বাবা অকুতোভয় হতে শিখিয়েছেন

ঠিক একবছর আগে ঢাকার বইমেলা থেকে বেরিয়ে আসার পথে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার অভিজিৎ রায়কে। তাকে নিয়ে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন-এ লিখেছেন তারই সৎ মেয়ে তৃষা আহমেদ। তৃষা বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। নিজের লেখায় বাবাকে নিয়ে তিনি অনেক কিছু লিখেছেন। লিখেছেন সেই হামলাটির কথা, যেটি তিনি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
তৃষা লিখেছেন, কিছুসময়ের জন্য, তাকে ‘বাবা’ বলতে আমার অদ্ভুত লাগতো। কারণ, তিনি ছিলেন মজার একজন মানুষ। বুদ্ধির ঝিল্লি আর আভা সবসময় লেগেই থাকতো। আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। পরীক্ষা শেষে গ্রীষ্মে আমরা নতুন ঘরে ওঠি। বাড়ির পেছনটা থেকে দুটো লম্বা লাঠি নিয়ে তিনি একটি দিলেন আমাকে। ‘তলোয়ার লড়াই’, চ্যালেঞ্জের সুরে বললেন তিনি। ‘তোমাকে পেটাতে আমার অনেক ভালো লাগবে,’ আমিও মেকি বিদ্রূপের সুরে পালটা জবাব দিলাম। সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত আমরা এই কাঠের তলোয়ার দিয়ে লড়াই চালিয়ে গেলাম। প্রতিবার হেরে গেলেই আমি মানতে চাইতাম না, ফিরতি খেলা দাবি করতাম। এবং আমি প্রতিটা বারই হেরেছি। আমি একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন তুমি আমাকে কখনই জিততে দাও না? তিনি পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি চাও না আমি তোমাকে আমার সমকক্ষ হিসেবে বিবেচনা করি?’
দিনের বেলায় আমার বাবা কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে চাকরি করতেন। কিন্তু বাসায় ফিরে তিনি হয়ে যেতেন একজন লেখক। তার বইগুলো ছিল সমকামিতার নেপথ্যের বিজ্ঞান নিয়ে, ধর্মীয় উগ্রপন্থার ‘ভাইরাস’ সম্পর্কে। বাংলাদেশের মূলধারায় ধর্মনিরপেক্ষ আলোচনাকে আরও ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করার ফলে ক্রমেই পরিচিত একজন অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে উঠছিলেন তিনি।
আমি তখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ি। জাতীয় এপি এক্সামের এক মাস আগে, আমার ক্যালকুলাস শিক্ষক চলে গেলেন। এর জন্য তিনি দুঃখপ্রকাশও করলেন। সঙ্গে এও জানালেন, তবে তাকে যেতেই হবে। কারণ, হাইস্কুল শিক্ষক হিসেবে তার যথেষ্ট উপার্জন হচ্ছিল না। বাবা ও আমি তখন একটি চুক্তি করলাম। চুক্তিটি ছিল এমন- তিনি আমাকে ক্যালকুলাস ও পদার্থবিদ্যায় সাহায্য করবেন, যদি আমি তার লেখাগুলো ইংরেজি অনুবাদ করে দিই। আমি প্রায়ই বলতাম, ‘বাবা, এ বাক্যগুলো বিদঘুটে! তুমি কীভাবে এ ধরনের গ্রামার দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছ?’ তিনি বলতেন, ‘তৃষা, প্লিজ শুধু সম্পাদনা করে যাও। বিষয়বস্তু ভালো।’ সত্যিই, সবসময়ই এ বিষয়বস্তু দারুণ ছিল। আমরা একটি ভালো কাজ করছিলাম।
প্রতি ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় একটি জাতীয় বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বাংলাদেশে আমার পিতামাতার নিজ শহর। বাংলাদেশে যাওয়ার আগে তারা আমাকে বাল্টিমোরের জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার দেখতে এলেন। এখানে আমি এখনও শিক্ষার্থী। তারা আমার জন্য চকলেট, কাপড়, নোটবুক, কলমে ভরা এক বাক্স উপহার নিয়ে এলেন।
তাদের কিছু দিতে না পেরে আমি অপরাধবোধে ভুগছিলাম। আমি দ্রুত আমার ব্যাকপ্যাক থেকে দুটো স্কার্ফ নিয়ে তাদের উপহার দিলাম। পুরোটা রাত আমার বাবা ওই স্কার্ফ পরে ছিলেন। আমার মা কৌতুক করে আমাকে বললেন, তুমি তাকে যখনই নতুন কোনো জিনিস দাও, সে এটা ভীষণ গর্ব নিয়ে পরে!
২৬শে ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে দশটা। থিওরিটিক্যাল নিউরোসাইন্সের লেকচার ক্লাসের একেবারে শেষের দিকে বসলাম আমি। দুপুরের দিকে ফোন চেক করলাম। দেখি বাংলাদেশ থেকে আমার কাজিনরা তিনটি বার্তা পাঠিয়েছে, এখনও খুলে দেখা হয়নি।
দেখেই আমার চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু পড়তে লাগল। আমার শরীর কেঁপে উঠলো। আমার রুমমেটকে ফোন দিলাম। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে, তুমি ঠিক আছো? আমি জবাব দিলাম, ‘আমার বাবা মারা গেছে। মা বাংলাদেশে আইসিইউ’তে।’
২৬শে ফেব্রুয়ারি বিকাল। স্ফীত লাল চোখ নিয়ে আমি ফেসবুকে লিখলাম:  ‘আমার বাবা ছিলেন একজন বিখ্যাত বাংলা লেখক। বিজ্ঞান ও নাস্তিক্যবাদিতা নিয়ে লেখার জন্যই তিনি বেশি পরিচিত। তার বইয়ের প্রচারের জন্য গত সপ্তাহে তিনি ও আমার মা বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। ১৫ ঘণ্টা আগে, মৌলবাদীরা আমার বাবাকে কুপিয়ে খুন করেছে। আমার মা মারাত্মকভাবে আহত। তিনি এখনও হাসপাতালে। বাবার মৃত্যু বাংলাদেশে এখন প্রধান শিরোনাম।’
‘বাবা ছিলেন মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কট্টর বিশ্বাসী। আমার বয়স ছয় বছর যখন, তখনই বাবা ও মা প্রেম করতেন। পরের ১২ বছরে তিনি আমার বন্ধু, নায়ক, সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগী, নাচের সহযোগী (যদিও আমরা দুজনই খুবই বাজে নাচতাম) ও আমার পিতাতে পরিণত হয়েছেন। তিনি আমাকে কখনই শান্ত হতে বা আরও ভদ্র হতে বলেননি। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন শিক্ষিত, সাহসী ও অকুতোভয় হতে।’
‘আমি ক্ষুব্ধ বা আমার মন ভেঙে গেছে বললে কম বলা হবে। কিন্তু এই পৃথিবী যত খারাপই হোক না কেন, একে আরেকটু ভালো বানানোর লড়াই বন্ধ রাখার কোনো কারণ নেই। তিনি আমাকে যা শিখিয়েছেন, যে ভালোবাসাটা দিয়েছেন, আমি চিরকাল এটি বয়ে বেড়াব। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, বাবা। প্রতিটি জিনিসের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। #শব্দকে হত্যা করা যায় না।’
এ কথাগুলোই মানুষ দেখেছিল সেদিন। কিন্তু তারা যা দেখেনি তা হলো- প্রতিটি রাতে আমাকে ঘুমের বড়ি খেতে হয়েছে, যাতে করে বাবাকে নিজের রক্তের ওপর পড়ে থাকার দুঃস্বপ্ন দেখতে না হয়। মাকে আর কখনই দেখব না বলে বা তাকে আগের মতো পাব না বলে আমার যে দুশ্চিন্তা, তা কেউ দেখেনি। আমি ওই দিনটির পুরো ঘণ্টা বাংলাদেশি খবরের চ্যানেল দেখে কাটিয়েছি, এটা কেউ জানে না। দেখেছি, হাজারো মানুষ আমার বাবার মুখ ব্যানারে এঁকে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে। তার হত্যার বিচার চেয়েছে। মানুষ যা দেখেনি তা হলো, এক মেয়ে ছিল, সে বাকশক্তিহীন হয়ে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.