জঙ্গিবাদের উৎস সন্ধানে

পৃথিবী বদলাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে মানুষের ধ্যান-ধারণা। প্রযুক্তি, সংস্কৃতির চর্চা, নিজস্ব ইতিহাস আর ঐতিহ্য মানুষের জীবনকে আধুনিক, উদার ও সৃষ্টিশীল হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করলেও এক ধরনের উগ্রবাদী চিন্তা ও রক্ষণশীলতা মানুষের মধ্যে পশ্চাদমুখিতা তৈরি করছে। এ ক্ষেত্রে মানুষ তার নিজের চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করতে পারছে না। আর যখন মানুষের নিজের ভালো-মন্দ বিচার করার চিন্তাশক্তি লোপ পায়, তখন সে অন্যের দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়। আর এ প্রভাব যদি পর্দার অন্তরালে থাকা জঙ্গিবাদের খলনায়করা করে থাকে, তখন তাদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে সাধারণ মানুষও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং গবেষণার মাধ্যমে এ বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা দরকার। কারণ অগ্রসরমান সমাজে জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। সময়ের সঙ্গে জঙ্গিবাদীদের তৎপরতা ও কৌশল পরিবর্তিত হচ্ছে। এ পরিবর্তনগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এর মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করার মতো গবেষণা তেমন একটা লক্ষ করা যাচ্ছে না। জঙ্গিবাদের উৎস এবং কীভাবে একজন সাধারণ মানুষ জঙ্গিতে পরিণত হচ্ছে সে বিষয়টিতে গুরুত্ব প্রদান না করায় জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করছে। সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদের কৌশল বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয়, পর্দার অন্তরালে থেকে যারা জঙ্গিবাদের ধারণাকে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে, তারা কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছে।
প্রথমে তারা একজন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বিচার-বিশ্লেষণ করে তাকে জঙ্গিবাদের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করছে। এরপর গোপন স্থানে তাকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত করছে। যখন তারা নিশ্চিত হচ্ছে যে, প্রশিক্ষণ যথাযথভাবে সম্পূর্ণ হয়েছে, তখন তাকে আক্রমণের জন্য বিভিন্ন মিশনে প্রেরণ করছে। অর্থাৎ তারা জঙ্গিবাদের কার্যক্রমকে তিন ভাগে ভাগ করেছে- সদস্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ ও অপারেশনে প্রেরণ। বিভিন্ন জঙ্গিবাদের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এতে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসের কোনো প্রভাব পড়েনি। জঙ্গিবাদে নিন্মবিত্ত, নিন্মমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সব শ্রেণীর মানুষেরই সম্পৃক্ততা রয়েছে। আবার আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভিন্নতার কারণে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন মনমানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠছে। ফলে জঙ্গিবাদে শ্রেণীগত বিভাজনের প্রভাব না থাকলেও অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় তা আগামী প্রজন্মের মধ্যে মতভিন্নতা তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। এ মতভিন্নতার কারণে সমাজে এক ধরনের অসম অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর এ অস্থিরতাকে পুঁজি করে জঙ্গিবাদের মদদদাতারা পর্দার অন্তরালে থেকে কলকাঠি নাড়ছে। তারা এ বিভাজনকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন শ্রেণী ও শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে জঙ্গিবাদের দিকে প্রলুব্ধ করছে। আবার অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীকেও তারা খুব সহজে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জঙ্গিবাদের যে বিশাল অর্থনৈতিক বলয় গড়ে উঠেছে, জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাধারণ মানুষ এবং অনেক ক্ষেত্রে সমাজে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গও এতে জড়িয়ে পড়ছে। এ বিষয়গুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারকে আগামী দিনের কর্মকৌশল গ্রহণ করতে হবে। এখানে আইন প্রয়োগের যেমন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তেমনি এর সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন রয়েছে। কেননা আইনগতভাবে বিষয়টি সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা গেলেও এর দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের ক্ষেত্রে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে।
এখানে জঙ্গিবাদের উৎসের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। জঙ্গিবাদের উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের মতামত থাকলেও আমার মতে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র জনতার ওপর যে গণহত্যা চালায়, তার মাধ্যমেই প্রথম জঙ্গিবাদের বীজ রোপিত হয়। কেননা এ গণহত্যা গভীর গোপনীয়তা বজায় রেখে বড় ধরনের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ঠাণ্ডা মাথায় চালানো হয়েছিল, যেটা জঙ্গিবাদেরই স্বরূপ। সাম্প্রতিককালে অতর্কিত হামলার মাধ্যমে জঙ্গিবাদীরা যেভাবে নিরীহ মানুষদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, তার সঙ্গে ২৫ মার্চের গণহত্যার সাদৃশ্য রয়েছে। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, বর্তমান সময়ে অনেক ক্ষেত্রে উদার মনোভাবাপন্ন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিদের বেছে বেছে জঙ্গিবাদীরা হত্যা করছে, যার সঙ্গে ১৪ ডিসেম্বর উদারমনা ও সৃজনশীল চিন্তাধারার বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মিল রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর জঘন্যতম ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার মাধ্যমে। এ ঘটনায় শেখ রাসেলের মতো নিষ্পাপ একজন শিশুকেও নির্মম হত্যার শিকার হতে হয়েছিল। নারীরাও এ হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পাননি। তাই বলা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও পরাজিত শক্তি জঙ্গিবাদের যে শেকড় রেখে গিয়েছিল তা আজও বিদ্যমান রয়েছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ গঠিত হলেও পরাজিত শক্তির দোসররা এটাকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে বিভিন্ন সময়ে তারা হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের হত্যা করেছে। তাদের উপাসনালয়ে হামলা চালিয়েছে। তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করলেও তাদের হাত থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ও রক্ষা পায়নি। এর মূল কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা তারা মেনে নিতে পারেনি। আরেকটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়, বাংলাদেশ যখন উন্নত রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগিয়ে চলেছে, তখন বন্ধুপ্রতিম বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছে। এর পেছনে যে অপকৌশলটি কাজ করছে তা হল বাংলাদেশকে অকার্যকর ও বন্ধুহীন রাষ্ট্রে পরিণত করা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এক জনসভায় গ্রেনেড হামলা করা হয়। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, আগস্টেই এ জঙ্গিবাদের ঘটনাগুলো ঘটেছে। আবার আগস্টেই বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনাটি ঘটেছিল। ফলে সমীকরণটি মেলানো খুবই সহজ। এ বছর ২৬ মার্চ জাতি যখন স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস পালন করছিল, এমন এক সময়ে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ীর জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলের পার্শ্ববর্তী এলাকায় হত্যাকাণ্ড ঘটে। কুমিল্লা, মৌলভীবাজার, ঢাকায় আত্মঘাতী জঙ্গিদের তৎপরতা এ মার্চেই ঘটেছে। যা একই সূত্রে গাঁথা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে না পারা অপশক্তিদের সুতার টানেই এসব ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়। স্বাধীনতার প্রধান একটি অঙ্গীকার ছিল মুক্তচিন্তা ও সংস্কৃতির চর্চা করা। এ সংস্কৃতি চর্চার ওপরও জঙ্গিবাদীরা আক্রমণ চালিয়েছে।
১৯৯৯ সালে ৬ মার্চ উদীচীর অনুষ্ঠান এবং ২০০১ সালে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনা প্রকৃতপক্ষে বাঙালি সংস্কৃতির ওপর জঙ্গিবাদীদের আক্রমণ। এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, পরাজিত শক্তিরা এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে এবং তাদের দোসরদের মাধ্যমে এ ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে। নারী সমাজকে পিছিয়ে দেয়ার হীন উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের দ্বারা আত্মঘাতী হামলার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব^ ও সামাজিক চাপ তৈরি করে তাদের শিশু সন্তানদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। জঙ্গিবাদীরা সুকৌশলে পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থার কাঠামো তৈরি করে তাদের মধ্যে রক্ষণশীলতা তৈরির চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কেননা জঙ্গিবাদীদের কাছে মানবিক সম্পর্কের বিষয়গুলো গৌণ আর তাদের উদ্দেশ্য সাধনই মুখ্য। এটা তাদের এক ধরনের কৌশলেরই অংশ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে এ জঙ্গিবাদকে প্রতিরোধ করা যায়? এটি রোধ করতে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের যেমন প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি এ জঙ্গিবাদকে প্রতিরোধ করার কৌশলগত বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে। ইতিহাস ও বাঙালির প্রকৃত সংস্কৃতিকে শিক্ষার প্রধান অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। যদিও পরাজিত শক্তি সুকৌশলে শিক্ষার ভেতরে ঢুকে সার্বজনীন শিক্ষার জায়গায় রক্ষণশীল শিক্ষার ক্ষেত্র ইতিমধ্যে তৈরি করে ফেলেছে। যারা শিক্ষাকে দূষিত করল সেই জ্ঞান পাপীদের স্বরূপ আজ পর্যন্ত উদঘাটন করা যায়নি। তবে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, প্রচুর বিস্ফোরকসহ জঙ্গিবাদীরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাদের আস্তানা গড়ে তুলেছে। কীভাবে আইনশৃংখলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে এ বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও আগ্নেয়াস্ত্র মজুদ করা হচ্ছে,
তা নতুন করে ভেবে দেখা দরকার। নজরদারির ক্ষেত্রে আইনশৃংখলা বাহিনীর অবহেলা রয়েছে কিনা অথবা তাদের সংখ্যা পর্যাপ্ত কিনা এ বিষয়টি ভাবতে হবে। রাস্তায় চলাচলকারী সন্দেহভাজনদের যাতে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে শনাক্ত করা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। কোন কোন এলাকায় জঙ্গিবাদীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে তা চিহ্নিত করে নির্মূলের ব্যবস্থা নিতে হবে। কেন হঠাৎ করে একজন তরুণ অথবা চাকরিজীবীর মনোভাবের পরিবর্তন ঘটছে তা দৃষ্টিগোচরের মধ্যে আনা প্রয়োজন। প্রতিটি এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সেই এলাকার বিভিন্ন পরিবারের সদস্যদের প্রতি মাসে বিভিন্ন কার্যক্রমের তথ্য প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। মসজিদের ইমামদের জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করার ব্যবস্থা নিতে হবে। জঙ্গিবাদের সঙ্গে যে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, ইমামদের মাধ্যমে এর ধর্মীয় ব্যাখ্যা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা ও স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা জঙ্গিবাদের উৎসকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এখন প্রয়োজন এ উৎসের দোসর হয়ে যারা কাজ করছে তাদের শনাক্ত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা। হলি আর্টিজান আর শোলাকিয়ার ঘটনা প্রমাণ করে জঙ্গিদের কোনো ধর্ম নেই, দেশ নেই, মানবতাবোধ নেই। এরা খুনি আর সন্ত্রাসী। এদের শনাক্ত করে দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। সামাজিকভাবে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করে এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আর এখনই এর উপযুক্ত সময়।
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
asadymn2014@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.