আবাসিক এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকবে কেন -যানজট নিরসন by এ এইচ এম জেহাদুল করিম

গত চার-পাঁচ বছরে আমাদের দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অতি দ্রুত বেড়েছে। উচ্চশিক্ষার এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরু এবং শেষ হওয়ার সময় এক অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে এসব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান কম না হলেও দেশের ৫১টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪২টিই ঢাকায় অবস্থিত। এগুলোর বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরার আশপাশের বড় রাস্তা ও আবাসিক এলাকাগুলো ঘিরে। এসব এলাকায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার পেছনে বাস্তব কারণ অবশ্য রয়েছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি অনেক বেশি হওয়ায় ধনী পরিবারের সদস্যরাই সেখানে বেশি ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। তাই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠাতারা স্বাভাবিকভাবেই বাণিজ্যিক ও বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো বেছে নিয়েছে বলে আমাদের ধারণা।
কিন্তু প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে লাগামহীন অনুমতি দেওয়ার বেলায় সম্ভাব্য সমস্যাগুলোর কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা করেনি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এখন এসব একযোগে সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে সরকার আবাসিক এলাকা থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরিয়ে নেওয়ার একাধিক উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে তা ফলপ্রসূ হয়নি। কিন্তু আগের এই আদেশ নতুনভাবে কার্যকর করতে সচেষ্ট হওয়া উচিত বর্তমান সরকারের। বস্তুত অগণিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যত বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকায় বাড়ি ভাড়া করে চলার কথা নয়। কেননা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী, নিজস্ব ভবনে এবং নির্দিষ্ট জমির ওপরই তাদের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার কথা। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কখনোই সেই আইন মেনে চলেনি।
তবে স্থান পরিবর্তনের বিষয়টি শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যই প্রযোজ্য হতে হবে; ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুলের বিষয়ে এটি বাধ্যতামূলক না হলেই ভালো হয়। যানজট এড়াতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সবার জন্য প্রযোজ্য স্কুলবাস ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া যায়। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য একটি করে নিজস্ব পরিবহন ব্যবহার করতে দিলে অহেতুক রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ে। অথচ একটি স্কুলবাসে একসঙ্গে ৫০ থেকে ৫২ জন শিক্ষার্থী স্কুলে যেতে পারে। শ্রেণী-মর্যাদার দিক থেকেও এটি প্রশংসনীয়, কেননা এতে ধনী-দরিদ্র সর্বস্তরের ছেলেমেয়ে একই পরিবহন ব্যবহার করে স্কুলে যাতায়াত করার কারণে নিজেদের মধ্যে শ্রেণীবৈষম্যের বোধ কমে এক ধরনের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার জন্য ঢাকাকেই তীর্থস্থান হিসেবে গণ্য করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। শ্রীলঙ্কাতে ইউজিসির মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে আঞ্চলিক ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র ভর্তির অনুমোদন করা হয়। এতে ‘মেট্রোপলিটন ক্যাপিট্যাল সিটি’র ওপর অহেতুক জনচাপ ও পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি হয় না। আমাদের দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতেও বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার অনুমোদন দেওয়া যায়। এবং এতে ঢাকার ব্যস্ততা কমবে, এটি একটি যানজটমুক্ত শহর হিসেবে রূপান্তরিত হতে পারবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে, ঢাকায় অবস্থিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ‘শিক্ষা অঞ্চল’ গড়ে তোলা যায় এবং সেই উদ্দেশ্যে কিছু কিছু এলাকাকে নির্দিষ্টও করে দেওয়া যায়। সম্ভবত ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি ও নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি অচিরেই বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাস চালু করতে যাচ্ছে। অনুরূপভাবে, আরও দু-চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নবপরিকল্পিত পূর্বাচল প্রকল্প অঞ্চল নির্দিষ্ট করা যায়। এ লক্ষ্য সামনে রেখে সরকার ঢাকা শহরসংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় কিছু জমি অধিগ্রহণ করে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্দিষ্ট করে দিতে পারে। সম্পূর্ণভাবে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে বিশ্ববিদ্যালয় করতে চাইলে, সেগুলোকে গাজীপুর বা দূরবর্তী কোনো স্থানে সরিয়ে নেওয়া যায়। পাশাপাশি এরই মধ্যে ঢাকার যানজট সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। ট্রাফিক পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য রাস্তাঘাটসম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট আইনের বাস্তবায়নসহ ‘প্ল্যানড্ ট্রাফিক রুলস’ প্রণয়ন করতে হবে। তাতে নগরবাসী ও ছাত্রছাত্রীদের দূর এলাকায় যাতায়াতসংক্রান্ত সময়ের দীর্ঘসূত্রতাও কমবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস সময়সূচি একই হওয়ার কারণেও ঢাকার রাস্তাঘাটগুলোতে বিশেষ বিশেষ সময়ে প্রচণ্ড যানজটের সৃষ্টি হয়। এই সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সময়সূচি পরিবর্তনের জন্য এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিভিন্ন মাধ্যমে অনুরোধ করা হয়েছিল এবং তখনই স্কুল শুরুর সময় এগিয়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু হয়। অতি সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে উচ্চপর্যায়ের এক সভায় এটি গৃহীত হয়। এ ছাড়া ২০০৮ সালের দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ঢাকায় অবস্থিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সকাল সাড়ে সাতটায় ক্লাস শুরুর আদেশ জারি করা হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা-কর্তৃপক্ষ অবশ্য তখন সেই সিদ্ধান্তে কিছুটা নমনীয় হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একজন উপাচার্য তখন এই মর্মে প্রতিবাদ করেছেন যে তাঁদের ছেলেমেয়েরা এত ভোরে ক্লাস করায় অভ্যস্ত নয়। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অতি প্রত্যুষে তাদের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ক্লাস শুরু করে। অনেক দেশের উদাহরণ দেওয়ার প্রয়োজন এখানে আছে বলে মনে করি না; তবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মালয়েশিয়ায় আমি দেখেছি যে আমাদের ঘুম ভাঙার আগেই ভোর সাতটার মধ্যে স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের প্রস্তুত করে স্কুলবাসে উঠে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সকাল আটটায় ক্লাস শুরু হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নকালে প্রচণ্ড তুষারপাতের মধ্যেও আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের সকাল সাতটার মধ্যে স্কুলবাসে তুলে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে গিয়েছি। এমন প্রতিকূল ও বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও সেখানে অতি ভোরে শুরু হওয়া স্কুল-সময়সীমার ক্ষেত্রে তাদের কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটাতে দেখিনি, বরং ওই দেশের ছেলেমেয়েরা নির্দ্বিধায় সেই বরফস্নাত ভোরেই যথারীতি তাদের ক্লাসে উপস্থিত হয়ে যেত।
যা হোক, আমাদের দেশে আমরা অতি প্রত্যুষেই ঘুম থেকে উঠতে অভ্যস্ত। ঐতিহ্যিকভাবেই, আমরা গ্রামের মানুষ রাতে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি এবং অতি ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম শুরু করি। বলতে দ্বিধা নেই, এই বাস্তবসম্মত ব্যবস্থাই মেনে চলছে পাশ্চাত্য জগত্ এবং পৃথিবীর অনেক দেশ। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকা এবং দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা আমাদের দেশে এক ধরনের ‘শহুরে ফ্যাশন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরাও আমাদের ছেলেমেয়েদের তথাকথিত এই শহুরে সিস্টেমের সঙ্গে চলতে অভ্যস্ত করে ফেলেছি। সেই কারণে শুধু ট্রাফিক-জ্যাম কমানোর জন্যই যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলোতে সকালে ক্লাস শুরু করা প্রয়োজন, তা নয়; বরং আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে বংশপরম্পরায় পালিত অথচ যৌক্তিক এসব ‘প্রচলিত রীতির’ সঙ্গে মানিয়ে চলার শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রেও এটি প্রয়োজন। তাই নির্দ্বিধায় বলা চলে, সকাল সাড়ে সাতটায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ক্লাস শুরু করার সরকারি সিদ্ধান্তটি সামগ্রিকভাবে এবং আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের দৈহিক ও নৈতিক শিক্ষার বিবেচনায় যথার্থ হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু কিছু স্কুল ও কলেজ সরকারি আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর করেছে। অন্যদেরও উচিত সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করা।
এ এইচ এম জেহাদুল করিম: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং সাবেক উপাচার্য, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.