চিরভাস্বর মণি সিংহ -স্মরণ by মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

আজ কমরেড মণি সিংহের ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯০১ সালের ২৮ জুুুলাই। প্রায় ৯০ বছরের জীবনে তিনি একজন অবিচল বিপ্লবী হিসেবে দেশবাসীকে পথ দেখিয়েছেন। এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃত্ হিসেবে তাঁর অবদান সমুজ্জ্বল চিরভাস্বর। লাল সালাম কমরেড মণি সিংহ!
কমরেড মণি সিংহ ছিলেন এই উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ—এ দেশের তরুণ বিপ্লবীদের আদর্শ, অনুপ্রেরণা ও উজ্জীবনের অনন্ত উত্স। তাঁর জীবনাদর্শ ও মুক্তিসংগ্রামের অক্ষয় কর্মকাণ্ড থেকে আলাদাভাবে তাঁর পরিচয় খোঁজার চেষ্টা বৃথা এবং তাঁর মার্ক্সবাদী জীবনাদর্শই তাঁকে পথ দেখিয়েছে একজন বড় মাপের মানুষ হিসেবে তাঁর পরিচয় ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করে যেতে। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘বিপ্লবী মানবতাবাদ’ হচ্ছে কমিউনিস্ট আদর্শের মর্মকথা। আমরা লড়াই করছি কেবল একটি শ্রেণীর মুক্তির জন্য নয়। এর মাধ্যমে আসলে সার্বিকভাবে মানবমুক্তির জন্যই আমাদের সংগ্রাম। ঐতিহাসিক বিচারে তাই মানুষই আমাদের সাধনার কেন্দ্রবিন্দু। সেই মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মানবপ্রেমকেই বিপ্লবী ধারায় সমাজে সর্বজনীন করে তুলতে হবে।
কমরেড মণি সিংহকে অনেকেই কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন, অনেকে শুধু দূর থেকে। অনেকের সুযোগ হয়নি তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার। আমার চেয়ে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে তাঁকে কাছে পেয়েছেন বহুজনই। কিন্তু সভা, বৈঠক, মিছিল, অনুষ্ঠান, জেলা সফর, আন্ডারগ্রাউন্ডে সভা, বিদেশে একসঙ্গে সফরে যাওয়া—এসব ছাড়াও আমার দুর্লভ সুযোগ হয়েছিল কমরেড মণি সিংহের সঙ্গে অনেক মাস একসঙ্গে জেলখানায় একই ওয়ার্ডে পাশাপাশি আসনে থাকার। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা একসঙ্গে থাকার মধ্য দিয়ে মানুষকে দেখার ও জানার যে সুযোগ হয় তা অনন্য। ১৯৭৭ সালে আমার সে সুযোগ হয়েছিল। বিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনবোধের নিখুঁত প্রতিফলন মণিদার মধ্যে আমি তখন দেখেছি। শৃঙ্খলাপূর্ণ প্রাত্যহিক জীবনাভ্যাস, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, বিনোদন, সহবন্দীদের প্রতি মমত্ববোধ, সাধারণ কয়েদিদের প্রতি প্রীতিময় আচরণ, অধিকার ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নে কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে লড়াই, কত কী! আমার জন্য তাই কারাগার এবং কারাগারে মণি সিংহ হয়ে উঠেছিল পাঠশালা ও পাঠশালার আচার্য। বন্দী করে জেলে এনে রেখেছে। তাতে কী! এখানেই কাজ চলবে। সময়কে কাজে লাগাও। বই পড়ো। আলোচনা করো। জেলখানায় উন্নত পরিবেশের জন্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে লড়াই করো। রেশন কেন খারাপ এল? পত্রিকা আসতে কেন বিলম্ব হয়? ডাক্তার কেন রাউন্ডে এল না? চিঠি লেখো, পিটিশন দাও। অর্থাত্ যেখানেই থাকো, সেখানেই আরও ভালো থাকার জন্য সংগ্রাম করো। এটাই একজন বিপ্লবীর অন্তরের সংগীতমূর্ছনা, যা বিদ্যমান তাকেই ধ্রুব ধরে নিয়ে ‘বাস্তবতা’ বলে অজুহাত দিয়ে চলতি অবস্থা চলতি হাওয়ায় অন্তসমর্পণ কোরো না।
কমরেড মণি সিংহ কোনো বড় মাপের মার্ক্সবাদী পণ্ডিত ছিলেন না। কিন্তু তিনি মার্ক্সবাদকে গভীরতা দিয়ে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাঁর জীবন পর্যালোচনা করে দেখতে পাই যে বড় বড় মৌলিক ক্ষেত্রে তিনি প্রায় সব সময়ই সঠিক অবস্থান নিয়েছেন দৃঢ়তার সঙ্গে। ব্রিটিশবিরোধী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ধারা থেকে প্রথম সুযোগেই মার্ক্সবাদী জীবনাদর্শ গ্রহণ করা, শ্রমিক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, নিজ জেলায় রাজপারিবারিক আভিজাত্য ও স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক টঙ্ক আন্দোলন পরিচালনা, সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানে সাহসের সঙ্গে তিলে তিলে গণতন্ত্র, স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তিভূমি রচনা করা, ‘মাওবাদের’ বিষয়ে সঠিক অবস্থান নিয়ে বামপন্থী বিচ্যুতির বিরুদ্ধে দৃঢ় সংগ্রাম পরিচালনা, দক্ষিণপন্থী পদস্খলনের বিপদ সম্পর্কে সর্বদা সতর্ক হুঁশিয়ারি দেওয়া, পার্টিতে বিভেদের বিরুদ্ধে সব সময় অবস্থান নেওয়া এবং গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা কঠোরভাবে অনুশীলন করা—এসবই কমরেড মণি সিংহকে পার্টির স্বাভাবিক শীর্ষ নেতৃত্বের আসনে পৌঁছে দিয়েছিল।
তিনি সংকীর্ণ ছিলেন না। মূল শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যের বিষয়টিকে বিপ্লবী কর্শকৌশল বলে জানতেন। রণনীতি ও রণকৌশলের আন্তসম্পর্ক সম্পর্কে কখনো বিস্মৃত হতেন না এবং সব সময়ই পার্টির স্বাধীন রাজনৈতিক ভূমিকাকে গুরুত্ব দিতেন। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভার ধারাবিবরণী পাঠ করলে পরিষ্কার দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তিনি ঐক্য ও সংগ্রামের নীতির সপক্ষে ছিলেন; কিন্তু সংগ্রামের বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না বলে সমালোচনামুখর ছিলেন, ‘বাকশাল’প্রক্রিয়ার বিষয়ে তিনি সন্দিহান ও সংশয়াপন্ন ছিলেন, জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে ঐক্য করার পক্ষে থাকলেও তাদের অনুষঙ্গ হয়ে থাকতে হবে আপাতত এই তত্ত্বের বিরোধী ছিলেন। জিয়ার খালকাটা কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার বিরোধী ছিলেন, জিয়ার ‘হ্যাঁ-না’ ভোটে অংশ নেওয়ার বিরোধী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও জিয়ার শাসনামলে মণি সিংহের রাজনৈতিক মতামত ও অবস্থান পরিষ্কার করেই ইঙ্গিত দেয় যে আজ বেঁচে থাকলে তিনি বর্তমান রাজনীতি সম্পর্কে কী করণীয় নির্দেশ করতেন।
আজ যখন ‘বাজার অর্থনীতি’ ও সাধারণভাবে দক্ষিণপন্থী ধারার অনুসারী পরস্পর দ্বন্দ্বমান দুটি মেরুকরণ দেশে বিরাজ করছে, তখন মন্দের ভালো বলে এদেরই একটাকে বেছে নিয়ে তাকে যথাসাধ্য ‘মানুষ’ করার প্রয়াস হবে নিষ্ফল। এ অবস্থায় সঠিক কৌশল হতে পারে একটাই। বিদ্যমান দুই মেরুকরণের বাইরে একটি বিকল্প গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল শক্তি সমাবেশ গড়ে তুলে গণসংগ্রামের ধারায় তাকে জনপ্রিয়, গ্রহণযোগ্য, কার্যকর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্য হবে উগ্র প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর বিপদ মোকাবিলায় নিজ নিজ অবস্থান অক্ষুণ্ন রেখে বৃহত্তম শক্তিকে নিয়ে একসঙ্গে সংগ্রাম করা। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সেই কাজটিই এখন এগিয়ে নিচ্ছে মণি সিংহের পথ ধরে।
প্রয়াত নেতা কমরেড মণি সিংহ প্রয়াত হলেও তাঁর আদর্শ ও দৃষ্টান্ত দ্বারা পার্টিকে সজীব নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। তাঁর হাতে গড়া পার্টি প্রবল প্রতিকূলতা ও দূষিত হাওয়ার বহমান ঝাপটা সত্ত্বেও উজ্জীবিত হয়ে বহমান। আদর্শ তাঁর অক্ষয়, অম্লান। ভয় নেই তাই। আদর্শের রাজনীতির পুনরুজ্জীবনের জন্য ডাক এসেছে। এ আজ মাতৃভূমির ডাক। কান্ডারি হয়ে পথ দেখাচ্ছেন চিরঞ্জীব কমরেড মণি সিংহ। সালাম তোমাকে সালাম, কমরেড মণি সিংহ!
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।

No comments

Powered by Blogger.