যেভাবে মাদকের অন্ধকার রাজ্যে তরুণীরা by রুদ্র মিজান



সুদর্শনা। দেখতেও সুন্দরী। মা-বাবার আদরের মেয়ে। কোনো কিছুর কমতি নেই। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি, গাড়ি। ভালো প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করতেন তিনি। একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেন। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিবেন। এরকম স্বপ্ন   নিয়েই এগুচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই একটি ঝড় আসে। হতাশায় আচ্ছন্ন হন। হাঁটতে থাকেন অন্ধগলিতে। নিজের অজান্তেই মাদকের কাছে সমর্পণ করেন নিজেকে। সিগারেট থেকে গাঁজা তারপর ইয়াবা। সবার অজান্তেই তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছিলেন মেধাবী তরুণী। শুধু সুদর্শনা নন। মাদকাসক্ত কয়েক তরুণীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে মাদকে আক্রান্ত হওয়ার করুণ গল্প। হতাশা থেকে মুক্তি পেতে, কৌতূহলে, নিজেকে স্লিম করার প্রলোভনে তারা মাদক গ্রহণ করেছেন। তারপর মাদক গ্রাস করেছে তাদের সুন্দর জীবন। একপর্যায়ে মাদকের টাকার জন্য নিজের শরীর বিক্রি করেছেন অনেকে। চুরি, ছিনতাইসহ করেছেন নানা অপকর্ম। পরিবারের অশান্তির মূল কারণ হয়েছেন।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর মেয়ে সুদর্শনা। লেখাপড়া করতেন ধানমন্ডির চার্টার্ড ইউনিভার্সিটি কলেজে। সহপাঠীদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিতেন। বন্ধুদের মধ্যে ইফাত নিয়মিত গাঁজা সেবন করতেন। তা জানতেন তিনি। জানতে চাইতেন কেন গাঁজা সেবন করে। সেবনের পক্ষে নানা যুক্তি দেখাতেন ইফাত। কৌতূহলের বশেই একদিন ইফাতের সঙ্গে থাকা গাঁজা ভরা সিগারেটে টান দেন। কয়েক বার। সুদর্শনা বলেন, ‘স্লো মোশনে টানছিলাম। ভালো লাগছিল। ওই সময়ে লোহার বেঞ্চে লেগে আমার পা কেটে যায়। কিন্তু টেরই পাইনি। এক বন্ধু বলার পর দেখলাম, রক্ত ঝরছে।’ তারপর ব্যান্ডেজ করে বাসায় গিয়ে ঘুমান। ঘুম থেকে জেগে ব্যথা অনুভব করেন। ঘটনাটি ২০১১ সালের। তখনও তিনি আক্রান্ত হননি। ওই সময়ে আসিফ নামে এক তরুণের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। আসিফ ধূমপায়ী ছিলেন। তিনি সুদর্শনাকেও সিগারেট টানতে দিতেন। তবে ছেলেদের সঙ্গে সুদর্শনার আড্ডা, বন্ধুতা মেনে নিতে পারতেন না আসিফ। এ নিয়ে দু’জনের বাকবিতণ্ডা হতো প্রায়ই। এসবকে কেন্দ্র করেই ঝড় আসে ২০১৪ সালে। সম্পর্ক ভেঙে যায় তাদের। তার কিছুদিন আগে সুদর্শনার মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটে। সবকিছু মিলিয়ে হতাশাগ্রস্ত এই তরুণী। শান্তি, স্বস্তি খোঁজেন। ইফাতের মাধ্যমে কচুক্ষেত এলাকা থেকে নিয়মিত গাঁজা সংগ্রহ করেন। তা সেবন করেন নিজ বাসাতেই। রুমের দরজা বন্ধ করে সিগারেটে গাঁজা ভরে তা সেবন করতেন। গন্ধ না ছড়ানোর জন্য পারফিউম দিতেন। গাঁজাতে আগ্রহ কমতো মাঝে মাঝে। এ সময় জানেন ইয়াবা সম্পর্কে। হাত বাড়ান ইয়াবার দিকে। ইউটিউবে দেখে শিখে নেন কিভাবে সেবন করতে হবে ইয়াবা। অতঃপর ইফাতের দেয়া তথ্যানুসারেই গুলশান-২ এলাকার এক বিক্রেতার কাছ থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করেন। বাসায় বসেই সেবন করেন ইয়াবা। বুঁদ হয়ে যান নেশায়। হারিয়ে যান অন্য দুনিয়ায়। কোনো কষ্টের অনুভূতি জাগে না। পরদিন একটা অভাব অনুভব করেন। অতঃপর আবার ইয়াবা সেবন করেন। এভাবেই চলতে থাকে। ইয়াবা ছাড়া আর চলে না। ইয়াবা সেবন না করলে মেজাজ রুক্ষ হয়ে থাকতো। অল্পতেই রেগে যেতেন। চিৎকার, ভাঙচুর করতেন। মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন। কথা বলার এক পর্যায়ে চোখের কোণে অশ্রু জমাট হয় সুর্দশনার। বলেন, ‘২০১৬ সালের আগস্টে আমি আম্মুর গায়ে হাত তুলেছি। তারপরই আম্মু আমাকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করেন। এখানে ভর্তি হওয়ার পর মনে হয়েছে আমিতো এমন কোনো অপরাধ করিনি। কেন আমাকে চিকিৎসা করাতে হবে। ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারি। এতদিন অন্ধকারে ছিলাম। এখন বেশ ভালো আছি।’
রাজধানীর একটি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী মোহনা। লম্বা, শ্যামলা, সুন্দরী। তার চোখে-মুখে অনেক মায়া। মায়াবী এই মোহনা  সহজেই নজর কাড়তেন যুবকদের। প্রেমের প্রস্তাব পেতেন অহরহ। বিলাসী জীবনের প্রতি ঝোঁক ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের এই তরুণীর। পরিবারের অমতেই ভালোবেসে ঘর ছাড়ে মুকুল নামক যুবকের সঙ্গে। ঘটনাটি ২০১০ সালের। মোহনা জানান, মুকুল ভালো চাকরি করেন জানতেন। কিন্তু পরে জানতে পারেন তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি চালক। যৌথজীবন যাপনে অভাব লেগেই থাকতো। অর্থের জন্য তারকা হোটেলের বিভিন্ন পার্টিতে নাচ করেন মোহনা। কিন্তু মোহনার শরীরের ওজন বাড়ছিল। মোটা দেখাচ্ছিল। মোহনার ভাষায়, ‘মোটা মেয়েদের পার্টিতে কদর কম। তাই স্লিম হওয়ার জন্য সহকর্মী চিয়ার্সগার্লদের পরামর্শ নিয়ে ইয়াবা সেবন শুরু করি।’ তারপর থেকে স্লিম থাকার জন্যই নিয়মিত ইয়াবা সেবন করেন। ওই সময়ে তার প্রেমিক মুকুলের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যায়। কারণ হিসেবে জানান, তার উপার্জনের পুরো টাকা নিয়ে যেতেন মুকুল। ততদিনে অনেক বন্ধু জুটেছে মোহনার। নিয়মিত পার্টিতে অংশ নেন। বাসা নেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। ততদিনে ইয়াবা সেবন করে স্লিমও হয়েছেন। কিন্তু বিলাসী জীবনযাপনের জন্য আরো অর্থ দরকার। বেশি অর্থ উপার্জনের জন্য পার্টিতে যৌনসঙ্গী হন অনেকের। ছুটে যান দেশের বিভিন্ন স্থানে। দীর্ঘসময় পুরুষকে আনন্দ দিতে এবং নিজেকে স্লিম রাখতে ইয়াবা সেবন করেন প্রতিদিন। একদিন সেবন না করলে কিছুই ভালো লাগে না। পার্টি, সঙ্গী সব অসহ্য লাগে। ইয়াবা ছাড়া চলে না। এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে যান এই তরুণী। দীর্ঘ ৭ বছর পর গত ৮ই মার্চ ফোনে মা-বাবাকে জানান তিনি গুরুতর অসুস্থ। বলেন, ‘আমি অনেক অপরাধ করেছি মা। আমি বোধ হয় আর বাঁচবো না। আমাকে তোমরা বাঁচাও।’ বাসার ঠিকানা জেনে মা-বাবা ছুটে যান। বিলাস বহুল ফ্ল্যাটে ঢুকতেই বুঝতে বাকি নেই তাদের আদরের মেয়েটি অন্ধকারের বাসিন্দা। অ্যালকোহলের বোতলে সাজানো ফ্রিজ খুলে তারই প্রমাণ পান। অতঃপর এই তরুণী এখন একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
অর্পা। একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রী। বাসা মগবাজারে। অর্থের অভাব না থাকলেও ভালোবাসার অভাব ছিল তার। অর্পার বয়স তখন দুই বছর। বাবাকে ছেড়ে মা ঘর বাঁধে অন্যের সঙ্গে। তাকে বড় হতে হয় সৎ মায়ের কাছে। অনাদর-অবহেলার মধ্যে ভরসা ছিলেন দাদি। তবে শাসন-বারণ তেমন না থাকায় চলাফেরা ছিল বেপরোয়া। সময়ে-অসময়ে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। আড্ডায় সিগারেট থাকতোই। নানা দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারতেন না। তাই স্ল্লিপিং পিল সেবন করতেন অর্পা। আড্ডাতে গিয়েই এক তরুণকে বয়ফ্রেন্ড হিসেবে বেছে নেন তিনি। তার বয়ফ্রেন্ড সেবন করতেন ইয়াবা। পারিবারিক যন্ত্রণা ভুলে থাকতে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে তিনিও হাত বাড়ান মরণনেশার দিকে। এভাবে কিছুদিন। তারপর নানা মিথ্যা বলে দাদির কাছ থেকে টাকা নিয়ে ক্রয় করতেন ইয়াবা। লেখাপাড়া বাদ দিয়েই মাদকে ডুবে যান অর্পা। দাদি টাকা না দিলে চুরি করতে বাধ্য হন। বাসার দামি জিনিস বিক্রি করে ইয়াবার টাকা সংগ্রহ করেন। ইয়াবা বিক্রি করলে ফ্রি ইয়াবা সেবন করতে দেয় মাদক ব্যবসায়ীরা। সেবনের জন্য ইয়াবা বিক্রি করা শুরু করেন অর্পা। বিষয়টি জানার পর গত ২৭শে মার্চ দাদি ও ফুফু তাকে নিয়ে যান চিকিৎসকের কাছে।
টাঙ্গাইলের মেয়ে রুবি। অল্প বয়সেই বিয়ে দেয়া হয় তাকে। পরপর দুটি সংসার ভাঙ্গার পর দিশাহারা মেয়েটি অর্থ উপার্জনের জন্য বেছে নেন মাদক পরিবহনের কাজ। টাঙ্গাইল থেকে ট্রেনে দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট এলাকায় মাদক পরিবহন করতেন তিনি। পরিবহন করতে গিয়ে আসক্ত হন। তখন মাদকের নেশায় যৌনকর্মী হতেও বাধ্য হন। মাত্র কয়েক বছরেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে যান এই নারী। শেষ পর্যন্ত স্বজনরা জোর করেই তাকে ভর্তি করিয়ে দেন রাজধানীর একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। আশুলিয়ার নবম শ্রেণির ছাত্রী রোকেয়া। বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে মিশে নিজের অজান্তেই আক্রান্ত হন মাদকে। কয়েক মাস পরেই বেপরোয়া আচরণ করতে থাকেন। ঘরের টাকা, দামি জিনিস বিক্রি করে দেন। এমনকি প্রতিবেশী, আত্মীয়দের দামি মোবাইলসেটও চুরি করতে বাধ্য হন। এই কিশোরীর মতো অনেক মেয়েরা এভাবেই অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। মাদকে আক্রান্ত হচ্ছে তারা। সরকারি হিসেবে দেশের ৬০ লাখ মানুষ মরণ নেশায় আক্রান্ত। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আক্রান্তদের মধ্যে ৬,০০,০০০ হচ্ছে নারী। মাদকাসক্ত নারীদের বেশিরভাগ উচ্চবিত্ত পরিবারের। আক্রান্ত নারীদের ৪০ শতাংশ হচ্ছেন শিক্ষার্থী। ২০১৪ সালে দেশে নারী মদ পানকারীর সংখ্যা ছিল ৪,১০,০০০। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪,৯০,০০০ জনে। ২০১৬ সালে এই সংখ্যা গিয়ে ঠেকে ৫,৬০,০০০। বর্তমানে দেশে নারী মদ পানকারীর সংখ্যা ৬,০০,০০০।
দীর্ঘদিন যাবত নারী মাদকাসক্তদের শিক্ষাব্রতী হিসেবে কাজ করছেন সেলিনা আক্তার শেফা। নারীদের মাদকাসক্তির বিষয়ে বর্তমানে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র বারাকা’র এডুকেটর শেফা বলেন, ‘কৌতূহলে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, পারিবারিক হতাশার কারণে মাদকাসক্ত হচ্ছে মেয়েরা। মাদক বলতে মূলত ইয়াবা ও গাঁজায় আক্রান্ত হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ মেয়েরা স্ল্লিম হওয়ার জন্য ইয়াবা সেবন করছে। পরবর্তীতে আক্রান্ত হয়ে নিজের জীবন ধ্বংস করছে। এমনকি পরিবারকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে।’

No comments

Powered by Blogger.