অখিলেশ যেখানে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে

কাওয়াল নামে সবুজে সবুজ যে গ্রামে ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রথম গোলমালটা বেধেছিল, সেখানে এখন একাধিক পুলিশ চৌকি বারোমাস তিন শ পঁয়ষট্টি দিন সজাগ। সেচের যে খাল পেরিয়ে গ্রামে যেতে হয়, তার কিনারেই প্রথম চৌকি। বাইরের লোকদের সেখানেই প্রথম জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গ্রামেও জায়গায় জায়গায় এক-দুজন করে পুলিশি প্রহরা। এমনিতে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু মানুষের মনে যে একটা পাঁচিল উঠে গেছে, কথা বললেই তা বোঝা যায়।
সাড়ে তিন বছর কেটে গেছে। এখনো সবাই সাবধািন। তিন বছর আগে লোকসভার ভোট দেখতে কাওয়াল গ্রামে ঢুঁ মেরেছিলাম। মানুষের মনে ক্রোধ ও ক্ষোভের গনগনে আগুন টের পাওয়া গিয়েছিল তখনো। হিন্দু জাঠদের রাগ ছিল সমাজবাদী পার্টির ওপর। মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশের ওপর। কারণ, মুলায়মের ছেলে নাকি মুসলমানদের আড়াল করে জাঠদের বেশি ধরপাকড় করেছেন। ঘরছাড়া হিন্দুদের গ্রামে ফেরাতে তিনি নাকি ততটা গা করছেন না। যত প্রলেপ শুধু মুসলমানদের ক্ষতে। অবাক লেগেছিল মুসলমানদের আচরণেও। তাদের অভিযোগ, মুসলমানের ভোটে জেতা মুলায়মের দল নাকি বেছে বেছে হিন্দুদের আগলে রাখছে। ক্ষতিগ্রস্ত মুসলমান পরিবারগুলোকে দেখছে না। নিরপরাধ মুসলমানদের ছাড়াতে অখিলেশের পুলিশ গা করছে না। অপরাধ ও অপরাধীর চেয়ে তাদের কাছে বড় হয়ে উঠেছে ধর্ম। বোঝা গিয়েছিল, কাওয়ালের কোনো সম্প্রদায়কেই প্রশাসন খুশি করতে পারেনি। সেই কাওয়াল এখন অদ্ভুত রকমের শান্ত। দাঙ্গার কথা তুললে সবাই সাবধানি। সামাজিক পাঁচিল এখন আরও উঁচু। একেবারে উপায় না থাকলে হিন্দুর জমিতে মুসলমান বা মুসলমানের জমিতে হিন্দু জন-মজুর কাজে যান না। সমাজপতিরা চেষ্টার অন্ত রাখেননি। কিন্তু তবু ভেঙে যাওয়া মনের সঙ্গে মনের জোড় লাগানো যায়নি। লোকসভা ভোটের পর বিজেপির রাজ্য নেতাদের আগলহীন কথাবার্তাও টেনশন বাড়িয়ে তোলে। গো-মাংস নিয়ে নিষেধাজ্ঞার বাড়াবাড়ি সন্দেহের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামের মানুষের মধ্যে মাখো মাখো যে ব্যাপারটা বছর কয়েক আগেও ছিল, দাঙ্গার বীভৎসতা তা চেঁছে তুলে নিয়েছে। কথায় বলে, সব সংকটের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সম্ভাবনার বীজ। মুজাফ্ফরনগরের এই দাঙ্গার মধ্যে রাজনৈতিক লাভের সম্ভাবনাপূর্ণ বীজের সন্ধান পেয়েছেন মায়াবতী। পশ্চিম-উত্তর প্রদেশে তাই তিনি চরকি-ঘোরা ঘুরছেন। মুজাফ্ফরনগরের চরখাওল, পুরকাজি, মীরাপুর ও বুড়ানা কেন্দ্র বহেনজি মায়াবতীর দল বিএসপির দখলে। সদর ও খাতৌলির দখল যথাক্রমে বিজেপি ও রাষ্ট্রীয় লোকদলের। সহজেই বোঝা যায়, এই তল্লাটে ২০১২ সালে মায়াবতীর দখল কেমন ছিল। সেই প্রভাব অবশ্যই ছারখার হয়ে যায় ২০১৪ সালের মোদি নামক সুনামিতে। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, মোদি-মাহাত্ম্য এবারও সবাইকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেবে। কেন তা পারবে না, মুজাফ্ফরনগর সদরে তাঁর ট্রান্সপোর্টের অফিসে বসে সেই ব্যাখ্যাটা দিলেন কাশিম রাজা জায়দি। তাঁর কথায়, ‘তিনটি কারণ। প্রথম কারণ, রাজ্যবাসী জানে না, বিজেপি জিতলে মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন। বাকি দলগুলোর ক্ষেত্রে যেমন সবার জানা। দ্বিতীয় কারণ, তিন বছর আগে সারা দেশের কাছেই নরেন্দ্র মোদি ছিলেন এক অচেনা-অজানা চরিত্র। তিনি কী রকম, কতটা তাঁর করার ক্ষমতা, কী পারেন কী পারেন না, আজ তা সবাই জেনে গেছে। সেই জৌলুশটা আজকের মোদির কিন্তু নেই। তৃতীয় কারণ, বাবা মুলায়ম, কাকা শিবপাল, পিতৃবন্ধু আজম খান ও অমর সিংয়ের প্রভাব থেকে নিজেকে এক ঝটকায় মুক্ত করে অখিলেশ এই ক মাসে তাঁর ভাবমূর্তি অন্যভাবে গড়ে তুলেছেন। এই চাপ ও ভারমুক্ত অখিলেশ এই মুহূর্তে “আননোন কমোডিটি”। রাহুলকে পাশে নিয়ে তিনি একটা নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। বিজেপি ও মোদির কাছে সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’ তাহলে অখিলেশ তো শুধু বিজেপি নয়, মায়াবতীর কাছেও বড় চ্যালেঞ্জ? উত্তরটা দিলেন বিএসপির স্থানীয় বিধায়ক নূর সেলিম রানার নিকটাত্মীয় নাদিম রানা।
‘অবশ্যই। চ্যালেঞ্জটা কী মারাত্মক জানেন? আমরা মনে-প্রাণে মায়াবতীর সমর্থক। আমার ঘরের লোক বিএসপির বিধায়ক। অনেক ভালো কাজও করেছেন নূর সেলিম রানা। কিন্তু আমরাই এবার অখিলেশকে চাইছি। চাইছি রাজ্যটাকে সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচাতে। মুসলমান ভোটে ভাগাভাগি হলে বিজেপি দাপিয়ে জিতবে।’ গলা নামিয়ে নাদিম বললেন, ‘দিল্লিতে মোদি ও রাজ্যে বিজেপি এলে পাড়ায় পাড়ায় একেকটা কাওয়াল সৃষ্টি হবে। জমি এতটাই তেতে আছে।’ কী আশ্চর্য, মায়াবতীর গলায়ও একই সুর। এখান থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে কায়রানা। সেখানে মুসলমানপ্রধান এলাকা থেকে কয়েক শ হিন্দু পরিবার আজ বছর দুয়েক ঘরছাড়া। ঘরছাড়াদের ফেরাতে সরকার উদ্যোগহীন, ঘরছাড়াদের মধ্যেও ফেরায় প্রবল অনীহা। বিজেপি এই গৃহহীনদের সঙ্গে কাশ্মীরের হিন্দুদের তুলনা টেনে আসর গরম করছে। মায়াবতীও হাতিয়ার করেছেন সরকারি নিষ্ক্রিয়তাকে। সবার সঙ্গে তুলনা টেনে বলছেন, ‘২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী ছিলাম। রাজ্যে একটাও দাঙ্গা হতে দিইনি। অখিলেশের পাঁচ বছরে ছোট-বড় পাঁচ শ দাঙ্গা হয়েছে। বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় এলে সংখ্যাটা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আমিই তাই সেরা বিকল্প।’ বলছেন বটে, তবে অখিলেশের তুলনায় সেই ভরসা আদায় করতে পারছেন না। কাশিম রাজা জায়দি এরও ব্যাখ্যা দিলেন এইভাবে, ‘অখিলেশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এই পাঁচ বছরে ওঠেনি। তা ছাড়া তিনি কখনো বিজেপির দিকে পা বাড়াবেন না। বহেনজি মায়াবতী সম্পর্কে এ দুই বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না। দুই ক্ষেত্রেই ওর ট্র্যাক রেকর্ড সবার জানা।’

No comments

Powered by Blogger.