৯৯ শতাংশ পুরুষতান্ত্রিক নির্বাচন! by সোহরাব হাসান

জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ, রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি বাংলাদেশের নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই অসাধারণ সাফল্য দেখাচ্ছেন। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে রয়েছে তাঁদের উল্লেখযোগ্য পদচারণ। বাংলাদেশের নারীরা এখন যুদ্ধবিমান চালাচ্ছেন, ট্রেন চালাচ্ছেন। তাঁরা বিদেশে শান্তিরক্ষা বাহিনীতে কাজ করছেন। কিন্তু এসব অগ্রগতি-উন্নতি সত্ত্বেও রাজনীতিতে চলছে উল্টোযাত্রা। সেখানে নারী ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছেন। বিষয়টি আরও উদ্বেগজনক এ কারণে যে আড়াই দশক ধরে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে নারী, বিরোধী দলের নেত্রী পদে নারী অধিষ্ঠিত। সংসদের স্পিকার এবং দুটি প্রধান দলের প্রধানও নারী। তারপরও রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নের এই অবনমন! বিষয়টি গভীরভাবে ভাবা উচিত। সারা দেশে এখন মহা শোরগোল তুলে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হচ্ছে। মাত্র দুই পর্ব শেষ হয়েছে। আরেক পর্বের ভোট হবে আজ। সামনে আরও তিনটি পর্ব বাকি থাকবে। কয়েক মাস আগে পৌরসভা নির্বাচন হলো। তারও আগে উপজেলা ও সিটি করপোরেশন। এসব নির্বাচন কতটা নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতমূলক  হয়েছে বা হচ্ছে, সে বিতর্কে না গিয়েও বলব, এটি ৯৯ শতাংশ পুরুষতান্ত্রিক নির্বাচন। পরিসংখ্যান তা-ই বলে। তবে এই হিসাবে নারীর জন্য যে এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত সদস্য পদ রাখা হয়েছে, সেটি ধরা হয়নি। গত বুধবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে ইউপি নির্বাচনের একটি পর্যবেক্ষণমূলক প্রতিবেদন। এতে দেখা যায়, প্রথম দুই ধাপের নির্বাচনে ১ হাজার ২৫১টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৭২ জন নারী প্রার্থী ছিলেন। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মাত্র ১২ জন ও বিএনপির ৬ জন। আর জিতেছেন ১২ জন। এই সংখ্যাটা নারী প্রতিনিধিত্বের ১ শতাংশেরও কম। নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী, এবার ৬ ধাপে মোট ৪ হাজার ২৭৯টি ইউপিতে নির্বাচন হবে। এর মধ্যে গত ২২ মার্চ প্রথম ধাপে ৭১২টি ইউপিতে এবং ৩১ মার্চ দ্বিতীয় ধাপে ৬৩৯টিতে ভোট নেওয়া হয়। দুই ধাপে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৯৮৪টিতে ও বিএনপি ১০৮টিতে জয় পেয়েছে। আরও কৌতূহলের বিষয় হলো, চেয়ারম্যান পদে প্রথম ধাপের তুলনায় দ্বিতীয় ধাপে এসে নারী প্রার্থীর সংখ্যা অনেক কম। প্রথম ধাপে ৬৪৮টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে নারী প্রার্থী ছিলেন ৬২ জন। দ্বিতীয় ধাপে ৬০৩টি ইউপিতে ছিলেন মাত্র ১০ জন। তাঁদের মধ্যে প্রথম ধাপে ৮ জন এবং দ্বিতীয় ধাপে ৪ জন জয়ী হয়েছেন। এই পরিসংখ্যান অবশ্যই নারীদের জন্য সংরক্ষিত এক-তৃতীয়াংশ সদস্য পদের বাইরে। নারী-পুরুষের সমতা মানে সংরক্ষণ নয়। সমানে সমানে লড়াই, প্রতিযোগিতা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালের ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নারী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ১০২ জন। জিতেছিলেন ২৩ জন। ২০০৩ সালে ২৩২ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতেছিলেন ২২ জন। ২০১১ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন ২২৬ জন। জয়ী হন ২৩ জন। নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত ২০১০-১১ সালের পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪ জন ও বিএনপি ১২ জন নারী প্রার্থীকে সমর্থন দিলেও ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে অনেক কমে যায় সে সংখ্যা। দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সাতজন এবং বিএনপি মাত্র একজন নারীকে মনোনয়ন দেয়। অপর এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ১ হাজার ৫০৭ জন নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ২০০৯ সালে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন ২ হাজার ৯০০ জন। তৃতীয় উপজেলা নির্বাচনে গড়ে প্রতি উপজেলায় তিনটি পদে (চেয়ারম্যান, সাধারণ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান) সাত থেকে নয়জন করে নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে এই গড় তিন-চারজন কমে এসেছে। ২০১৫ সালের উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে অংশগ্রহণ খুবই কম ছিল। তবে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ আওয়ামী লীগ, ৩৩ শতাংশ বিএনপি এবং ১১ শতাংশ নারী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এসডিসির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাঁচ বছরের ব্যবধানে উপজেলা নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ ৪৮ শতাংশ কমেছে। ২০০৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী নারী প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯০০ জন। আর ২০১৪ সালের ৪৫৮টি উপজেলা নির্বাচনে তা কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫০৭ জনে। এই হিসাবে ২০০৯ সালে প্রতি উপজেলায় ৭ থেকে ৯ জন প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১৪ সালে এই হার গড়ে দাঁড়ায় ৩ থেকে ৪ জনে। অথচ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০বি ধারায় বলা আছে, ২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব স্তরে ৩৩ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। আর আওয়ামী লীগ দশমিক ৯৫ শতাংশ এবং বিএনপি দশমিক ৫৭ শতাংশ ইউপিতে নারীদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দিয়েছে। প্রথম দুই ধাপের ১ হাজার ২৫১টি ইউপির নির্বাচনী ফল বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নেওয়ার সময়ও রাজনৈতিক দলগুলো কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি হচ্ছে ৭৩ সদস্যবিশিষ্ট। এর মধ্যে নারী সদস্য রয়েছেন ১১ জন, যা মোট সদস্যের ১৫ শতাংশ। গণপ্রতিনিধিত্ব অাদেশের শর্ত পূরণ করতে হলে তাদের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে হবে। আর সেটি তো শুধু কেন্দ্রীয় কমিটিতে করলে হবে না। প্রতিটি পর্যায়ে করতে হবে। গত মাসে বিএনপির কাউন্সিল হলেও নতুন কমিটির পুরো নাম ঘোষণা হয়নি, তাই বলা যাচ্ছে না কমিটিতে কতজন নারী আছেন। বিগত ৩৮৬ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারী সদস্য ছিলেন ৪৭ জন, মাত্র ১২ শতাংশ। আওয়ামী লীগ অন্য সব ক্ষেত্রের মতো নারীর ক্ষমতায়নেও নিজেদের চ্যাম্পিয়ন দাবি করে। কিন্তু সরকারের ঘোষিত নীতি-পরিকল্পনায় তার ছাপ দেখতে পাই না। ১৯৯৭ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে ১৯ বছর আগে আওয়ামী লীগ সরকার একটি নারী উন্নয়ন নীতিমালা করেছিল। সেবারে তারা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তারা নারী উন্নয়ন নীতিমালা পুনর্বহালের কথা বললেও তা কার্যকর হয়নি। এ নিয়ে এখন আর কেউ উচ্চবাচ্য করছেন না। আওয়ামী লীগ সরকার  রূপকল্প-২০২১ ঘোষণা করেছে। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার কৃতিত্ব দাবি করছে। কিন্তু নারীর উন্নয়ন বা ক্ষমতায়ন নিয়ে কোনো রূপকল্প দেখি না। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ বলেছিল, জাতীয় সংসদে মহিলা সংরক্ষিত আসন ৩৩ শতাংশে উন্নীত করবে। কিন্তু করেনি। বিএনপির আমলের চেয়ে মাত্র পাঁচটি আসন বাড়িয়েছে। ওই ইশতেহারে ‘নারীর ক্ষেত্রে যেসব বৈষম্যমূলক আইন’ আছে, সেসব সংশোধনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে কিছুই করেনি।
২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিটি পর্যায়ে নারীর প্রতিনিধিত্ব এক-তৃতীয়াংশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা পূরণের কোনো লক্ষণ নেই। বরং সার্বিকভাবে দেশের রাজনীতি ও নির্বাচন যে সহিংসতা ও সংঘাতের দিকে যাচ্ছে, তাতে দল ও নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ আরও কমে যাবে। রাজনীতি সুস্থ ও সহিষ্ণু হলেই নারীরা অধিক সংখ্যায় রাজনীতিতে আসবেন। অসুস্থ রাজনীতি সেই পথটি প্রায় রুদ্ধ করে দিচ্ছে। আড়াই দশক ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ আছে। তাহলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব কী করে গড়ে উঠবে?
এবারের ইউপি নির্বাচনে নারীর প্রতিনিধিত্ব কম হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেছেন, তৃণমূল থেকে নাম আসেনি বলেই তাঁরা নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে পারেননি। নাম আসবে কীভাবে? যাঁরা নাম পাঠাবেন অর্থাৎ তৃণমূলের নেতৃত্বে তো গত দুই আড়াই দশকে কোনো পরিবর্তন আসেনি। নির্বাচনে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হলে আগে দলে প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে। এখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কথা উল্লেখ করেছি। বাম-মধ্য, ছোট–বড় সব দলেই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা প্রকট। আর ডানপন্থীরা তো কখনোই চাইবে না নারীরা রাজনীতিতে আসুক। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনও দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তারা রাজনৈতিক দলের কমিটিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব বেঁধে দিলেও কেন নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের হারটি বেঁধে দিল না? স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নির্বাচনে নারী প্রতিনিধিত্ব বা প্রতিযোগিতা কমে যাওয়া আমাদের অসুস্থ রাজনীতিরই লক্ষণ। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদে ১০ বছরের জন্য ১৫টি সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নীতিনির্ধারকেরা হয়তো ভেবেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ বা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে অচিরেই নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং আর সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন হবে না। পরবর্তীকালে সংরক্ষিত আসনসংখ্যা বাড়িয়ে প্রথমে ৩০, পরে ৪৫ এবং বর্তমানে ৫০ করা হয়েছে। নারীসমাজের দাবি ছিল সরাসরি ভোটে নির্বাচন করার। রাজনৈতিক দলগুলো সেটি না করে পরোক্ষ ভোট বা ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ চালু রেখেছে। জনগণ নয়, সাংসদেরা নারী সাংসদদের নির্বাচন করবেন। জাতীয় সংসদ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ—সব স্তরেই সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে একধরনের বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। ৩০০ আসনে নির্বাচিত সাধারণ সাংসদদের নির্ধারিত নির্বাচনী এলাকা আছে, এলাকার ভোটাররা তাঁদের কাছে দাবিদাওয়া জানাতে পারেন। তাঁরাও ভোটারদের কাছে ভোট চাইতে পারেন। কিন্তু সংরক্ষিত আসনের নারী সাংসদেরা কার প্রতিনিধিত্ব করছেন, সেটি স্পষ্ট নয়। স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর সংরক্ষিত সদস্য কিংবা ভাইস চেয়ারপারসনদের অবস্থা আরও করুণ। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন চাইলে এই বৈষম্যের অবসান হওয়া প্রয়োজন।
ইউনিয়ন পরিষদসহ সব জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে নারীর প্রতীকী ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। কিন্তু আমরা যদি রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন চাই, তাহলে সমসংখ্যক আসনে তাঁদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। এবং সেটি অবশ্যই সমতার ভিত্তিতে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.