায় মার্চ মাসে। ৬৪টি জেলার ওয়েবপোর্টালের (জেলা তথ্য বাতায়ন) মধ্যে ১৯টি একই দিনে হ্যাক হয়ে যায়। কোথা থেকে কে এই হ্যাকিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল, তা এসব ‘এক্সপার্টরা’ এখনো বের করতে পারেননি। আর সরকারি ওয়েবসাইটগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা কত নাজুক, তা নতুন করে বলার দরকার নেই। নিরাপত্তা ত্রুটির কারণে র‌্যাবের ওয়েবসাইট হ্যাক হয়েছিল ২০০৮ সালে। ২০০২ সালে জাতীয় সংসদের ওয়েবসাইটের নিবন্ধন সময়মতো নবায়ন না করার কারণে হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।
প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব আর নিজেদের অদক্ষতা ঢাকতে আমরা বিশ্বের কাছে কী বার্তা পাঠালাম!
প্রযুক্তি কখনোই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ করে নেতাদের ব্যঙ্গচিত্রের প্রকাশ কি থামানো যাবে? বরং কোথায় কী আঁকা হচ্ছে বা লেখা হচ্ছে, তা জানারও উপায় থাকছে না। বিশ্বের সব রাষ্ট্রপ্রধান, নেতা বা তারকাদের নিয়ে নানা রকম ব্যঙ্গ সবসময়ই করা হয় ইন্টারনেটে। কিন্তু স্বৈরশাসন বা রক্ষণশীল মৌলবাদী রাষ্ট্র ছাড়া কোনো দেশই ওয়েবসাইট বন্ধ করার কথা ভাবে না। মুক্ত পৃথিবীতে বন্ধ বিষয়টাই অচল। বন্ধ করে এগোনো যায় না। রাস্তাঘাটে ছিনতাই হয় বলে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া যেমন যায় না, তেমনি প্রযুক্তি বন্ধ করাও সম্ভব নয়। ফেসবুক বন্ধ, কিন্তু প্রক্সি সার্ভার দিয়ে ফেসবুকে ঢোকা যাচ্ছে। তাই এই সময়ে এসে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার এ যুগে সবার কাছে এই দেশটি সম্পর্কে ভুল বার্তা দেওয়ার কোনো মানে হয় না। বাংলাদেশ পাকিস্তানের মতো রক্ষণশীল একটি রাষ্ট্র—এটা তুলে ধরা দেশের জন্য একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তাই ফেসবুক খুলে দেওয়া হোক এবং বলা হোক, প্রযুক্তির স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহারের ওপর কখনোই যেন কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা না হয়।
পল্লব মোহাইমেন: সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.