অপরাধ দমনে পুলিশ কী ভূমিকা রাখছে? by আলী ইমাম মজুমদার

পুলিশ রাষ্ট্রের অপরিহার্য একটি অঙ্গ। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান তাদের দায়িত্বে। তাই প্রত্যাশা সংগত যে তারা দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনকে মূলনীতি হিসেবে অনুসরণ করবে। দেখার থাকে আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠানটি তাদের দায়িত্ব পালনে কতটা কার্যকর ভূমিকায় আছে। শুরুতেই বলতে হবে ১৬ কোটি লোকের ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশটির শাসনকাজ দুরূহ। এখানে প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু অপরাধ ঘটতেই পারে। আর তা ঘটছেও। অনেকে বলে থাকেন, কোনো কোনো উন্নত দেশে সংগঠিত অপরাধের চেয়ে আমাদের এখানে অপরাধের হার কম। তবে পার্থক্য হলো সেসব দেশে অপরাধীকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হয়। তদন্ত হয় যথার্থ। বিচার হয়। এর অন্যথা হওয়ার সুযোগ খুব কম। আর আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া অপরাধে তদন্ত প্রক্রিয়া শ্লথ। ক্ষেত্রবিশেষে ত্রুটিপূর্ণ। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও রয়েছে। তদন্ত ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ পায় অভিযুক্ত ব্যক্তি। আদালতের সাক্ষ্য–প্রমাণ হাজির করা খুব কঠিন কাজ। আর অপরাধ যথার্থভাবে প্রমাণ করতে না পারায় আসামি পার পেয়ে যাচ্ছে। এতে উৎসাহিত হয় অন্য অপরাধীরা।
সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া কিছু অপরাধ আমাদের বিচলিত করছে। তার মাঝে আছে বিদেশি, ভিন্ন ধর্ম বা মতাবলম্বী ব্যক্তিদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা। আছে নিষ্পাপ শিশু-কিশোরকে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে নৃশংস হত্যার ঘটনাও। সাগর-রুনি নামের এক সাংবাদিক দম্পতি নিহত হওয়ার ঘটনাটিও অনুদ্ঘাটিতই থাকল। এটা খুবই অস্বাভাবিক। হবিগঞ্জের বাহুবলে চার শিশু হত্যার তদন্ত স্বাভাবিক গতিতেই চলছিল। এর মাঝে প্রধান আসামির ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনাটি আইনের শাসনের ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। সিলেটে রাজন হত্যার আসামিদের বিচারের আওতায় আনতে মূল ভূমিকায় ছিলেন স্থানীয় জনগণ। তাঁদের ন্যায্য আবেগের ফলে তদন্ত ও বিচার দ্রুত সম্পন্ন হয়। দুঃখজনকভাবে এ ঘটনায় পুলিশের কিছু সদস্য অপরাধীদের পক্ষ নিয়েছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানা যায়। ঢাকার মতিঝিলে ঘরোয়া হোটেলের মালিক গুলি করে তাঁর হতদরিদ্র কিশোর কর্মচারীকে মেরে ফেলেন। আসামি গ্রেপ্তার বা মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা যায় না। কেউ যদি মামলাটির অপমৃত্যুর আশঙ্কা করেন, তাহলে তা অমূলক বলা যাবে না। দেশের উত্তরাঞ্চলে একজন হিন্দু ধর্মগুরু নিহত হয়েছেন। সেখানে একটি মঠ ধ্বংসের খবরও আমাদের ব্যথিত করেছে। এগুলোর দ্রুত তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় না আনলে পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থাকে। কয়েকজন বিদেশিকে হত্যার বিষয়টি অভাবনীয়। আর তা-ও নিতান্ত নিরীহ ব্যক্তিদের। ভিন্নমতাবলম্বী ব্লগাররা কারও অনুভূতিতে আঘাত দিলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। কিন্তু তা না করে তাঁদের পরিকল্পিতভাবে হত্যার জন্য সচেষ্ট একটি গোষ্ঠী। তারা সচেষ্ট দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতেও। ধর্মীয় সংখ্যালঘু কিংবা শিয়া, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেও তারাই সক্রিয়। এমনকি এ ধরনের হামলায় নিহত হয়েছেন দুজন পীর। তাঁদের মত কেউ সমর্থন না করলেও হত্যা করা যায় না। এগুলোকে আমরা যথাসময়ে দৃশ্যমানভাবে আইনের আওতায় আনতে পারিনি। তা দ্রুত করা গেলে এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা লাল সংকেত পাবে।
জনগণের বড় সংশয় পুলিশের কিছু সদস্য ক্রমবর্ধমান হারে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সংবাদে। প্রায় সব সংস্থাতেই অসৎ লোক আছে। তবে পুলিশ একটি অস্ত্রধারী সুশৃঙ্খল বাহিনী। জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হলে মোকাবিলায় পুলিশই অগ্রভাগে। কারও জানমাল বিপন্ন হলে ছুটে যেতে হয় তাদের কাছে। সে পুলিশকে সবাই বন্ধু আর সজ্জন হিসেবে চায়। তাদের অনেকেই তা আছে। কিন্তু সবাই নয়। এসব ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রে উত্তরণের পর জনপ্রশাসনে দলীয়করণের মৃদু হাওয়া আসতে থাকে। তবে পালে জোর বাতাস পায় ২০০১ সালের পর থেকে। আর তীব্রতা বেড়েই চলছে। ফলে সব সরকারি চাকরিতেই সৃষ্টি হয়েছে ক্ষমতাসীন দলে যাঁরা থাকেন, তাঁদের কারও না কারও আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তি। প্রবণতাটি প্রধানত ভর করেছে প্রশাসন ও পুলিশে। তারা বেপরোয়া। চেইন অব কমান্ড অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল।
অপরাধ জগৎকে উসকে দেওয়ার পেছনে আরেকটি বিষয় ব্যাপক প্রভাব রাখছে বলে অনেকেই মনে করেন। তা হলো ‘রাজনৈতিক কারণে’ মামলা প্রত্যাহার আর রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে দণ্ডিত এমনকি প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত আসামিকে মুক্তি দেওয়া। ২০০১ আর ২০০৯ সালে সরকার পরিবর্তনের পর হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
রাজনৈতিক কারণ বলা হলেও এভাবে মামলা প্রত্যাহারের কার্যক্রম ছিল বিতর্কিত। অভিযোগ রয়েছে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কবিহীন বহু অভিযুক্ত গুরুতর অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পেয়ে যায় এ প্রক্রিয়ায়। তা ছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক ব্যক্তি বিদেশে পালিয়ে গিয়ে ব্যবসা করত। চারদলীয় জোট সরকারের সময় তাকে সমঝোতার মাধ্যমে ডেকে এনে কয়েক দিন জেলে রেখে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগে মুক্তি দেওয়া হয়। তেমনি ঘটেছে বর্তমান সরকারের সময়কালেও। রাষ্ট্রপতির এ সাংবিধানিক ক্ষমতা অপরিবর্তিত থাকুক, তা আমরা চাই। তবে সেটার প্রয়োগ হোক নিরঙ্কুশ জনস্বার্থে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে নয়। এ ধরনের কার্যক্রম অপরাধ জগৎকে সবুজ সংকেতই দিয়েছে।
পুলিশের দায়িত্ব পালনের সীমাবদ্ধতা আছে অনেক। তেমনি সীমাবদ্ধতা আছে সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোরও। আর সেগুলো পুলিশ থেকে ভালো চলছে এমনও বলা যাবে না। পুলিশের সীমাবদ্ধতা লোকবল, যানবাহন, আবাসনসহ অনেক বিষয়েই। সরকার এ বিষয়গুলো দূর করতে সক্রিয়, এমনটাই দেখা যায়। হয়তো সুফল পাওয়া সময়সাপেক্ষ।
অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, এ সংস্থাটির জনবল আর পদ-পদবি বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়ে চেলছে অপরাধীদের দাপট। একে মোকাবিলা করতে হলে পুলিশ বাহিনী সম্প্রসারণের পাশাপাশি তাদের উন্নততর প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করতে হবে। অপরাধের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। এসব তদন্তে প্রয়োজন উঁচু মানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুদক্ষ কর্মকর্তা। এখন পুলিশ বাহিনীতে মেধাবী কর্মকর্তা যথেষ্ট রয়েছেন। তাঁদের দেশ-বিদেশে উন্নততর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করা দরকার। আজকাল সিঁধ কেটে চুরি হয় না। টাকা চুরি হয় এটিএম বুথ থেকে, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে। সুতরাং তদন্তের ধরন ও তদন্ত কর্মকর্তার মানও একই পর্যায়ে নিতে হবে। আরেকটি বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, বর্তমান আইনি কাঠামোতে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। নতুন একটি আইনের খসড়াও রচিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, এ ধরনের আইন হলেই পুলিশ বাহিনী অনেক নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে। থাকতে পারে প্রচলিত আইনের সীমাবদ্ধতা। প্রয়োজন হতে পারে নতুন আইন প্রণয়নের। তবে আইন করে অফুরন্ত ক্ষমতা দিলেও প্রতিষ্ঠানটি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। দৃষ্টান্ত হিসেবে তো আমাদের সামনে দুর্নীতি দমন কমিশনই রয়েছে। সংবিধান ও বিভিন্ন আইনে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রভূত ক্ষমতা দেওয়া হলেও এটি সময় সময় মুখ থুবড়ে পড়েছে। নচেৎ এ দেশের বেশ কটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কথা ছিল না। নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য বেশ কয়েকবারই নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠনের প্রয়োজন হয়েছে। সুতরাং বলা চলে কার্যকর আইনের প্রয়োজন আছে। তবে তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন সে আইনটি যাঁরা প্রয়োগ করবেন, তাঁদের মানসিকতা। পাশাপাশি সরকারের সদিচ্ছা।
আমরা আইনের শাসন চাই। আইনের দ্বারা গঠিত পুলিশ আইন প্রয়োগ করবে, এটাই চাই। সে গণ্ডির বাইরে তারাও যেতে পারে না। হবিগঞ্জে চার শিশু হত্যা মামলার এক আসামি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। এর আগে কেরানীগঞ্জে সম্প্রতি একটি হত্যা মামলার কুখ্যাত এক আসামি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধৃত হওয়ার পর ‘ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। ‘ন্যায়বিচার হয়েছে এবং এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে’ এই দাবিতে সেখানে মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটি আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ।
এ ধরনের ঘটনা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এমনটা আমরা চাই না। আমরা চাই শক্তিশালী, দক্ষ ও নিরপেক্ষ আর আইনের প্রতি অনুগত একটি পুলিশ বাহিনী। এর জন্য যা প্রয়োজন, সরকারের তাই করা দরকার ।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.