সরজমিন ওসমানী উদ্যান: রাতে যৌনকর্মী দিনে ভবঘুরের উৎপাত by আবদুল আলীম



রাত ৮টায় গেট বন্ধ হওয়ার নিয়ম ওসমানী উদ্যানের। সময় মতো বন্ধও হয়েছে। তবে ভেতরে বহু মানুষের আনাগোনা। একের পর এক মানুষ ঢুকছে। কেউ যাচ্ছে ভাসমান যৌনকর্মীর কাছে, আবার কেউ যাচ্ছে গাঁজার আসরে। বুধবার রাতে সিটি করপোরেশনের এক কর্মচারীর সহযোগিতায় ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, একদল হিজড়া অভ্যর্থনায় দাঁড়িয়ে। পশ্চিম পাশের লেকের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যেতেই শুরু হয়ে যায় টানাটানি। কিছুদূর এগিয়ে সচিবালয়ের কোলঘেঁষা নিরাপত্তা বেষ্টনীর কাছে পৌঁছলে দেখা যায়, আধো জোছনায় পায়ে হাঁটার রাস্তার ওপরই চলছে যৌনকর্মীদের কার্যক্রম। একশ্রেণির মানুষ পার্কে প্রবেশ করে যৌনকর্মীদের সঙ্গে ফূর্তি করছে। নিরাপত্তাকর্মীদের ব্যারাকের পাশে দেখা যায় জটলা। সেখানে ১০-১২ জন দলবেঁধে গাঁজা খাওয়ায় মত্ত। নিরাপত্তা কর্মীদের ব্যারাকের সামনেই গাঁজার আড্ডা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিরাপত্তাকর্মীদের মাসোহারা দিয়েই তারা নিয়মিত এখানে বসে গাঁজা সেবন করে। অনেক সময় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরাই আসরে গাঁজা সরবরাহ করে। আবার হিজড়া বা যৌনকর্মীরাও গার্ডদের নিয়মিত নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা দিয়ে পার্কের ভেতরে কার্যক্রম চালায়। পার্কের সকল গেট বন্ধ থাকলেও নগর ভবনের মূল ফটকের সামনেই পার্কের নিরাপত্তা বেষ্টনীর লোহার সিক ভেঙে বেশ কয়েকটি দরজা বানিয়েছে সুবিধাবাদীরা। সেখান দিয়েই ভেতরে যাওয়া আসা করে এসব মানুষ। রাতের চিত্র অসামাজিকতায় ভরা হলেও দিনের চিত্রও কম না।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ওসমানী উদ্যানে গিয়ে দেখা যায়, অসংখ্য ভবঘুরের দল জটলা পাকিয়ে বসে আছে পার্কজুড়ে। পাশ দিয়েই যাওয়া যায় না গাঁজার উৎকট গন্ধে। প্রকাশ্যে চলে ইয়াবা হেরোইনসহ নেশা দ্রব্য সেবন। পার্কের বিভিন্ন অংশে প্রকাশ্যে দেখা যায় পাগল বেশধারী বেশ কিছু নেশাজাতীয় দ্রব্য বিক্রেতা। শুধু নেশাখোরই না, দিনের বেলায় রাজধানীর বিভিন্ন ধরনের ভবঘুরেও দখলে রাখে ওসমানী উদ্যান। চুরি ছিনতাই থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার মানুষের আশ্রয়স্থল ওসমানী উদ্যান। ভাসমান হকার তো আছেই। গাছের ফাঁকে ফাঁকে খালি জায়গা পেয়ে তাতে ক্রিকেট খেলায় মেতে রয়েছে বহিরাগত ছেলেরা। মাঠজুড়ে আছে চিপস, বিস্কুট ও চানাচুরের প্যাকেটসহ অসংখ্য ময়লা-আবর্জনা। ডাস্টবিন ভরে উঠেছে ময়লা-আবর্জনায়। তবে পরিষ্কার করার কেউ নেই। দিনের পর দিন ডাস্টবিন ভরে থাকলেও পরিষ্কার করে না পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। রাজধানীবাসীর নির্মল পরিবেশে হাঁটাচলা ও পথিকের ক্লান্তি দূর করার জায়গা হিসেবে পার্কটি তৈরি করা হলেও সাধারণ মানুষের বসার কোনো পরিবেশই নেই সেখানে। এছাড়া পার্কের পূর্ব প্রান্তের লেকটি দখল করে দীর্ঘদিন ধরে মাছ চাষ করছেন একজন প্রভাবশালী। লেকের পাড়ে বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ করে পকেটে ভরছেন সবজি বিক্রির টাকা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের কার্যালয় নগরভবনের সামনে হলেও পার্কটি দেখার মতো কোনো অভিভাবক নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থাকলেও টহল দেন না কোনোদিন। যে যার ইচ্ছামতো ব্যবহার করছে পার্কটি। নিরাপত্তা কর্মীরা এসব বহিরাগত ও অপ্রত্যাশিতদের হাত থেকে পার্ক রক্ষা করার বদলে নিজেই তোলা উঠিয়ে সুযোগ করে দিচ্ছেন অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর। তবে এক নিরাপত্তা কর্মী জানান, আমরা প্রায় প্রতিদিনই যৌনকর্মীদের পিটিয়ে বের করে দিই। একদিক দিয়ে পিটাই অন্যদিক দিয়ে আবার প্রবেশ করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওসমানী উদ্যানের নিরাপত্তা ও সার্বিক বিষয় দেখাশোনায় কর্মরতদের সমন্বয় করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর অঞ্চলের ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু নাসের কোচির ওপর। যোগাযোগ করা হলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, পার্কের অবস্থা আগে আরো খারাপ ছিল। আমি প্রায়ই অভিযান চালাই সেখানে। নিরাপত্তা কর্মীদের কঠোর নির্দেশ দেয়া আছে কোনো ধরনের আপত্তিকর কাজ যেন কেউ না করতে পারে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রকল্প পরিচালক এসএম আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা সব পার্কের উন্নয়নের জন্য বড় একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। সব পার্ক ব্যবহার উপযোগী করা হবে। এতে পার্কের নিরাপত্তা বেষ্টনীর উন্নয়ন, ভেতরের রাস্তা, বসার জায়গা, সবুজায়ন, সুপেয় পানি ও উন্নত মানের টয়লেটসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন করা হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে পার্কের ভেতরে কোনো ভবঘুরে বা অপ্রত্যাশিত লোকজন পাওয়া যাবে না।

No comments

Powered by Blogger.