নেপালে এখনকার জীবনযাত্রা by মোহাম্মদ আবুল হোসেন

ফুটপাতে ক্যাম্প করে ৫ দিন ধরে অবস্থান করছেন শিব পারওয়ার। তিনি রান্নার গ্যাসের জন্য এমন অখণ্ড অবস্থান নিয়েছেন। তার সামনে ৫২১টি খালি গ্যাস সিলিন্ডার। ফলে আরও অনেকটা সময় তাকে অপেক্ষা করতে হবে। কতক্ষণ বা কতদিন তা বলতে পারছেন না ডিলার। কারণ, তারা নিশ্চিত নন যে কখন গ্যাস সরবরাহ আসবে। প্রায় দু’মাস ধরে অবরোধের ফলে এই হলো নেপালের নিত্য দিনের চিত্র। এর ইতি ঘটার কোন লক্ষণ নেই। শিব পারওয়ার বলেছেন, পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে সন্তানদের ও স্ত্রীকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। ধার করা অর্থে আমি বাইরের রেস্তোরাঁয় খাচ্ছি। এখন সেই অর্থও শেষ। এ অবস্থায় এই লাইনে আর কত সময় থাকতে পারবো জানি না। বার্তা সংস্থা এপির এক প্রতিবেদনে নেপালের চিত্র এভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গত ২০শে সেপ্টেম্বর নেপালের নতুন সংবিধান পাস হওয়ার পর থেকে শুরু হয়েছে অচলাবস্থা। বিশেষ করে মধেষি সম্প্রদায় মনে করছে এ সংবিধানে তাদের অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। এ জন্য তারা প্রায় দু’মাস ধরে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। এতে ভারত থেকে যাওয়া সব সরবরাহ বাধা পড়ছে নেপাল সীমান্তে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে গ্যাসোলিন, ডিজেল, রান্নার জ্বালানি, খাদ্য, ওষুধ সহ নিত্যপণ্যের তীব্র সঙ্কট। চাহিদার মাত্র শতকরা ১৫ ভাগ সরবরাহ আছে নেপালে। মধেষি সম্প্রদায়ের সরকারের সঙ্গে এই রাজনৈতিক চাপে দেশটি মূলত অচল হয়ে পড়েছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এতে বর্তমানে লাখ লাখ মানুষ দুর্ভোগে ভুগছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এ বসন্তের ভূমিকম্প। তার ফলে এমনিতেই এই শীতে অসংখ্য মানুষ জ্বালানি সঙ্কটে ভুগছে। তারা বাড়িঘর নির্মাণ নিয়ে ব্যস্ত। শিব পারওয়ার বলেন, খাদ্যের দাম আকাশচুম্বী। শুধু তা-ই নয়, নেপালে বহু জিনিসের সঙ্কট রয়েছে। এতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষ। যারা ধনী ও নেতা তারা ঠিকই জ্বালানি তেল, গ্যাস পাচ্ছে। তারা আরামে জীবনযাপন করছে।
মধেষিদের অভিযোগ
দীর্ঘ কয়েক বছরের লড়াই সংগ্রামের পর ২০শে সেপ্টেম্বর নেপালে পাস হয় নতুন সংবিধান। এর প্রতিবাদে দেশটির দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অপরোধ আহ্বান হরে মধেষিরা। তারা মধেষিদের জন্য একটি বৃহত্তর প্রদেশ দাবি করছে। তাদেরকে পার্লামেন্টে যতগুলো আসন দেয়া হয়েছে তার চেয়ে বেশি আসন দাবি করছে তারা। এ নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে তাদের বিক্ষোভ হয়েছে। ভাঙচুর হয়েছে সরকারি গাড়ি। মহাসড়ক হয়েছে অবরোধ। এ পর্যন্ত সহিংসতায় কমপক্ষে ৫০ জন প্রতিবাদকারী, পুলিশ ও পথচারী। মধেষিদের নেতৃস্থানীয় এক নেতা উপেন্দ্র যাদব। সরকার তাদের দাবি অবজ্ঞা করছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। বলেন, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বিক্ষোভে সরকার ব্যবহার করছে অতিরিক্ত শক্তি। গত সপ্তাহে সরকার তার ভাড়া করা গুন্ডাদের দিয়ে গণ আন্দোলন বানচাল করার চেষ্টা করেছে। তারা মঞ্চে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এসব নিয়ে সরকারের সঙ্গে কমপক্ষে ৯ বার তাদের আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তাতে কোন ফল হয় নি।
সরকারের প্রতিক্রিয়া
নেপালে বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট সরকার। এর নেতৃত্বে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী খড়গ প্রসাদ ওলি। প্রতিবাদ বিক্ষোভের ভিতর দিয়েই তিনি দায়িত্ব হাতে নেন। তবে তার পর কেটে গেছে দু’মাস। কিন্তু এখনও দৃশ্যত কোন সমাধান আসে নি। সরকার বলেছে, তারা সংবিধান পরিবর্তনে প্রস্তব। তবে বিক্ষোভকারীরা মধেষিদের জন্য যত বড় প্রদেশ দাবি করছে তার চেয়ে কিছুটা ছোট হবে ওই প্রদেশ। হিমালয় দুহিতা নেপালে রয়েছে শতাধিক জাতিগোষ্ঠীর বাস। এর মধ্যে মধেষিরা হলো সবচেয়ে বড় অংশ। নেপালের মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ তারাই। ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনাইটেড মার্কসিস্ট লেলিনিস্ট) দলের সাধারণ সম্পাদক প্রদীফ গায়ওয়ালি বলেছেন, মধেষিদের অধিক পরিমাণ ভূমি দেয়া হলে তাতে রাজ্যের সীমানা নিয়ে শুরু হবে নতুন নতুন সঙ্কট। এটা নিয়ে আমাদের এক রকম ভীতি আছে।
তাঁবুতে শীত
এ বছর এপ্রিলে ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিরাণ ভূমি করে দেয় নেপালকে। এতে কমপক্ষে ৯০০০ মানুষ নিহত হন। এ পরিস্থিতিতে যারা বেঁচে আছেন তীব্র এই শীতে তারা জীবন বাঁচাতে নিরন্তর সংগ্রাম করছেন। তাদেরই একজন সুন্দরী লামা। তিনি তাঁবু ছেড়ে একটি এপার্টমেন্টে উঠেছিলেন। কিন্তু জ্বালানি সঙ্কটের কারণে আবার তিনি সেই তাঁবুতেই ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন, রান্নার জন্য কোন গ্যাস নেই। তাই কাঠ, খড়কুটো সংগ্রহ করে তা-ই ব্যবহার করছেন জ্বালানি হিসেবে। এই জ্বালানি তিনি এপার্টমেন্টে ব্যবহার করতে পারতেন না। এই শীতে ঠক ঠক করে তিনি কাঁপেন আর রান্না করেন। তার ওপর এক বোতল ভেজিটেবল ওয়েলের দাম তিনগুন বৃদ্ধি পেয়ে ৩০০ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। তার স্বামী একজন দিনমজুর। কিন্তু কাজ বলতে কিছু নেই। তাই সন্তানকে নিয়ে তাদের বেঁচে থাকাই এখন দায় হয়ে উঠেছে।
বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া
নেপালে এখন প্রধান বিরোধী দল নেপালি কংগ্রেস। তারা বলেছে, সরকার ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে তারা একটি সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সেক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগে ঘাটতি আছে বলে তাদের অভিযোগ। তবে সরকার যে বিশ্বাস করে মধেষিদের দাবি মেনে নিলে তাতে আরও জাতিগত সংঘাত সৃষ্টি হবেÑ এ বিষয়ের সঙ্গে একমত নেপালি কংগ্রেস। দলের এমপি রাম হরি খাতিওয়াদা বলেন, এ পরিস্থিতিতে কি ধরণের চুক্তি করতে চায় সরকার সে বিষয়ে পরিষ্কার কোন ধারণা পাওয়া যায় নি। তাদের কাছে কোন পরিকল্পনা নেই। তারা আলোচনায় আসে অপ্রস্তুত অবস্থায়। তিনি আরও বলেন, যদি এর কোন সমাধান পাওয়া না যায় তাহলে পরিস্থিতি সহসাই খারাপ হবে।

No comments

Powered by Blogger.