দেশকে যা বিপন্ন করে, তা উন্নয়ন নয় by আনু মুহাম্মদ

অবশেষে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মুখপাত্র এই সত্যটি স্বীকার করলেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বললেন, ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে ঠিকই।’ একই সঙ্গে এই কথাও বললেন, ‘কিন্তু এই স্থান পরিবর্তন করা যাবে না।’ তাই এই মাসেই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভারতীয় হেভি ইলেকট্রিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির আয়োজন চলছে।
বাংলাদেশের এই অতুলনীয় সম্পদ ও আশ্রয় ধ্বংস হবে জেনেও সরকারকে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতেই হবে? কেন? কোথায় তাদের হাত-পা বাঁধা? অর্থমন্ত্রী নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, যঁাদের হাত-পা বাঁধা নেই, তঁাদের এই সর্বনাশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই দায়িত্ব। সে জন্যই সুন্দরবন-বিনাশী এই প্রকল্প বাতিলসহ সাত দফা দাবিতে ২০১৩ সালের ২৪ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে সুন্দরবন লংমার্চ সংগঠিত করেছিল তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। দাবি পূরণ না হওয়ায় এই কমিটি থেকে আবারও আগামী ১০ থেকে ১৫ মার্চ জনযাত্রা বা বৃহত্তর লংমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ ও সংগঠন বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্য, যুক্তিসহ সরকারের কাছে সুন্দরবনের জন্য বিপজ্জনক এসব প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। প্রবল জনমত তৈরি হয়েছে এর বিরুদ্ধে।
কারণ, মহাপ্রাণ সুন্দরবনের আঙিনায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রকল্পটি অস্বচ্ছ ও অসম। সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম হিসেবে যে সুন্দরবন বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতিকে রক্ষা করে, অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের আঁধার হিসেবে যা প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে, সেই সুন্দরবনকে এই প্রকল্প ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে। সুন্দরবন আছে বলে প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচে। সুন্দরবন বিনষ্ট হওয়া মানে বহু মানুষের জীবিকা হারানো, উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষকে মৃত্যু ও ধ্বংসের হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া। প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বন, এক অতুলনীয় ইকোসিস্টেম, পরিবেশ শোধনের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই।
সুন্দরবনের গুরুত্ব যেমন এ দেশের মানুষ জানে, তেমনি জানে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লিষ্ট সব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। তাই সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিপদ নিশ্চিত জেনে রামসার ও ইউনেসকোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে। সরকার যদি তারপরও এই কাজ অব্যাহত রাখে, তাহলে তারা বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকা থেকে সুন্দরবনের নাম বাদ দেবে বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছে। এ ছাড়া সুন্দরবনের জন্য বিপজ্জনক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি থেকে নরওয়ে সরকারের গ্লোবাল পেনশন ফান্ড বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থসংস্থানে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। দক্ষিণ এশীয় মানবাধিকার সংস্থা সরেজমিনে তদন্ত শেষে এই প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়েছে। প্রথমদিকে খোদ সরকারের বিভিন্ন বিভাগও লিখিতভাবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল! অথচ একদিকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র করে এই নবায়নযোগ্য বিশাল আশ্রয় সুন্দরবন ধ্বংসের আয়োজন চলছে, অন্যদিকে এই প্রকল্প সামনে রেখে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিপইয়ার্ড, সাইলো, সিমেন্ট কারখানাসহ নানা বাণিজ্যিক ও দখলদারি তৎপরতা বাড়ছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি-সংকট নিরসনের যুক্তি তুলেই সরকার এসব কাজ করছে। এই সংকট নিরসন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সরকার যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে বোঝা যায়, সংকট সমাধানের চেয়ে দেশি-বিদেশি কতিপয় গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষাই যেন তাদের প্রধান লক্ষ্য। সুন্দরবন-কৃষিজমি-শহরধ্বংসী প্রকল্প ছাড়াও ফুলবাড়ী-বড়পুকুরিয়ার উন্মুক্ত খনির চক্রান্ত অব্যাহত রাখা, বঙ্গোপসাগরের গ্যাস ব্লক একতরফা সুবিধা দিয়ে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা, কুইক রেন্টালের নামে অনেক বেশি দরে বিদ্যুৎ ক্রয়, তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি শতকরা ২০ ভাগে নেমে এলেও দেশে দাম বাড়িয়ে রাখা, কক্সবাজারের সম্পদ ও সম্ভাবনাকে গুরুত্ব না দিয়ে অস্বচ্ছ, অনির্ভরযোগ্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ, নিরাপত্তা পারমাণবিক বর্জ্যসহ ভয়াবহ ঝুঁকির নিষ্পত্তি না করে রূপপুরে বিপুল ঋণ ও বিদেশি কোম্পানি-নির্ভর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্যোগ ইত্যাদি এর দৃষ্টান্ত।
যেখানে বঙ্গোপসাগরের তেল-গ্যাস সম্পদই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রধান অবলম্বন, সেখানে এই সম্পদ নিয়ে সতর্ক সুচিন্তিত দায়িত্বশীল পরিকল্পনা হওয়াই বাঞ্ছিত। না হলে দেশ এক বিশাল সুযোগ ও সম্ভাবনা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হবে। অথচ উল্টো এই বিষয়ে যেসব তৎপরতা চলছে, তা জেনে যে কেউ স্তম্ভিত হবেন। সরকার বিনা টেন্ডারে ‘পারস্পরিক বোঝাপড়া’র ভিত্তিতে সমুদ্রের তেল-গ্যাস ব্লক ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই কাজে ২০১০ সালে প্রণীত ‘দায়মুক্তি আইন’ ব্যবহার করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কোনো কাজের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যায় না। তাড়াহুড়ার কথা বলেই এর যৌক্তিকতা দেখানো হচ্ছে। অথচ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টার কারণেই সমুদ্র সম্পদ নিয়ে অনুসন্ধানে বিলম্ব হচ্ছে। আমরা কনোকো–ফিলিপসের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতা করেছিলাম। সে সময় সরকার এই তাড়াহুড়ার অজুহাত দিয়েই জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি করেছিল। কনোকো–ফিলিপস চুক্তি করে ঠিকই সাবকন্ট্রাক্ট দিয়েছে, তাদের শেয়ারের দাম বাড়িয়ে লাভবান হয়েছে, কোনো কাজের কাজ করেনি। বাংলাদেশের ক্ষতি হয়েছে, সময় নষ্ট হয়েছে।
আমরা বলেছিলাম যেহেতু সমুদ্রের গ্যাস সম্পদের সম্ভাব্য বিশাল মজুত দেশের ভবিষ্যতের বড় অবলম্বন, সেহেতু জাতীয় সংস্থার মালিকানায়, প্রয়োজনে বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে কোনো নির্দিষ্ট কাজে দক্ষতার ঘাটতি থাকলে সাবকন্ট্রাক্টর নিয়োগের মাধ্যমে, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজ করা হোক। এভাবে জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর কর্মসূচি নিলে দেশের শতভাগ সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নয়নের শক্তিশালী ভিত নির্মাণ সম্ভব হতো, উল্লিখিত বিভিন্ন মানবধ্বংসী প্রকল্প নিতে হতো না। সরকার সে পথে যাওয়ার কোনো চেষ্টা না করে নানা রকম ভুল নীতি ও দুর্নীতির পথে গেছে। পিএসসি মডেল বারবার সংশোধন করে এখন যেভাবে দাঁড় করানো হয়েছে, তা দুর্নীতি ছাড়া আর কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রস্তাব অনুযায়ী, যে দামে গ্যাস কেনা হবে, তা আমদানি করা গ্যাসের দামের সমান কিংবা তার চেয়ে বেশি হবে। উপরন্তু, পাইপলাইনের ব্যয়, কোম্পানির কর সবই বহন করবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া প্রতিবছর গ্যাসের দাম শতকরা ৫ ভাগ হারে বৃদ্ধির ব্যবস্থা, ব্যয় পরিশোধ পর্বে বিদেশি কোম্পানির অংশীদারত্ব শতকরা ৫৫ ভাগ থেকে বৃদ্ধি করে শতকরা ৭০ ভাগ করা হয়েছে। এই রকম মডেলে চুক্তি সম্পাদন করলে বঙ্গোপসাগরের গ্যাস সম্পদ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পায়নের কাজে লাগানোর সুযোগ থাকবে না। তার ওপর এ ধরনের চুক্তির কারণে বাংলাদেশের আর্থিক বোঝাও বাড়বে।
শুধু জ্বালানি খাতে দায়মুক্তি নয়, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কোম্পানি ও তার কর্মকর্তা-পরিচালকদের সম্ভাব্য সব ক্ষতি ও ব্যয়ের জন্যও দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে গত ৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ‘পারমাণবিক বিদ্যুৎ বিল ২০১৫’ পাস করা হয়েছে। ‘সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম রক্ষণ’ শিরোনামে ২৮তম ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই অধ্যাদেশ জারির পূর্বে বা পরবর্তী সময়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনার বিষয়ে সরল বিশ্বাসে কৃত কোনো কাজকর্মের জন্য সরকার, চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রকল্প পরিচালক, অন্য কোনো পরিচালক, পরামর্শক, উপদেষ্টা, কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোেনা আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাইবে না।’ ক্ষতি হলে তার কোনো দায়দায়িত্ব কেউ নেবে না। শুধু বিপদ টানবে বাংলাদেশের মানুষ।
কিন্তু দেশের সর্বজনের সম্পদ নিয়ে যথেচ্ছাচার ও ‘হাত–পা বাঁধা’ ভূমিকার অধিকার কোনো সরকারের থাকতে পারে না। বিদ্যুৎ-সংকট সমাধানে যথাযথ পথ অবশ্যই আছে। সর্বজনের সম্পদে শতভাগ জাতীয় মালিকানা ও শতভাগ সম্পদ দেশের কাজে ব্যবহার, দুর্নীতি করার দায়মুক্তি আইন বাতিল করে ‘খনিজসম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধকরণ আইন’ প্রণয়ন, পিএসসি প্রক্রিয়া বাতিল করে স্থলভাগে ও সমুদ্রে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে জাতীয় সংস্থাকে প্রয়োজনীয় সুযোগ, ক্ষমতা ও বরাদ্দ প্রদান, রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট মেরামত ও নবায়ন, উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি নিষিদ্ধসহ ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ, নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদের সর্বোত্তম মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি জ্বালানি নীতি প্রণয়ন, দীর্ঘ মেয়াদে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব প্রদান ইত্যাদি যথাযথ পথ। এই পথই দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই, সুলভ, নিরাপদ ও জনবান্ধব উন্নয়ন ধারা তৈরি করতে সক্ষম।
সরকার যাচ্ছে উল্টো পথে: ব্যয়বহুল, ঝুঁকিপূর্ণ, বন-পানি-মানুষ-পরিবেশবিধ্বংসী ও ঋণনির্ভর। এতে কিছু দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর লাভ হলেও দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে অনিশ্চয়তা, বিপদ ও বিপন্নতার দিকে। এগুলোকে যতই উন্নয়ন বলে ঢোল পেটানো হোক, এগুলো মানববিধ্বংসী অস্ত্রের মতোই মানুষ ও প্রকৃতিবিধ্বংসী প্রকল্প। মানুষ ও দেশকে বিপন্ন করার এসব আয়োজন আমরা মানতে পারি না।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
anujuniv@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.