স্ত্রী হারিয়ে পরের জন্য সেবা ‘ক্যানসার দাদু’র

তিনি ডাক্তার নন। স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। এমনকী, রোগীর বাড়ির লোকও নন। তবু সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় নিত্য ওই বৃদ্ধের দেখা মেলে। নানান ভূমিকায়।
যেমন কোনও দিন হয়তো আরজিকর বা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের রেডিওথেরাপিতে ডাক্তারের ঘরে ঢুকলেন এক হতদরিদ্রের হাত ধরে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা মানুষটি হয়তো মহানগরের হাল-হকিকত বোঝেন না। তাঁকে ডাক্তার দেখিয়ে ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করলেন। কখনও দেখা যায়, বাইপাসের বেসরকারি হাসপাতালের ফার্মাসিতে দাঁড়িয়ে কোনও মুমূর্ষুর জন্য ওষুধ কিনছেন। কখনও আবার জমায়েতে বিলি করছেন লিফলেট। যাতে লেখা, কী কী উপসর্গ দেখলে গোড়াতেই ক্যানসারের আঁচ পাওয়া যায়।
মানে, অনাত্মীয় অসহায়দের জন্য টাকা, সময়, সবই খরচ করছেন অকাতরে, নির্দ্বিধায়। ঘরের খেয়ে বাইরের লোকের পাশে দাঁড়ানো মানুষটি কে?
উনি সুবল বসু। উত্তর কলকাতার বাসিন্দা, পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। নিজের কনসালট্যান্সি ফার্ম রয়েছে। অশীতিপর সুবলবাবু এই মুহূর্তে নিজেও মূত্রথলির ক্যানসারে আক্রান্ত। যদিও এগুলোর কোনওটাই তাঁর পরিচয় বোঝাতে যথেষ্ট নয়। উনি আদতে বহু ক্যানসার-রোগীর কাছে মস্ত ভরসা। তাঁরা ওঁকে চেনেন ‘ক্যানসার দাদু’ নামে। যিনি কি না গত সতেরো বছর ক্যানসারের সঙ্গে ‘ঘর’ করছেন।
কী রকম?
উত্তর পেতে গেলে বেশ কিছু বছর পিছিয়ে যেতে হবে। অকৃতদার সুবলবাবুর কনসালট্যান্সি ফার্মে ১৯৯৮-এ যোগ দিয়েছিলেন সাঁইত্রিশ বছরের সুভদ্রা। ভাল কর্মী। কিন্তু আচমকা ঘন ঘন অফিস কামাই। কারণ জানতে চাইলে মহিলা শুধু বলতেন, শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। শেষে অফিস আসা পুরোপুরি বন্ধ। খোঁজ নিতে সুভদ্রার বাগবাজারের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলেন সুবলবাবু। একচিলতে ঘরে মা-বাবা আর মেয়ের সংসার। জানা গেল, বাড়ির একমাত্র রোজগেরে মেয়ের স্তন ক্যানসার ধরা পড়েছে। মা-বাবা বললেন, চোখের সামনে সন্তানের মৃত্যু দেখাটাই তাঁদের ভবিতব্য, কেননা, চিকিৎসার সামর্থ নেই। সুবলবাবু সাহায্যের হাত বাড়াতে চাইলে দৃঢ়চেতা সুভদ্রা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, অনাত্মীয় কারও টাকা নিতে পারবেন না।
তার মানে, আত্মীয়তাই একমাত্র শর্ত?
কালক্ষেপ না-করে সরাসরি সুভদ্রাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন তিরিশ বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ সুবল। ক’দিনের মধ্যে বিয়ে। আর তার পর দিনই মুম্বইয়ের টাটা ক্যানসার হাসপাতালে রওনা। সুবলবাবুর কথায়, ‘‘ওটাই ছিল আমাদের মধুচন্দ্রিমা!’’
মুম্বইয়ে বড় বড় ডাক্তার দেখিয়ে কলকাতা ফিরে অস্ত্রোপচার। সুভদ্রার স্তন বাদ দেওয়া হল। তত দিনে রোগ ফুসফুসে ছড়িয়েছে। টানা ক’বছর চলল কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি। ২০০৫-এ সুভদ্রা মারা গেলেন। সুবলবাবুর জীবনও অন্য দিকে বাঁক নিল। জমানো টাকা ঢালতে থাকলেন দুঃস্থ ক্যানসার-রোগীদের চিকিৎসায় ও সচেতনতার প্রচারে। যে জন্য ২০০৮-এ গড়ে ওঠে সুভদ্রা মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। ‘‘রোগটা গোড়ায় ধরা পড়লে সুভদ্রাকে অকালে চলে যেতে হতো না। উপসর্গগুলো সম্পর্কে আমজনতাকে হুঁশিয়ার করতে নানা জায়গায় নানা অনুষ্ঠান করেছি। লিফলেট, আলোচনা, পদযাত্রা— কিছু বাদ নেই।’’— বলছেন সুবলবাবু। এ-ও জানাচ্ছেন, সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরা যথেষ্ট সাহায্য করেছেন।
তবে স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যাপারে এ শহরের কয়েক জন ক্যানসার-চিকিৎসকের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগও ওঁর কাছে মজুত। এমনকী শ্রাদ্ধের কার্ডে তাঁদের নাম দিয়ে সেই অভিযোগের উল্লেখ করতেও ছাড়েননি, যার জেরে বিস্তর সমস্যা পোহাতে হয়েছে। তবু দমেননি। প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘যার মৃত্যু নিশ্চিত, তারও তো চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আগেই তাকে খরচের খাতায় ফেলে দেওয়া হবে কেন ?’’সুভদ্রার ক্ষেত্রে তেমনই হয়েছিল বলে সুবলবাবুর আক্ষেপ। মূলত সেই যন্ত্রণা থেকে ক্যানসার-রোগীদের ‘মানবিক’ চিকিৎসা দিতে একটি হাসপাতাল খোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। অনুমতি চেয়ে রাজ্য সরকারকে আবেদনপত্র জমা দেন। অনুদানের বিষয়ে খোঁজ-খবর শুরু হয়। প্রথম প্রস্তাব স্বাস্থ্যভবন নাকচ করে দেওয়ায় সুবলবাবু ফের আবেদন করেছেন। স্বাস্থ্য-সূত্রের খবর, এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে কর্তাদের কাছে প্রস্তাবটা বিশেষ গ্রহণযোগ্য ঠেকছে না। ‘‘আমরা বুঝতে পারছি না, উনি কী ভাবে এত বড় একটা জিনিস সামলাবেন।’’— পর্যবেক্ষণ এক কর্তার।
সুবলবাবু অবশ্য দমছেন না। তাড়া-তাড়া কাগজ নিয়ে এক বার ছুটছেন স্বাস্থ্যভবনে, এক বার ব্যাঙ্কে, এক বার উকিলের চেম্বারে। ছ’মাস আগে নিজের ইউরিনারি ব্লাডারে ক্যানসার ধরা পড়েছে। অপারেশন হয়েছে, এখন পরবর্তী চিকিৎসার পর্ব। তাতেও লড়াইয়ের অদম্য ইচ্ছেটা মরেনি। যে রোগ স্ত্রীকে কেড়েছে, নিজের শরীরে থাবা বসিয়েছে, তার বিরুদ্ধে শেষ শক্তি দিয়ে লড়তে তিনি মরিয়া। বলছেন, ‘‘নিজেকে একা ভাবলে এটা পারব না। বিশ্বাস করি, মানসিক ভাবে অনেকেই আমার সঙ্গে আছেন। তাই খানিকটা এগোতে পেরেছি। সরকার কিছুটা সাহায্য করলে হয়তো স্বপ্নটা অধরা থাকবে না।’’ ক্যানসার-আক্রান্ত বৃদ্ধের এ হেন উদ্যম দেখে পোড়-খাওয়া ডাক্তারেরাও অবাক। আরজিকরের রেডিওথেরাপি’র প্রধান চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘ওঁর জীবনীশক্তি অতুলনীয়। এমন মানুষ চারপাশে আরও কিছু থাকলে দুনিয়াটা অন্য রকম হতো।’’ সুবলবাবুরও প্রত্যয়ী ঘোষণা, ‘‘চলে যাওয়ার আগে সুভদ্রার স্মৃতিতে হাসপাতালটা গড়ে তুলতেই হবে।’’
যেন আর এক তাজমহলের কাহিনি!
সুত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা

No comments

Powered by Blogger.