লোকরঞ্জনবাদের বিরুদ্ধে নারীদের গোলা

আজকের ডানপন্থী লোকরঞ্জনবাদীদের সঙ্গে একশ্রেণির মানুষের সংঘাত বাড়ছে, প্রতিপক্ষ হিসেবে যারা বেশ শক্তিশালী: নারী। ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিতই ছিল। পোল্যান্ডের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও নারী অধিকার লোকরঞ্জনবাদীদের প্রথম লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। তবে নারীরা বিনা বাক্যে সব মেনে নিচ্ছেন না। কথা হচ্ছে, পশ্চিমের প্রথাগত রক্ষণশীেরা নারীকে বৃহত্তর অর্থে পুনরুৎপাদনের স্বাধীনতা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আজকের এই ডানপন্থী রক্ষণশীলদের দেখা যাচ্ছে, তাঁরা এর বিপরীত, এই ব্যাপারে তাঁদের অবস্থান প্রাক্-আধুনিক। তাঁরা এমন এক সংস্কারের চাকা ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন, যা শুধু বামপন্থীদের হাতে পরিণতি পায়নি, প্রথাগত ডানপন্থীরাও যেটা মেনে নিয়েছিলেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রাথমিকভাবে যে কাজগুলো করছেন, তার মধ্যে দীর্ঘদিনের চর্চিত আদর্শকে প্রত্যাখ্যান করার আগ্রহ দেখা গেছে, যার মধ্যে পররাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক নীতিও রয়েছে। কিন্তু নারীর অধিকারের ওপরই সবচেয়ে শক্তিশালী আঘাত আসছে। ওদিকে ইয়ারোস্লাভ কাসিনস্কি পদে না থাকলেও তিনিই কার্যত পোল্যান্ডের নেতা। ২০১৫ সালে তাঁর দল ক্ষমতায় এলে তিনি সরে দাঁড়ান। গত অক্টোবরে যখন বিভিন্ন বয়সের হাজার হাজার নারী ‘ব্ল্যাক প্রোটেস্ট’-এ রাস্তায় নেমে আসে, তখন দেশটির সরকার গর্ভপাতের ওপর পূর্ণাঙ্গ নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় (বিদ্যমান আইন অনুযায়ী দেশটিতে ধর্ষণ, ভ্রূণের মারাত্মক সমস্যা ও মায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলে গর্ভপাত করা যায়)। একইভাবে, ট্রাম্পের যত বিরোধী শক্তি ক্রিয়াশীল আছে, তার মধ্যে নারীরাই শুধু দ্রুততা ও দক্ষতার সঙ্গে সংগঠিত হতে পেরেছেন। গত মাসে ওয়াশিংটনের বিপুলসংখ্যক নারী একত্র হয়েছিলেন, যাঁদের জমায়েত ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানের জমায়েতের চেয়ে তিন গুণ বেশি ছিল। অন্য কথায়, ট্রাম্প মেয়াদ শুরু করেন মার্কিন নারীদের হাতে প্রতীকী পরাজয়ের মধ্য দিয়ে।
এর পরিণতিতে ট্রাম্প ‘গ্লোবাল গ্যাগ রুল’ পুনর্বহাল করেও এই পরাজয়কে আড়াল করতে পারেননি। এমনকি তিনি প্ল্যানড প্যারেন্টহুড কর্মসূচি থেকে সরকারি অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নেওয়ার মধ্য দিয়েও এই পরাজয় আড়াল করতে পারেননি। বরং দেখা গেল, নারীরা টুইটারে ‘ড্রেসলাইকএউইম্যান’ হ্যাশট্যাগ চালু করে এবং ট্রাম্পের নারী কর্মী নিয়োগের যৌন বৈষম্যবাদী দাবিতে আলো ফেলে প্রতিবাদ চালিয়েই যাচ্ছেন। নারীরা লোকরঞ্জনবাদী শাসকের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালেও মূলধারার রাজনৈতিক দল ও নেতারা বাস্তবিক অর্থে পিছিয়ে গেছেন। ফলে তাঁরা যে সমর্থন হারাচ্ছেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু নারীরা একদম একা নন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনকারীরাও এগিয়ে এসেছেন। এমনকি গণমাধ্যমও এই লক্ষ্যকে সহায়তা করছে, যদিও তারা এ রকম খোলাখুলিভাবে রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে অভ্যস্ত নয়। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে অর্থাৎ গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের যুদ্ধ ঘোষণার কারণে তারা এই ভূমিকায় আসতে বাধ্য হচ্ছে। বিরোধিতাকারীদের মধ্যে যাঁরা আছেন, তাঁদের এই পথে থাকাটা বেশ যুক্তিগ্রাহ্য। অন্তর্গতভাবে, ডানপন্থী লোকরঞ্জনবাদ উদারনীতিবাদের ওপর আক্রমণ, তা ঠিক অবশ্যম্ভাবীরূপে গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ নয়। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, মুক্ত গণমাধ্যম, স্বাধীন বিচার বিভাগ, মুক্ত বাণিজ্য—এসব উদারনৈতিক আদর্শ, গণতান্ত্রিক নয়। যাঁরা ট্রাম্পের বিরোধিতা করছেন, তাঁদের মধ্যে নারীদের স্থান সর্বাগ্রে। কারণ, তাঁদের অবস্থান বিভিন্ন দিক থেকেই ডানপন্থী লোকরঞ্জনবাদের একদম বিপরীত। মূলত স্বল্পশিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ পুরুষেরা এই ডানপন্থী লোকরঞ্জনবাদের সমর্থক, যাঁদের নারীবাদ-বিষয়ক উপলব্ধির স্তর সবচেয়ে নিচে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নারীরা কি লোকরঞ্জনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা জিততে পারবেন কি না। এই প্রশ্নের জবাবটা পরিষ্কার না হলেও তাঁদের তূণে শক্তিশালী অস্ত্র আছে। শুরুতেই বলে রাখি, যেকোনো সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে নারীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ; কালো, লাতিনো, বামপন্থী, ডানপন্থী, উদার, রক্ষণশীল, ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র ও পোল্যান্ডে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের চেয়ে নারীদের সংখ্যা বেশি। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই লোকরঞ্জনবাদীদের চেয়ে নারীদের সংখ্যা অনেক বেশি (সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য এমনভাবে লড়াই করতে হয় যে মনে হয়, তাঁরা সংখ্যালঘু। তাঁদের মানবীয় পুঁজি কম মনে হলেও পশ্চিমে তাঁরাই পুরুষদের চেয়ে বেশি শিক্ষিত)। তা ছাড়া নারীরা সর্বত্র বিচরণশীল, আর তাঁদের সবাই কমবেশি বৈষম্যের শিকার। এতে মার্ক্সবাদী চিন্তায় নারীরা বিপ্লবী শ্রেণিভুক্ত হয়ে যান। ফলে নারীদের পক্ষে সংহতি অর্জন করা আপেক্ষিকভাবে সহজ। পোল্যান্ডের ব্ল্যাক প্রোটেস্টের সময় বার্লিন থেকে শুরু করে কেনিয়া পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ সংহতি জানিয়ে প্রতিবাদ করেছে। আর নারীদের ওয়াশিংটন মার্চের সময় সারা পৃথিবীতে লাখ বিশেক মানুষ সংহতি জানিয়ে মিছিল করেছে। পরিষ্কারভাবে, নারীরা এখন বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ফলে ট্রাম্প ও কাসিনস্কির মতো মানুষেরা যখন বিশ্ববাদের ওপর আক্রমণ করেন, তখন নারীদের চেয়ে ভালো প্রতিবাদকারী আর কে-বা হতে পারে? সম্ভবত, নারীদের তূণে সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্রটি হচ্ছে এই যে, তাঁরা লজ্জিত নন। বিশ শতকের বৈশিষ্ট্য ছিল ভীতির মাধ্যমে শৃঙ্খলা আরোপ, যেখানে একুশ শতকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,
লজ্জা দেওয়ার মাধ্যমে নিপীড়ন। তবে লজ্জা ভীতির মতো নয়, এটা লুকানো যায়, আর সেটাই হচ্ছে কথা। বিষয়টা হচ্ছে, মানুষ আত্মমর্যাদা না হারিয়েও ভীত হতে পারে, যেখানে লজ্জা আসে হীনম্মন্যতা বোধ থেকে। এই লোকরঞ্জনবাদবিরোধী আন্দোলনে নারীরা লজ্জা পরিত্যাগ করেছেন। গর্ভপাত নারীর অধিকার—এটার পক্ষাবলম্বন করার মানে হলো, নারীর মর্যাদা ও স্বকীয়তার পক্ষাবলম্বন করা। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো ট্রেড ইউনিয়নের মতো অন্যান্য প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের মতো এখনো লজ্জা পায়। তাদের বিবেকের দংশন আছে, অন্যরা তাদের কীভাবে নিচ্ছে সে ব্যাপারে তাদের উদ্বেগ আছে। সে কারণে সবচেয়ে নির্লজ্জ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে যায়, অর্থাৎ লোকরঞ্জনবাদীদের বিরুদ্ধে। কাসিনস্কি ও ট্রাম্পের মতো মানুষের লজ্জার অভাব আছে, যার কারণে তাঁরা ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছেন। অর্থাৎ রাজনৈতিক সমর্থন পাওয়ার জন্য তাঁরা যখন যা খুশি তা-ই বলেছেন ও করেছেন। কিন্তু নারীদের ব্যাপারটা সে রকম নয়। যে লজ্জা দিয়ে তাঁদের এতকাল নিপীড়ন করা হতো, তাঁরা সেই লজ্জার জোয়াল ছুড়ে ফেলেছেন। তাঁরা আগুনের গোলার বিরুদ্ধে আগুনের গোলাই ছুড়ছেন। এখন কথা হচ্ছে, লোকরঞ্জনবাদীরা কি এই উত্তাপ সহ্য করতে পারবেন?
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
স্লাভোমির সিয়েরাকভস্কি: ওয়ারসর ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির পরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.