মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও সংখ্যা by আবিদ আনোয়ার

১৭ ডিসেম্বর ২০০৯ প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত!’ শিরোনামের প্রতিবেদনটির সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের আগে প্রয়োজন ছিল মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নিরূপণ। যাঁরা অস্ত্র হাতে সরাসরি পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, শুধু তাঁদেরই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করলে এ কাজটি খুবই সহজ হতো। কিন্তু এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের কোনো মন্ত্রী, আমলা বা কর্মচারী মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় স্থান পাবেন না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরিচালকমণ্ডলী, সাংবাদিক, ভাষ্যকার ও শিল্পীরাও বাদ পড়বেন। ভারতের শরণার্থীশিবিরগুলোতে ত্রাণ বিতরণসহ যাঁরা বিভিন্ন সেবামূলক কাজে অংশ নিয়েছেন, বাদ পড়বেন তাঁরাও।
যুদ্ধের মাঠে অস্ত্রধারী মুক্তিসেনাদের মধ্যে ছিলেন চার ধরনের লোক: (১) অখণ্ড পাকিস্তান রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য, যাঁরা আগে থেকেই প্রশিক্ষিত ছিলেন এবং পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধকালীন আমাদের ‘নিয়মিত বাহিনী’র সদস্য ছিলেন; (২) ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকসহ জনসাধারণের একাংশ, যাঁরা ভারতের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অস্ত্রচালনা, বিস্ফোরকদ্রব্যের ব্যবহার ও গেরিলাযুদ্ধের কলাকৌশল শেখার পর হাতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পেয়েছিলেন এবং দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সেগুলো ব্যবহার করেছিলেন। তাঁদের সংখ্যাই ছিল বেশি এবং নাম দেওয়া হয়েছিল ‘গণবাহিনী’; (৩) টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনীর লোক, যাঁদের অধিকাংশই প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যাননি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ল্যান্স নায়েক কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে দেশের ভেতরই প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেছেন; এবং (৪) ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী, যাঁরা নতুনভাবে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, কিন্তু দেশে না ফিরে ভারতের সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ করেছেন, সেই বাহিনীর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মুজিব বাহিনী’।
মুক্তিযুদ্ধের পর পর কেবল গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নেওয়ার জন্যই মহকুমাভিত্তিক ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে সেসব ক্যাম্পে অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশের নিয়মিত সেনাবাহিনীর কোনো মেজর, ক্যাপ্টেন বা লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর একজন করে কাউন্টারপার্ট। কিছুদিন পর মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেলে ভারতীয় কাউন্টারপার্টের পদ বিলুপ্ত হয়। প্রায় একই সঙ্গে ক্যাম্পগুলোর প্রশাসনিক দায়িত্ব প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বদলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সেনা কর্মকর্তাদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। প্রতি মহকুমায় অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় সে এলাকার গণবাহিনীর কোনো কমান্ডারকে।
এ প্রক্রিয়ায় একপর্যায়ে কিশোরগঞ্জ মহকুমা (এখন জেলা) মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের দায়িত্ব পেয়েছিলাম আমি নিজে। এ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার ফলেই আমি ভেতর থেকে জানতে পেরেছি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম তালিকাটি কোন প্রক্রিয়ায় প্রণয়ন করা হয়েছিল এবং পরে বেশ কয়েকবার কী প্রক্রিয়ায় তা পরিবর্তিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিহারের চাকুলিয়া ক্যাম্প থেকে বিশেষ কমান্ডো হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে কিশোরগঞ্জ এলাকায় ধূলদিয়া রেলসেতু অপারেশন এবং ভাঙা সেতুর পাড়ে পরবর্তী যুদ্ধ পরিচালনায় সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবেই সম্ভবত আমাকে যুদ্ধের পর সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আমার আগে অল্প কিছুদিনের জন্য কিশোরগঞ্জ মহকুমা ক্যাম্পের অধিনায়ক ছিলেন পর্যায়ক্রমে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ও লেফটেন্যান্ট সাদেক। তখন আমি কাজ করেছি দুজনেরই সহ-অধিনায়ক হিসেবে। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের ভারতীয় কাউন্টারপার্ট ছিলেন ক্যাপ্টেন চৌহান। তাঁর সঙ্গে এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের অনেক বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় তাঁকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সরিয়ে নেওয়া হয়। তাঁর বদলে লেফটেন্যান্ট সাদেককে পাঠানো হয় ক্যাম্পের অধিনায়ক হিসেবে। মুক্তিযোদ্ধাদের মহকুমাভিত্তিক ক্যাম্পগুলোর প্রশাসনিক কর্তৃত্ব প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বদলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত হলে যোগদানের মাত্র আট দিন পর তাঁকেও ক্যান্টনমেন্টে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং ক্যাম্প পরিচালনার পূর্ণ দায়িত্ব বর্তায় আমার ওপর। ইতিমধ্যে গুরুদয়াল কলেজ থেকে ক্যাম্পের সদর দপ্তর জেলা পরিষদ ডাকবাংলো ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছিল। মহকুমা প্রশাসক জি আকবর, ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইয়াহিয়া, লোয়ার ম্যাজিস্ট্রেট শফিকুল ইসলাম বহুদিন কাজ করেছেন আমার অফিসে বসেই। কারণ তখনো সিভিল প্রশাসন পুরোপুরি চালু হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নিয়ে তাঁদের রসিদ ও প্রভিশনাল সার্টিফিকেট প্রদান এবং কারও অবৈধভাবে লুকিয়ে রাখা অস্ত্রের জন্য গোয়েন্দাগিরি—এসবই আমাদের প্রধান কাজ ছিল।
১৯৭২ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি দপ্তরের ঠিকানায় ডাকযোগে দুটি মোড়ক পাই। খুলে দেখলাম, জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর মুদ্রিত স্বাক্ষর দেওয়া কয়েক হাজার সার্টিফিকেট পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র শ দুয়েক সার্টিফিকেটে আঞ্চলিক অধিনায়ক হিসেবে মেজর এজাজ আহমদ চৌধুরীর স্বাক্ষর রয়েছে। বাকিগুলোতে আঞ্চলিক অধিনায়ক হিসেবে কারও স্বাক্ষর নেই। অধিকন্তু কোনো সার্টিফিকেটেই কোনো মুক্তিযোদ্ধার নাম লেখা নেই; নিজ হাতে নাম-ঠিকানা লিখে নিতে হবে বা অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে হবে। প্যাকেটের ভেতর একটি চিঠিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে: যেসব মুক্তিযোদ্ধা ইতিমধ্যে অস্ত্র জমা দিয়ে আমাদের কাছ থেকে রসিদ ও প্রভিশনাল সার্টিফিকেট পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে যেন এসব চূড়ান্ত সার্টিফিকেট বিতরণ করা হয়। আমাদের ক্যাম্পে এমন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা তখনই ১১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। তাঁরা সবাই ৩ নম্বর সেক্টরের নন। মেজর এজাজ আহমদ চৌধুরী তখন মেজর সফিউল্লাহর স্থলে শুধু ৩ নম্বর সেক্টরের প্রশাসনিক দায়িত্ব পেয়েছেন। তাঁর স্বাক্ষর দেওয়া সার্টিফিকেট অন্য সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া যাবে কি না এবং যেসব সার্টিফিকেটে আঞ্চলিক অধিনায়ক হিসেবে কারও স্বাক্ষর নেই, সেগুলো বিতরণ করা যাবে কি না—এই দ্বন্দ্বে বিক্ষত হয়ে আমি বিষয়টি নিয়ে চিঠি ও সার্টিফিকেটের প্রেরক ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি জানালেন: মেজর এজাজ আহমদ চৌধুরীর স্বাক্ষর দেওয়া সার্টিফিকেটগুলো ৩ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ করার পর যদি আরও সার্টিফিকেটের প্রয়োজন পড়ে, তাহলে আমি যেন আঞ্চলিক অধিনায়ক হিসেবে স্বাক্ষর দিয়ে বিতরণ পর্ব শেষ করি, গ্রহীতা মুক্তিযোদ্ধা যে সেক্টরেরই হোন না কেন। তিনি আরও বললেন, বিভিন্ন সেক্টরে পাঠিয়ে আঞ্চলিক অধিনায়কের স্বাক্ষরসহ সার্টিফিকেটগুলো আবার পাঠানো এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। কারণ শিগগিরই মহকুমাভিত্তিক ক্যাম্পগুলো বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ আসছে। ডিসিদের কথামতো আমাকে তা-ই করতে হলো। মে মাসের শেষ সপ্তাহে এক সরকারি নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের মহকুমাভিত্তিক সব ক্যাম্প বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা চলে যান যাঁর যাঁর আগের ঠিকানায়। নির্দেশ মোতাবেক আমি আমার দাপ্তরিক দায়িত্ব বুঝিয়ে দিই এবং দপ্তরের দ্রব্যাদি বুঝিয়ে দিই মহকুমা প্রশাসক জি আকবরের নেজারতে, যার মধ্যে ছিল ওসমানীর মুদ্রিত স্বাক্ষর দেওয়া নাম-ঠিকানাহীন অজস্র সার্টিফিকেটও।
আমার তখনই মনে হয়েছিল, গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের এভাবে সার্টিফিকেট দেওয়ার প্রক্রিয়াটি প্রশাসনিক দিক থেকে গোলমেলে। মহকুমাভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পগুলো তাড়াতাড়ি বন্ধ করার মানসে এভাবে সার্টিফিকেট বিতরণের কাজটিতে যে প্রশাসনিক দুর্বলতা ছিল, তার ফলেই পরে এসব সার্টিফিকেটের অপব্যবহার হয়েছে। এ নিয়ে অনেকে কথা বলেছেন, লিখেছেন বটে, কিন্তু সমাধানের যথাযথ পথ নিয়ে কেউ ভাবেননি। একটি নাম-ঠিকানাহীন সার্টিফিকেট কোনোভাবে হস্তগত করে নিজের নাম-ঠিকানা লিখে নিয়ে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন বলে ব্যঙ্গার্থে অনেকে বলতেন ‘ষোড়শ বাহিনী’র মুক্তিযোদ্ধা। এমন অনৈতিক কাজটি যাঁরা করতে পেরেছেন, তাঁরা আরও অনেক অনৈতিক কাজে জড়িত হতে পারেন—এ কথা কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। অনেক দিন পর্যন্ত তাঁরা সেসব সার্টিফিকেটের বদৌলতে পাকিস্তানি নাগরিক ও বিহারিদের বাড়ি-গাড়ি-কল-কারখানা দখল করে নিজের করে নিয়েছেন। অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা রিকশা চালিয়ে, ঠেলাগাড়ি ঠেলে, ভিক্ষা করে জীবন যাপন করেছেন এবং এখনো করছেন। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি: গণবাহিনীর কোনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কোনো কিছু পাওয়ার আশায় মুক্তিযুদ্ধে যাননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই মনে করেছেন তাঁদের খুব বড় এক প্রাপ্তি। আমার মনে হয়, বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সরকারই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ কিছু সুযোগ-সুবিধার ঘোষণা দিয়ে একদল স্বার্থান্বেষীকে যেভাবেই হোক মুক্তিযোদ্ধার পরিচিতি অর্জনের জন্য প্রলুব্ধ করেছে।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যাচাই-বাছাইয়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পন্থাটি বেছে নেওয়া হয় বিগত আওয়ামী লীগের আমলে সংসদের সভাপতি অধ্যক্ষ আবদুল আহাদের উদ্যোগে। এর কারণ, এই সংসদে উপজেলা, এমনকি ইউনিয়নভিত্তিক অফিস স্থাপনের পর তাঁদের মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা শনাক্ত করা হয় এবং মুক্তিবার্তা নামের একটি গেজেটে উপজেলার ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে ‘ষোড়শ বাহিনী’র লোকজন বাদ পড়ে। কারণ কে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আর কে ছিলেন না, তা কোনো এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা এমনকি জনগণও ভালো করেই জানে। স্থানীয় দপ্তরগুলো থেকে পাঠানো তালিকা তাই নির্ভরযোগ্য হতে বাধ্য।
বিএনপির সর্বশেষ শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা আবারও নতুন করে যাচাই-বাছাই করা হয়। তখনো মুক্তিযোদ্ধাদের স্থানীয় কার্যালয় থেকে পাঠানো তথ্যকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আবারও ঘোষণা দিয়েছে যাচাই-বাছাইয়ের। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে অনেক অমুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থান পেয়েছেন। এটি কী করে সম্ভব হলো তা আমার বোধগম্য নয়। তবে কি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লোকজন স্থানীয় দপ্তর থেকে পাঠানো তথ্যের তোয়াক্কা না করে প্রভাবশালী কারও তদবিরে তালিকায় নতুন নাম যোজনা করেছেন? কিন্তু আমি তো চেষ্টা করেও আমার কলমি নামটি আসল নামের সঙ্গে বন্ধনী দিয়েও ঢোকাতে পারিনি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, নামে কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। কারণ পিতার নাম ও ঠিকানা এক হলেও এমনও তো হতে পারে, আপনি তাঁর ভাই, মুক্তিযুদ্ধ করেননি!
আমার কাছে মনে হয়, সব সরকারই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এক ধরনের তামাশা করছে। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে যাঁরা কোনো বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেতে চান না, এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা ‘যাচাই-বাছাই’ শব্দটি শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেছেন। নিজ এলাকার বাইরে কিংবা বিদেশে থাকেন, এমন মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে সম্ভব হয় না বারবার ফরম পূরণ অথবা যাচাই-বাছাইকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা।
তাই আমার মনে হয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের এভাবে হেনস্তা না করে পঙ্গু এবং অতিদরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া অন্য সবাইকে কোনো বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিধান বাতিল করে প্রকৃত রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নে হাত দেওয়া উচিত। যাঁরা এই তালিকায় থাকবেন না, তাঁরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য। আমরা অস্ত্রধারী হওয়ায় অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধকালে যেসব পরিবার আমাদের এক বেলা খাবার দিয়ে বা এক-দুই দিনের জন্য আশ্রয় দিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের হাতে সবকিছু খুইয়েছে, পরিবারের উপার্জনকারী সদস্যকে হারিয়েছে—তাদের আত্মত্যাগকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। তাঁরা ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ না নেওয়ার কারণে ওসমানীর সার্টিফিকেট যেমন পাননি, তেমনি পরবর্তীকালেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় স্থান পাননি।
আবিদ আনোয়ার: কবি, প্রাবন্ধিক।

No comments

Powered by Blogger.