টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য করণীয়

আবহমানকাল থেকে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য বলতে আমরা ধানকেই বুঝে থাকি। ধানকে এ দেশের জাতীয় সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইরির মাসিক মুখপত্র রাইস টুডে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা বলতে মূলত ধান বা চালের নিরাপত্তাকেই বোঝায়। ধান উৎপাদনে বর্তমান স্বয়ংসম্পূর্ণতা বা উদ্বৃত্ত উৎপাদন একদিনে অর্জিত হয়নি। এর পেছনে রয়েছে সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, ধান বিজ্ঞানীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং কৃষকের নিরলস পরিশ্রম। প্রশ্ন হচ্ছে, এ স্বয়ংসম্পূর্ণতা টেকসই হবে কিনা? কারণ টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের বড় চ্যালেঞ্জ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, ক্রমহ্রাসমান সম্পদ (কৃষিজমি, শ্রমিক, পানি ইত্যাদি) এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত (বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি)। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ। সম্প্রতি ব্রিতে অনুষ্ঠিত ২৩তম ধান গবেষণা ও সম্প্রসারণ কর্মশালায় Rice Vision for Bangladesh: 2050 and Beyond শীর্ষক মূল প্রবন্ধে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নানা সুপারিশ উঠে আসে। এর মধ্যে রয়েছে আগামী দিনের চালের সঠিক মাথাপিছু চাহিদা নিরূপণ, সীমিত সম্পদের যৌক্তিক ব্যবহার এবং খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত যুগোপযোগী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের দিকনির্দেশনা।
বৈশ্বিক হিসেবে, বিশ্বের ১৬ কোটি হেক্টর ধানি জমিতে ৪৭ কোটি টন চাল উৎপন্ন হয়। ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের যে জনসংখ্যা হবে তার চাহিদা পূরণে প্রয়োজন হবে আরও ২৫ ভাগ বাড়তি উৎপাদন। ইউএনপিডির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২.৮৫ ভাগ এবং ২০১৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.২২ ভাগে। এ হিসাবে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ২১ কোটি ৫৪ লাখ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অর্থাৎ ২০৭১ সালে ২৪ কোটি ২৮ লাখে। অর্থাৎ ২৫ কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা নিশ্চিত করার চিন্তা মাথায় রেখে বিজ্ঞানীদের পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে মাথাপিছু চালের চাহিদা বছরে জনপ্রতি ১৪৮ কেজি, যা খাদ্যের বহুমুখিতা ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের দরুন প্রতি বছর ০.৭ ভাগ হারে কমছে। সে হিসাবে ২০৪০ সাল নাগাদ মাথাপিছু চালের চাহিদা কমে জনপ্রতি প্রান্তিক সীমা ১৩৩ কেজিতে দাঁড়াবে। এজন্য ২০৫০ সাল নাগাদ জনসংখ্যা বাড়লেও খাদ্যের চাহিদা তুলনামূলকভাবে কমবে। সার ও তেলের দাম কমানো, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ সুবিধা বৃদ্ধি, কৃষিতে প্রণোদনা প্রদান, সার বিতরণ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, উন্নত মানের ধানের বীজ সরবরাহ, বিভিন্ন ঘাত সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন- এসব পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বিগত বছরগুলোয় চালের উৎপাদন ৩.৪ লাখ টন হারে বেড়েছে। বর্তমানে চালের উৎপাদন ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন।
গতিশীলতার এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে চালের উৎপাদন হবে ৪ কোটি ৭২ লাখ টন। বিপরীতে ২০৫০ সালে ২১ কোটি ৫৪ লাখ লোকের খাদ্য চাহিদা পূরণে চাল প্রয়োজন হবে ৪ কোটি ৪৬ লাখ টন। এটাই আপাতত টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের অভীষ্ট লক্ষ্য, যা সামনে রেখে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজ করছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমি। এটি মোকাবেলায় প্রয়োজন আধুনিক ধানের জাতগুলোর কৌলিতাত্ত্বিক বা জেনেটিক গেইন ত্বরান্বিতকরণ। দেশে প্রতি বছর ধানি জমি কমছে ০.৪ ভাগ হারে; ফলে চাষের জমি সম্প্রসারণের সুযোগ নেই। উৎপাদন বাড়াতে হবে উলম্বভাবে। বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে আধুনিক জাতগুলোর গড় ফলন ৩.১৭ টন/হেক্টর। অত্যাধুনিক ব্রিডিং কৌশল অবলম্বন ও মাঠ পর্যায়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে গড় ফলন ৪.৮২ টন/হেক্টর পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। এতে প্রতি বছর জেনেটিক গেইন হবে ০.৪৪ টন/হেক্টর। বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণে উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি প্রয়োজন গবেষণা মাঠ ও কৃষক পর্যায়ে ফলনের পার্থক্য কমানো। বাংলাদেশে ধানের প্রকৃত ফলন ও সম্ভাব্য ফলনের পার্থক্য ০.৮৩ টন/হেক্টর। উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ পার্থক্য প্রতি বছর ১.১৩৫ ভাগ হারে হ্রাস করতে পারলে ২০৫০ সালে ৪৮ লাখ টন উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সীমিত ও ক্রমহ্রাসমান সম্পদের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। বর্তমান ০.৪ ভাগ হারে ধানি জমি কমলেও আমাদের মোট ধানি জমি ৬.২৯ মিলিয়ন হেক্টর নিশ্চিত করা গেলেই মোট চালের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ২.০-২.৪ ভাগ পর্যন্ত বাড়াতে হবে। ধান ২০ সেমি. নাড়া/খড় রেখে কর্তনের পর তা চাষ দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিলেই জমির জৈব পদার্থের পরিমাণ ২.৪ ভাগ উন্নীত করা সম্ভব। আরেকটি উপায় হচ্ছে, ধানভিত্তিক শস্যবিন্যাসে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি, নতুন নতুন স্বল্পমেয়াদি জাত চাষের মাধ্যমে একই জমি থেকে বছরে অধিক পরিমাণে আয় করা। গবেষকরা বলছেন, শস্য চাষের নিবিড়তা ২০৫০ সাল নাগাদ ২২১ ভাগের বেশি বাড়ানো সম্ভব হবে না। তৃতীয়ত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ধান চাষে সেচ বা পানি সরবরাহের নিশ্চয়তা। ধান একটি পানি পছন্দকারী ফসল। আউশ ও আমন বৃষ্টিনির্ভর হলেও বোরো মৌসুমে ধানের জমি সেচের কাজে ব্যবহৃত হয় ভূগর্ভস্থ পানি, যা ভবিষ্যৎ আশংকার কারণ। কারণ অনবরত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ও ব্যবহারের কারণে ভবিষ্যতে সুপেয় পানির অভাব দেখা দিতে পারে। এজন্য বৃষ্টিনির্ভর আউশ ও আমনের আবাদ বাড়াতে হবে। কৃষিতে অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে হলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদেরও ধান চাষে আধুনিক জাত এবং প্রযুক্তির বিস্তার ও ব্যবহার বাড়াতে হবে। সেকেলে প্রযুক্তি আর প্রচলিত ধানের জাত দিয়ে এটা কখনোই সম্ভব নয়।
যেমন- স্বল্পকালীন রোপা আমনে প্রচলিত জাত ব্রি ধান৩৩ এবং ব্রি ধান৩৯ এর পরিবর্তে আধুনিক জাত ব্রি ধান ৬২, ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭১ ও ব্রি ধান৭২ এবং ব্রি হাইব্রিড ধান৪ চাষ করতে হবে। মধ্যমেয়াদি আমনে আগের জনপ্রিয় জাত বিআর১১, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮-এর পরিবর্তে ব্রি ধান৪৯ ও ব্রি ধান৭০-এর চাষ করা যেতে পারে। উত্তরের জেলাগুলোতে যেখানে বৃষ্টিনির্ভর স্বর্ণা জাতের প্রচলন রয়েছে সেখানে ব্রি উদ্ভাবিত আধুনিক আমন জাতসমূহ যেমন- ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭০, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭২ জাতগুলো প্রবর্তন করা গেলে ফলনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। আবার বোরো মৌসুমে মেগা জাত (সর্বাধিক জনপ্রিয়) হিসেবে খ্যাত ব্রির জনপ্রিয় জাত ব্রি ধান২৮, ও ব্রি ধান২৯-এর চেয়েও অনেক ভালো জাত বর্তমানে রয়েছে, যার মধ্যে ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৫৮ ব্রি ধান৬০, ব্রি ধান৬৩, ব্রি ধান৭৪ এবং ব্রি হাইব্রিড ধান৩ উল্লেখযোগ্য। লবণাক্ততাপ্রবণ এলাকার জন্য ব্রি ধান৪৭ এর আধুনিক সংস্করণ ব্রি ধান৬৭। আউশে পারিজা, জামাইবাবু ও বিআর২৬-এর পরিবর্তে যথাক্রমে ব্রি ধান৪৮, ব্রি ধান৬৫ এবং নেরিকা মিউটেন্ট প্রবর্তন করে অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব।
কৃষিবিদ এম আবদুল মোমিন : ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি, গাজীপুর
smmomin80@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.