মার্গারিতা এ দেশে বেড়ে উঠলে কী ঘটত?

‘পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল রাষ্ট্র বাংলাদেশ কেন অলিম্পিক গেমসে কখনও কোনো পদক পায়নি’ (Why the world's eighth most populous country never has won an Olympic medal)- সম্প্রতি এই শিরোনামে ইয়াহু নিউজ ফিডে একটি প্রতিবেদন দেখে মনটা গ্লানিতে ভরে গিয়েছিল। সেই গ্লানি কিছুটা কেটে গেল রিও অলিম্পিকে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত রুশ জিমন্যাস্ট মার্গারিতা মামুনের সাফল্যের খবরে। বাংলাদেশী বাবা ও রুশ মায়ের ঘরে জন্ম নেয়া মার্গারিতা দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে রিদমিক জিমন্যাস্টিক্সের ইনডিভিজুয়াল অল-আরাউন্ড ইভেন্টে রাশিয়ার হয়ে স্বর্ণপদক জয় করেছেন। বলা হচ্ছে, এই ইভেন্টে তিনি এ মুহূর্তে বিশ্বের সেরা জিমন্যাস্ট। তার ডাকনাম নাকি বাংলার বাঘ (বেঙ্গল টাইগার)! তার কোচ এ নাম দিয়েছেন। যথার্থ নামই বটে! এর মধ্য দিয়ে তার ‘বাঙালি’ পরিচয়টিও যেন প্রকাশ পাচ্ছে। মার্গারিতা দেখিয়ে দিলেন ধমনীতে বাঙালির রক্ত নিয়েও অলিম্পিকে সেরা হওয়া যায়। কেন এভাবে বলছি? রিও অলিম্পিকে বাংলাদেশের সাত ক্রীড়াবিদ অংশ নিয়েছিলেন। কেউ কোনো পদক পাননি। অলিম্পিকে বাংলাদেশ অংশ নিয়ে আসছে সেই ১৯৮৪ সাল থেকে। পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রথম অলিম্পিক গেমসে অংশ নেয়ার ৩২ বছর পরও কোনো অলিম্পিকে একটিও পদক জয় করতে পারেনি, এমনকি একজন উপযুক্ত প্রতিযোগীও তৈরি করতে পারেনি।
আজ পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশী খেলোয়াড় উইন্টার অলিম্পিক গেমসে অংশ নেয়নি। ৪৩তম গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে দেশটির কোনো প্রতিযোগী কোনো ইভেন্টে ২১তম স্থানের চেয়ে ভালো কিছু করতে পারেনি। এসব কথা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে ইয়াহু। ‘জয় নয়, অংশ নেয়াই বড় কথা’- এ সান্ত্বনা নিয়েই আমরা আছি। কিন্তু আমরা কি খতিয়ে দেখেছি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আমাদের অবস্থান কোথায়? ইয়াহু নিউজে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া দুটি মাত্র দেশ অলিম্পিকে আজ পর্যন্ত কোনো পদক পায়নি। এ দুটি দেশ হল রিপাবলিক অব কঙ্গো (জনসংখ্যায় ১৮তম) ও মিয়ানমার (২৬তম)। তবে অলিম্পিকে সাফল্য লাভের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা যথার্থ মাপকাঠি হতে পারে না। যদি তাই হতো তাহলে ১৩৩ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ভারত (যারা অল্প কিছুদিন পর চীনের জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে এ ক্ষেত্রে প্রথম হতে যাচ্ছে) মাত্র দুটি পদক (রিওতে একটি রৌপ্য, একটি ব্রোঞ্জ) পায় কেন? বস্তুত অলিম্পিকে এ উপমহাদেশের সব দেশের অবস্থানই কমবেশি সমান- সাফল্যের বিচারে। একসময় অলিম্পিকের হকির স্বর্ণপদকটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। সেটিও এখন পশ্চিমাদের দখলে চলে গেছে।
কেন আমাদের এ অবস্থা, ওই ইয়াহু নিউজেই তার জবাব মেলে। বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে প্রথম লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে অংশ নেয়। ওই গেমসে বাংলাদেশের তখনকার দ্রুততম মানব সাইদুর রহমান ডন ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে অংশ নিয়ে প্রাথমিক হিটেই বাদ পড়ে গিয়েছিলেন। দেশে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, সুযোগ-সুবিধা ও ক্রীড়া সামগ্রীর অভাবে ডন ঠিকমতো প্রস্তুতি নিতে পারেননি। নিজেকে উন্নীত করতে পারেননি আন্তর্জাতিক মানে। সে সময় ডনের বয়স ছিল ২১। অথচ ১৬ বছর পর্যন্ত তার নিজের কোনো ট্রাক স্পাইক (দৌড়ানোর জুতা) ছিল না। ১৭ বছর পর্যন্ত কোনো কোচিং পাননি। এমনকি ১৯ বছর পর্যন্ত তিনি কোনো সিনথেটিক ট্র্যাকে দৌড়ানোর সুযোগ পাননি। কলেজছাত্র থাকাকালে তিনি দৌড়াতেন তার বাড়ির কাছে ঘাসের মাঠে। ১০০ ও ২০০ মিটার দূরত্ব মাপতেন হাত দিয়ে। বন্ধুরা সাধারণ হাতঘড়ি দেখে তার দৌড়ের সময় পরিমাপ করত। ডন বলেছেন, ‘কেউ আমাকে দৌড়াতে শেখায়নি। মূলত অন্যদের দৌড় দেখে দেখে শিখেছি। অন্যান্য অ্যাথলেটের ওপর লেখা বই পড়ার চেষ্টা করেছি- তারা কী করত বা কী খেত। কিন্তু এটা কঠিন ছিল।’ মার্গারিতার বাবা বাংলাদেশী, কিন্তু তিনি থাকেন রাশিয়ায়। জন্ম ও বেড়ে ওঠা মস্কোয়। খেলার পরিবেশ, প্রশিক্ষণ,
সুযোগ-সুবিধার অভাব নেই সেখানে। রাশিয়া হল বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রীড়াক্ষেত্র। অলিম্পিকে বহুবার তারা (সোভিয়েত ইউনিয়ন/ রাশিয়া) পদক তালিকার শীর্ষে অবস্থান করেছে। রিও অলিম্পিকে ডোপিংয়ের অভিযোগ এনে দেশটির বেশিরভাগ ক্রীড়াবিদকে ঢালাওভাবে নিষিদ্ধ করা না হলে এবারও হয়তো তারা শীর্ষে থাকত। মার্গারিতা যদি বাংলাদেশে বেড়ে উঠতেন, তাহলে যে এ পর্যায়ে আসতে পারতেন না এটা প্রায় নিশ্চিত। অনেকে যুক্তি দেখান, এ উপমহাদেশের মানুষ শারীরিক গঠনের দিক থেকে ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে খর্বকায় হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তারা ওদের সঙ্গে পেরে ওঠে না। কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। আফগানরা তো সুঠামদেহী, তারা কেন রিওতে কোনো পদক পায়নি? চীন, জাপান বা কোরিয়ার কথা না হয় বাদ দিলাম (অর্থনৈতিক অগ্রগতি তাদের সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা দিয়েছে), থাইল্যান্ড (এবার দুটি স্বর্ণসহ ছয়টি পদক) বা ভিয়েতনামের (একটি স্বর্ণসহ দুটি পদক) মানুষের শারীরিক গঠন কি আমাদের চেয়ে উন্নত? আসল কথা হল ভিশনের অভাব। ওইসব দেশে শৈশব থেকেই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় বিজড়িত করা হয়।
কার মধ্যে কী প্রতিভা আছে তা শৈশবেই শনাক্ত হয়ে যায় এবং সেই অনুযায়ী রাষ্ট্র ও পরিবার তার পরিচর্যা করে। কিন্তু আমাদের মতো দেশগুলোয় প্রতিভা থাকলেও পরিবেশ ও আর্থিক সামর্থ্যরে অভাবে সেটা আর বিকশিত হতে পারে না। অলিম্পিকে সাফল্য পেতে চাইলে দেশের ক্রীড়া কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়টি আগে অনুধাবন করতে হবে। যেসব অভিভাবক খেলাধুলায় সাফল্য অর্জনের মধ্যে তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ দেখতে চান, তাদের জন্য ক্রীড়া শিক্ষা প্রশিক্ষণ (বিকেএসপি) ধরনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে শৈশব থেকেই শিশুদের ‘খেলোয়াড়’ হিসেবে তৈরি করতে হবে। এখন আমরা ক্রিকেটের ওপর যেমন জোর দিয়েছি, তেমনি অন্যান্য খেলার ক্ষেত্রেও গুরুত্ব দিলে একদিন আমাদের সন্তানরাও অলিম্পিক গেমস থেকে মেডেল জয় করে ফিরবে। বাংলাদেশের মানুষকে গৌরবের অনুভূতি দেয়ার জন্য আপাতত মার্গারিতাকে জানাই অভিনন্দন।
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
arbangladesh@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.