ডেইলি স্টার-প্রথম আলো : সঙ্কট এবং প্রেক্ষাপট by গোলাম মাওলা রনি

মামলাগুলো একের পর এক ঘটে যাচ্ছে ঠিক যেন সিনেমার মতো। প্রধানমন্ত্রীতনয় সজীব ওয়াজেদ জয় সর্বপ্রথম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিলেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে। তিনি কুখ্যাত ১/১১-র মাস্টারমাইন্ড হিসেবে মাহফুজ আনামকে দায়ী করে ওই আমলে সংঘটিত নানা অবিচার-অনাচারের জন্য তার বিচার দাবি করলেন। এর কয়েক দিন পর হঠাৎ করেই মাহফুজ আনাম একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে হাজির হয়ে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে বলে বসলেন, ১/১১-র সময় তৎকালীন ডিজিএফআই থেকে সরবরাহকৃত খবরগুলো তিনি কোনোরূপ যাচাই-বাছাই না করেই ছেপেছেন, যা ছিল তার সাংবাদিক জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। এই ঘটনার পরের রাতে আরো একটি অযাচিত অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ডেইলি স্টারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে হঠাৎ করেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপস্থিত হলেন এবং মাহফুজ আনাম তাকে মঞ্চে নিয়ে বক্তব্য প্রদানের সুযোগ করে দিলেন। অনুষ্ঠানে সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। তারা ড. ইউনূসের আকস্মিক উপস্থিতিতে বিব্রতবোধ করলেন এবং সভাস্থল ত্যাগ করে চলে গেলেন। এ ঘটনার দু-তিন দিনের মাথায় সারা দেশে মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে একের পর এক মানহানি এবং রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের হতে থাকে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯০।
আওয়ামী লীগের সাথে ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলো পত্রিকার দ্বন্দ্ব মূলত মনস্তাত্ত্বিক। নবম সংসদ গঠিত হওয়ার পর সরকারি দল আওয়ামী লীগ একাধিকবার সংসদ এবং সংসদের বাইরে প্রথম আলো এবং এর সম্পাদক মতিউর রহমানকে উদ্দেশ করে নানা অভিযোগ উত্থাপন করেছে। এমনটাও কেউ কেউ প্রচার করেছেন- ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার নায়ক সাজাপ্রাপ্ত আসামি মুফতি হান্নান নাকি প্রথম আলো অফিসে বসে শেখ হাসিনাকে নিঃশেষ করার পরিকল্পনার ব্যাপারে স্বীকারোক্তি প্রদান করেছেন। তিনি নাকি এ কথাও বলেছেন, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার অর্থের জোগান এসেছে পত্রিকাটির কাছ থেকে। সরকার মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে থাকে বলে জানা যায়। তার পুত্রসন্তান ও কন্যাসন্তানের কাছ থেকে নানা স্বীকারোক্তি সংগ্রহ করা হয় কৌশলে। প্রথম আলো থেকে চাকরিচ্যুত সাংবাদিকেরাও তথ্য-উপাত্ত এবং প্রমাণাদি দিয়ে সরকারি সংস্থাগুলোকে সাহায্য করেছেন বলে শোনা যায়। ২০১২ সালের মাঝামাঝি এসে সরকার মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ‘তথ্য-প্রমাণ’ হাজির করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায় মূলত অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে।
রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট সবার ধারণা, আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম আলো সম্পাদককে এক চুলও ছাড় দেবে না। এ ক্ষেত্রে প্রথম আলোর সাথে যুগপৎভাবে ডেইলি স্টার ও সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শাসক দলে আলোচনা হতো। অনেকে আবার পত্রিকা দু’টির মালিক লতিফুর রহমানের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ উত্থাপন করতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফাকে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান এবং উলফা নেতা পরেশ বড়–য়ার সাথে লতিফুর রহমানের আত্মীয়তার সূত্র ধরে বাংলাদেশকে স্থায়ী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগে তাদের দায়ী করে নানা দেশী-বিদেশী সংস্থার একাধিক প্রতিবেদন সরকারের হস্তগত হওয়ার দাবি করার পর সরকার উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
সরকারের নানামুখী তৎপরতার খবর পত্রিকা দু’টি ঠিকই জানত। অনেকের মতে, সতর্কতা হিসেবে তারা তিনটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রথমত, কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখানো। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সাথে একান্ত ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা। তৃতীয়ত, পত্রিকা দু’টিতে কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে যারা আওয়ামী মনোভাবাপন্ন তাদের মাধ্যমে বঙ্গভবন ও গণভবনের একটি সেতুবন্ধ গড়ে তোলা। তিনটি পদক্ষেপই দারুণভাবে কাজ দেয়। কিন্তু তৃতীয় পদক্ষেপটি পত্রিকা দুটোর জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। কেউ কেউ বঙ্গভবন ও গণভবনের পিঠে-পুলি-পায়েস পার্বণে অংশ নিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং তার পরিবারের সাথে একত্রে ছবি তুলে তা ফেসবুকে পোস্ট করার মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তির জানান দিতে থাকেন। এই সুযোগে শাসক দলের কর্তাব্যক্তিরা নতুন মাইনাস টু প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে এগোতে থাকেন। অর্থাৎ তারা চান, ডেইলি স্টার-প্রথম আলো চলবে কিন্তু মাহফুজ-মতিউর থাকবেন না। এখন প্রশ্ন হলো ১/১১’র সময়ে জাতীয় রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়াকে বাদ দেয়ার ফর্মুলার আদলে নতুন মাইনাস টু প্রকল্প বা মাইনাস টু জুনিয়র-এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে পত্রিকা দুটো নিয়ে আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন সম্মানিত পাঠকদের জানানো আবশ্যক।
আমার মতে, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম এবং প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান হলেন গত পনেরো বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের অন্যতম। মানসম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি, গ্রহণযোগ্যতা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিচারে গত পনেরো বছরে এ দেশের কেউ তাদের সমপর্যায়ে যেতে পেরেছেন কি না জানা নেই। কিন্তু তারা একবারও ভাবেননি যে, তাদের পূর্বসূরি দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক এবং অবজারভার ভবনের আয়তন ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলো ভবনের চেয়ে অনেক বড় ছিল। অন্য দিকে ওই সব ভবনের স্বর্ণালি দিনগুলোতে যেসব সিংহপুরুষ তারকা সাংবাদিক সেখানে কাজ করতেন তাদের সমপর্যায় তো দূরের কথা, তাদের কাছে বসার মতো একজন সাংবাদিকও প্রথম আলো কিংবা ডেইলি স্টার ভবনে নেই। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, আবদুস সালাম এবং তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব, প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা বর্তমান জমানায় কল্পনাও করা যায় না। অথচ তারা যেসব দুঃসাহসিক কর্ম করেননি, তার চেয়েও বেশি মাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ কর্মে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলেছেন মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমান। এটা বর্তমান পরিণতি ডেকে এনেছে বলে অনেকের অভিমত।
মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানের কিংবদন্তি পূর্বসূরিরা অত্যন্ত সচেতনভাবে নিজেদের সুসময়কে কাজে লাগিয়েছিলেন। তারা নিজেদের পেশা, স্বার্থ ও বলয়ের বাইরে গিয়ে বহু মানুষের সাথে আত্মার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। সাংবাদিক সমাজের সাথে তাদের সম্পর্ক এতটাই চমৎকার ছিল যে, সারা দেশের সাংবাদিকেরা তাদেরকে আদর্শ মানব বলে সম্মান-সমীহ করতেন। তারা অহঙ্কার করতেন না, সবাইকে সম্মান করতেন এবং কাউকেই ব্যক্তিগতভাবে হেয় করতেন না। তারা নিজেরা ছিলেন অতি উঁচুমানের পণ্ডিত, লেখক এবং সমাজসংস্কারক। রাজনীতিবিদদের সাথে তাদের ছিল আত্মার সম্পর্ক। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মাওলানা আকরম খাঁকে সমীহ করতেন না- এমন কোনো রাজনীতিবিদ ছিলেন না। অন্য দিকে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং অবজারভার মালিক হামিদুল হক চৌধুরী পাকিস্তান জমানায় পূর্ববঙ্গের রাজনীতির মধ্যমণি ছিলেন। এসব প্রবাদপুরুষ দেশীয় ঐতিহ্যকে লালন করতেন এবং সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতেন।
মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানকে যেমন তাদের উল্লিখিত পূর্বসূরিদের সাথে তুলনা করা যাবে না; তেমনি তাদের পত্রিকার গুণগত মান, গ্রহণযোগ্যতাকে সোনালি দিনের আজাদ, ইত্তেফাক কিংবা অবজারভারের সাথে মেলানো যাবে না। তবে অতি অল্প দিনে অধিকসংখ্যক পাঠক সংগ্রহ এবং তার চেয়েও কম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সফলতা অর্জনের কথা বিবেচনা করলে তারা অবশ্যই প্রথম হবেন।
এই সফলতাকে হয়তো আলোচিত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানির সফলতার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কিন্তু আজাদ, ইত্তেফাক ও অবজারভারের সার্থকতার সাথে মেলানো যাবে না। অল্প সময়ের মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি ফুলে-ফেঁপে উঠলে সাধারণত যেসব ‘রোগবালাই’ দ্বারা তারা আক্রান্ত হয়, সেগুলো হয়তো আজ ডেইলি স্টার-প্রথম আলোকে চেপে ধরেছে। অনেকের মতে, অহংবোধ, অতি উচ্চাকাক্সক্ষা, নিজেদেরকে অতিপণ্ডিত হিসেবে জাহির এবং পেশার অন্যদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার পরিণামে আজ তারা মহা বিপদে পড়েছেন। এ সুযোগকে পুরোমাত্রায় কাজে লাগাচ্ছে বর্তমানের শাসক দল।
আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগের সাথে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর দ্বন্দ্বটি মূলত মনস্তাত্ত্বিক। আওয়ামী লীগ মনে করে, পত্রিকা দু’টির সম্পাদক তাদের সাংবাদিকতার পেশা এবং গণমাধ্যমের মঞ্চ ব্যবহার করে ১৫-১৬ বছর ধরে ক্রমাগতভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন রাজনীতিবিদদের ইমেজ নস্যাৎ করার জন্য। আওয়ামী লীগ মনে করে তারা গত পনেরো-বিশ বছরে রাজনীতির একটি ভালো সংবাদও পরিবেশন করেনি। বরং দু-একটি দুর্ঘটনা, অপকর্ম কিংবা অনিয়মকে পুঁজি করে তামাম সম্প্রদায়ের ওপর কালিমালেপনের অব্যাহত চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, দুই সম্পাদকের প্ররোচনায় ১/১১ প্রলম্বিত হয়েছে। তাদের কারণেই জাতীয় দুই নেত্রীকে জেলে যেতে হয়েছিল। কাজেই যেভাবে আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হচ্ছে, একইভাবে অভিযুক্ত দুই সম্পাদককেও বিচার করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরই পুরো দৃশ্যপট রাতারাতি পাল্টে যেতে থাকে। সরকারসমর্থক নেতাকর্মী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা সর্বশক্তি নিয়োগ করে মাহফুজ-মতিউরের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারযজ্ঞে নেমে পড়েছেন। টেলিভিশনগুলোতে শুরু হয়ে গেছে ডেইলি স্টার-প্রথম আলো নিধনযজ্ঞ। সবারই এক কথা- যত দোষ তা কেবল মাহফুজ-মতিউরের কপালেই তিলক আকারে লেপ্টে দিতে হবে। শত শত কণ্ঠ বাংলার টেকনাফ থেকে তেঁতুরিয়া পর্যন্ত একসাথে আওয়াজ তুলছে- দুই সম্পাদকের অবশ্যই বিচার হতে হবে এবং দুই সম্পাদকের উচিত অবিলম্বে পদত্যাগ করা।
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলটি যেভাবে দেশের শীর্ষ দু’টি পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি এবং রাষ্ট্রশক্তির মেশিনারিগুলো ব্যবহার করে প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে, তাতে শেষ পর্যন্ত তাদের অবস্থা যে, একুশে টিভির আবদুস সালাম এবং আমার দেশের মাহমুদুর রহমানের মতো হবে না এ কথা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় সম্পাদকদ্বয়ের সবচেয়ে ভালো সাহায্যকারী হতে পারতেন আওয়ামী লীগ-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো এবং দেশের সাংবাদিক সমাজ। কিন্তু ডেইলি স্টার-প্রথম আলো প্রথম থেকেই তাদের বন্ধু তালিকা থেকে রাজনীতিবিদ, ধর্মীয় মহল এবং সাংবাদিক সংগঠনকে বাদ দিয়ে একটি দেশী-বিদেশী বন্ধুমহল গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। ২০-২৫ জন বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা ও বয়সের লোকজনকে বুদ্ধিজীবী ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে তুলে ধরেছে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের ধ্রুব সত্য হলো, এ দেশে ১/১১ সংঘটিত হয়েছিল। এ সময়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছিল শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিতে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এই লক্ষ্যে দুই নেত্রীকে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। পরে ব্যর্থ হয়ে তাদের জেলে ঢোকানো হলো। ১/১১’র রাজনীতির ছলচাতুরী ও কলাকৌশলের সাথে তৎকালীন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত লোকজন যেমন জড়িত ছিলেন, তেমনি আওয়ামী লীগ-বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকে জড়িত ছিলেন। কিংস পার্টি খ্যাত কয়েকটি হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ভুইফোঁড় রাজনৈতিক দল এবং দুইটি পত্রিকা যে মাইনাস টু ফর্মুলার অংশীদার ছিলেন তা দেশের মানুষ বিশ্বাস করে। এ অবস্থায় কেবল সম্পাদকদ্বয় একক প্রচেষ্টায় এবং একক কণ্ঠে প্রতিবাদ করে ইতিহাসের সেই দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারবেন না।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ হয়তো ভারতীয় রাজনীতির একটি ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আগাম সতর্কতা হিসেবে সম্পাদকদ্বয়কে টার্গেট করেছে। অনেকে মনে করে, ভারতের নামীদামি কয়েকজন সম্পাদক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদের সিন্ডিকেট একটি বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়ে প্রথম দফায় ইন্দিরা সরকারের পতন ঘটায়। সিন্ডিকেটের প্রধান ছিলেন ইন্ডিয়ার এক প্রেসের মালিক রামনাথ গোয়েঙ্কা, সাংবাদিক খুশবন্ত সিং, সাগরময় ঘোষ, কলামিস্ট নিরোদচন্দ্র চৌধুরী, শিল্পপতি ধীরুভাই আম্বানি, অমলেশ ত্রিপাঠি, আইনজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ রাম জেঠমালানি প্রমুখ। সিন্ডিকেটটির তৎপরতার কারণে ১৯৭৫-৭৭ সালে পুরো ভারত উত্তাল হয়ে ওঠে এবং ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়। পরে ১৯৮০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা আবার ক্ষমতায় আসার কিছুকাল পর তাকে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়।
আওয়ামী লীগ যদি উপরিউক্ত ঘটনা বিশ্বাস করে দুই সম্পাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে আগ্রহী হয়ে থাকে তবে একই ঘটনার মধ্যে সম্পাদকদ্বয়ের জন্যও শিক্ষা রয়েছে। তারা ইচ্ছা করলে জেনে নিতে পারবেন, কেন ১৯৭৫-৭৭ সালের জরুরি অবস্থার মধ্যেও ইন্দিরা গান্ধী ‘সিন্ডিকেট’ সদস্যদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেননি। অথবা ১৯৮০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসীন হয়ে কেন ইন্দিরা গান্ধী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন? তার মৃত্যুর পর রাজিব গান্ধী শত চেষ্টা করেও কেন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়ে উল্টো তাদের সাথে সমঝোতায় বাধ্য হয়েছিলেন?

No comments

Powered by Blogger.